মরুঝড় by মোহিত কামাল

তার ইচ্ছায় আপনাকে বাছাই করা হয়েছেÑএই দুর্লভ সম্মান অর্জন করেছেন আপনি। কীভাবে করলেন?ওঃ! এটুকু শব্দ উচ্চারণ করে থেমে গেল রুস্তম। কীভাবে অর্জন করল এই সৌভাগ্য বলার প্রয়োজনবোধ করলেও এড়িয়ে গিয়ে ভাবল দুবাই-কলি তাহলে মিথ্যা বলেনি! সত্যবাদী দুবাই-কলির কথা ভেবে মন নরম হলেও, বিশেষ মুহূর্তটিতে মনের পর্দায় ভেসে উঠল নববধূ কলির মুখ।
বধূকলি কি মিথ্যা বলতে পারে? শৌর্যের সঙ্গে কি কোনো হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি? সম্ভব? মাথা ঝাঁকিয়ে উড়িয়ে দিতে চাইল ভাবনাটি। উড়াতে পারল না। আরও জোরে যেন গেড়ে বসছে ভাবনার শেকড়। শেকড়ের টানে থেমে যেতে চাইলেও সামনে এগোনো পায়ের গতি থামল না। মনের শুদ্ধতর ঐশ্বর্য নিয়ে নির্ভরতার হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল মলিন ভাবনার জঞ্জাল। নিজের বুকে বপন করে নিল বজ্র-বিদ্যুতের মতো জ্বলে ওঠার বীজ। সামনে এসে দাঁড়ানো পাহাড়সমান সম্ভাবনার উঁচু মিনার দেখতে পেল রুস্তম। ওই মিনারে দাঁড়িয়ে ধুয়ে নেবে সে নিজস্ব দৈন্যতা ভেবে এগোতে থাকল দৃপ্ত পায়ে। বধূকলির জন্য হাহাকার জেগে উঠলেও এ মুহূর্তে পুরো সত্তা দখল করে নিল দুবাই কলি। আলো ঝলমলে সুড়ঙ্গপথ পেরিয়ে ঢুকে গেল অন্দরমহলের করিডরে। লম্বা করিডরের দু’পাশে খোলা প্রাঙ্গণ। ময়দানের মতো বিরাট প্রাঙ্গণের চারপাশজুড়ে রয়েছে খেজুর গাছের সারি। প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় ঝুলে আছে হলুদরঙের খেজুরের ঝাড়। মাটি থেকে কাণ্ডের উচ্চতা তিন থেকে চারফুট হবে। খেজুরের মাথার ঝাঁকড়া পাতাগুলো চারপাশে বাহুবিস্তার করেছে সাগর পাড়ে বিশ্রামের জন্য বসানো খোলা ছাতার মতো। গাছে গাছে পানি সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও ময়দানের সেন্টারে রয়েছে ঝরণাধারা। পানি প্রবাহ আকাশের দিকে অন্তত পঞ্চাশ ফুট উপরে উঠে খোলা ছাতার মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশে। জলের ছাঁট এসে লাগছে করিডরেও। এত বিস্তৃর্ণ হতে পারে কোনো অন্দরমহলের খোলা স্পেস, ধারণার বাইরে ছিল। বাইর থেকে বোঝার উপায় নেই। মরুর মেয়েরা অন্দরমহলে অন্তরীণ থাকলেও অবরুদ্ধ বলা যায় না। ইচ্ছা মতো ঘুরে বেড়ানো ও বিনোদনের নানা উপকরণ ছড়িয়ে রয়েছে পুরো প্রাঙ্গণজুড়ে। অন্তঃপুরের ময়দানে বসে যেমন কড়া রোদ ভোগ করা যাবে, তেমনি দেখা যাবে ভরাট পূর্ণিমার পূর্ণ জোছনা। দিনের আলোতে জোছনার ঢল না দেখা গেলেও কিছু দূর এগোনোর পর ডানে টার্ন নিয়ে ড্রেসিংরুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মুসলিম ফ্যাশনের আধুনিক ডিজাইনের ড্রেস পরা অপূর্ব এক কিশোরীকে। বাইরে