দি আর্টিস্ট

আসা যাওয়ার পালা বদলে রাজা কখন পথে নামবে আর পথের পথিক কখন রাজ প্রসাদে জায়গা পাবে তা অনুমান করে বলা গেলেও তা দেখানোটা বেশ কঠিন।
অথচ সেই কঠিন কাজটিই অল্প কিছু জাম্প কাট শটের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন দি আর্টিস্ট ছবির পরিচালক মিশেল হাজানাভিসাস। গ্লাসের শেষ হুইস্কিটুকু গলায় ঢালতে যেয়