বেরোনের জন্য যে ড্রেস পরে অন্তঃপুরে পরে অনেক সহজ ড্রেস। দেখল খোলামুখের ত্বক চুইয়ে ছিটকে বেরোচ্ছে জোছনার মতো আলো। মৃদু হাসি কেবল ঠোঁটেই লেগে নেই, ছড়িয়ে গেছে পুরো মুখে, দেহ-ভঙ্গিমায়। চোখও হাসছে। মুখ খোলা থাকলেও কালো রঙের স্কার্ফের একটি অংশ মাথার ডান পাশ ঘুরে ছড়িয়ে আছে বুকের ডান পাশে। মনে হচ্ছে কালো চুলের ছড়ানো একটা বেনি টেনে নামিয়ে দিয়েছে বুকের ওপর। পরনে লুজ ফিটিংয়ের বেগুনি রঙের শর্ট কামিজ। কোমর বরাবর বেল্টের মতো একটি ফিতা প্যাঁচিয়ে তলপেটের সেন্টার বরাবর গিঁট দিয়ে ফিতার বাড়তি অংশ ঝুলিয়ে রেখেছে সামনে। দুই উরুর মাঝ বরাবর নেমে এসেছে বেল্টের নিচের প্রান্ত। কালোরঙের টাইট ট্রাউজার আর কালো হাইহিল পরে সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি সম্বোধন করল, সøামুয়ালাইকুম! পরীর মতো মেয়েটির কণ্ঠস্বর চিনতে পারল রুস্তম। মসজিদ প্রাঙ্গণে কেবল চোখ দেখার সুযোগ ঘটলেও এ মুহূর্তে মুখ আর দেহের বাঁকগুলো দেখে মনে পড়ে গেল বাড়িতে রেখে আসা নববধূ কলির কথা। শাড়ি পরা বাংলাদেশের কলি আর এই কলির মধ্যে দুস্তর ব্যবধান থাকলেও মুখের লাবণ্য ও দেহকাঠামো একই রকম টানটান মনে হলো। নতুন ভাবনার কারণে মুখের অভিব্যক্তিতে ফুটে ওঠা ম্লানতা আচমকা সরে গেল। স্পষ্ট স্বরে কলি প্রশ্ন করল, আমি কলি। সালাম করেছি। জবাব পাইনি। জবাব দেবেন না? ঘাবড়ে গেছেন?
রুস্তম বলল, ওয়ালাইকুম সালাম।
কলি বলল, অন্দরমহলে প্রাঙ্গণে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
এক নগণ্য কর্মচারীকে স্বাগত জানাতে এসেছে এই দেবদূত? বিশ্বাস করতে দ্বিধা হলেও, বাধ্য হয়ে দেখল বাস্তবতা। কলি আর থেমে থাকেনি। স্বাগত জানিয়ে চট করে দেহ বাঁকিয়ে হাঁটতে শুরু করল উল্টো দিকে। দুবাই কলির পেছনের দেহকাঠামোর দিকে এক ঝলক দেখে চোখ নামিয়ে নিল রুস্তম। মুসলিম ফ্যাশনের নির্দিষ্ট ডিজাইন ও স্টাইল থাকলেও গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী মেয়েদের ড্রেসের রয়েছে ভিন্নতা। ভিন্নতা থাকলেও রয়েছে তিনটি সীমাবদ্ধতা, ইতোমধ্যে জেনেছে রুস্তমÑপ্রথম সীমাবদ্ধতা হলো পোশাকের প্যাটার্ন ও স্টাইলিংÑপা পর্যন্ত লম্বা ও লুজ ফিটিং ড্রেসে স্পষ্ট বোঝা যেতে পারবে না দেহকাঠামো বা ফিগার। এই রীতি পালন করা হয়নি। কলির দেহ কাঠামো পুরোটা ঢাকা নয়, বরং স্পষ্ট! দ্বিতীয় সীমাবদ্ধতার কথাও জানে রুস্তমÑ ফ্যাব্রিকেশন, কাপড় হতে হবে অবশ্যই ভারি, স্বচ্ছ নয়। কলির এই ড্রেসের ফ্যাব্রিকেশনে সীমাবদ্ধতা বজায় রয়েছে। তৃতীয় সীমাবদ্ধতা হলো রং নির্বাচনÑগাঢ় বা নিউট্রাল রঙের ব্যবহার চলবে না। উজ্জ্বল বা বাড়তি আকর্ষণ করবে, এমন রঙের ব্যবহার এড়িয়ে যাওয়ার বিধান থাকলেও নিয়মটি পালন করা হয়নি কলির পরনের বর্তমান ড্রেসে। নিয়মের শৃঙ্খলে বাঁধা থেকে নিয়ম ভেঙে চলতে পারে যে মেয়ে, সে তো দুর্ধর্ষ সাহসী হবেই, ধরে নিল রুস্তম। সাহসী মেয়েটির চোখে কী ধরা পড়েছে? তার মতো এত ছোট কর্মচারীকে কাছে ডেকে কী বোঝাতে চায় এই মেয়েটি, ভেবে কুল পেল না রুস্তম। এমন স্বপ্ন-ঝড়ের মধ্যেও বাস্তবতার চোখ ম্লান হয়নি ভেবে স্বস্তি পেল রুস্তম। ড্রেসিং রুমে ঢুকে পুরুষের জন্য ব্যবহারের একটা সাদা আলখেল্লা পরে সিøলিপার পায়ে নিজের হাতের যন্ত্রপাতির ব্যাগটা আলাদা একটা ব্যাগে ভরে লম্বা কেয়ারটেকার মেয়েটির সঙ্গে কলির হেঁটে যাওয়া করিডর ধরে এগিয়ে যেতে থাকল রুস্তম। নিজের জন্মের ব্লু-প্রিন্ট দেশের সবুজ মাটিতে রেখে এলেও বুকের ঘরে বসে যাচ্ছে নতুন ছাপ, নতুন জীবনের ব্লু-প্রিন্ট কি নির্মিত হচ্ছে? নাকি পইপই করে খসে যাচ্ছে পুরনো ব্লু-প্রিন্টের প্রতিটি রেখাচিত্র? তৃষ্ণা বেড়ে গেছে। গলা শুকিয়ে যাওয়ার কথা। শুকাচ্ছে না। তবে প্রবল তৃষ্ণায় কাতরাচ্ছে মন। আদিজল কি মিটিয়ে দিচ্ছে বর্তমান তৃষ্ণায় কাতর উষ্ণ লোহিত কণিকার গোপন জ্বালা! ভাইব্রেশনে রাখা মোবাইলসেটের কম্পনে ডান হাত ঢুকে গেল ডান পকেটে। সেট বের করে মনিটর দেখে চমকে উঠল রুস্তম। দেশের কলি কল করেছে! হতবিহ্বল রুস্তম মনিটরের দিকে তাকিয়ে সেট হাতে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। কল এ্যাটেন্ড করবে কি করবে না, ভাবতে ভাবতে প্রথম পালস কল শেষ হয়ে গেল। হাঁটার গতি থামল না। আবার কি কল আসবে? কল এলে ধরবেÑভাবতে ভাবতে দুবাই কলির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে রুস্তম। খোলা দরজার পর প্রশস্ত একটা ফাঁকা স্পেস। তার পরে রয়েছে আরেকটি দরজা। ওই দরজার মুখে দাঁড়িয়ে হাসছে দুবাই কলি! আশ্চর্য ! এই কলির মাথায় স্কার্ফ নেই। স্কার্ফ ছাড়া শর্ট কামিজের দুবাই কলির মুখে বসে আছে দেশের কলির মুখ! রুস্তম হতবিহ্বল! কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
দুবাই কলিই ভাঙল বিমূঢ় অবস্থা। বলল বাংলাদেশের রুস্তম, এখানে নয়, ভিতরে আসুন। এই যে বেডরুম আমার। বেডরুম সংলগ্ন বাথরুম ওই পাশে। বেডরুম অতিক্রম করে আপনাকে ঢুকতে হবে বাথরুমে। বাথরুমের বাল্ব জ্বলছে না। আপনার কাজ বাল্ব জ্বালিয়ে যাওয়া। বুঝেছেন? ঠিক না করলে ছাড়া পাবেন না। এই মুহূর্তে আমার রাজ্যে ঢুকে পড়েছেন আপনি। এখানকার বাদশাহ নামদার এখন আমি। আমার হুকুম ছাড়া কিছুই ঘটবে না। বাইর থেকে কেউ আমার বেডরুম মনিটর করবে না। কেয়ারটেকাররাও ঢুকবে না এই রুমে। সিসি ক্যামেরাও নেই। শব্দ ধারণ করার জন্য ওতপেতে নেই কোনো রেকর্ডিং সিস্টেম। আপনি কি বুঝতে পারছেন?
আদিজলে ভিজে গেল তৃষ্ণা। তৃষ্ণায় কাতর জলের মাছ ডাঙ্গায়ও পেয়ে গেল তৃষ্ণা মিটাবার সাহস। দুর্ধর্ষ তাড়না টের পেল ভেতর থেকে। এই দুর্বিনীত সময়েও আবার কেঁপে উঠল মুঠোফোন।
মনিটরের দিকে তাকিয়ে দেখল আবার কল করেছে দেশের কলি।
এটা কিসের সিগন্যাল? প্রশ্নের তীব্র টানে বুকের মধ্যে জেগে উঠল তপ্ত মরুর বালিময় চর। মুখের পেশিতে ভেসে উঠল আতঙ্কের ঝড়।
দুবাই কলি বলল, বারবার মুঠোফোন দেখছেন কেন? রিংটোন তো বাজতে শুনলাম না? সাইলেন্ট করে রেখেছেন?
না। সাইলেন্ট নয়, ভাইব্রেশনে আছে সেট।
কম্পনের হুশহুশ শব্দ শুনলাম না! ভাইব্রেশনেও তো শব্দ হয়।
হ্যাঁ। ভাইব্রেট হয়েছে। এখনো হচ্ছে! অনুভব করা যাচ্ছে দেহের স্পর্শে। হুশহুশ শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
দুবাই কলি বলল, দরজা থেকে ভেতরে ঢুকুন, আমার নাগালে আসুন। সেটটি দিন আমার হাতে। দেখি কে কল করেছে?
চট করে সেট পকেটে চালান করে দিয়ে রুস্তম বলল, থাক। আপনার দেখতে হবে না।
শুনুন বাংলাদেশের রুস্তম। এই মুহূর্তের বাদশাহ নামদার ইচ্ছা করেছে সেট দেখারÑকে কল করেছে, জানার ইচ্ছা পোষণ করেছে। তার ইচ্ছা অপূর্ণ করলে কী সাজা হতে পারে, জানেন?
দুম করে যেন আকাশ থেকে পাতালে পড়ে গেল রুস্তম। আইন অমান্য মানেই ভয়ঙ্কর শাস্তিÑমনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদিজলে ভাটির টান খেল। এবার তৃষ্ণায় নয়, ভয়ে শুকিয়ে গেল গলা। নিজের নৈতিকতার দেয়ালে ফাটল টের পেল। এই ফাটল দিয়ে ঢুকে যেতে পারে কোনো সিঁদেল চোর। নিদেনপক্ষে কোনো তুচ্ছ পোকামাকড় কিংবা মাছির দল। দূষিত করে কি দেবে দৃঢ়তার ভিত?
আপনি ভয় পাচ্ছেন। ভীত রুস্তমকে দেখতে চাই না। দেখতে চাই সাহসী রুস্তমকে। বুঝেছেন?
কথা ও প্রশ্ন শুনে ভীতি আরও বেড়ে গেল, পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল রুস্তম।
আমার ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে না। সহজ হোন। ইচ্ছা পূরণ করুন।
এবার খুলে গেল অদৃশ্য শিকলে আটকে পড়া পায়ের বাঁধন। নিজের মুঠোফোন তুলে দিল দুবাই-কলির হাতে।
সেট হাতে নিয়ে দুবাই কলি বলল, এখন তো কাঁপছে না সেট!
কেঁপেছে। থেমে গেছে কম্পন। আবার কল এলে কাঁপবে?
(চলমান)

No comments

Powered by Blogger.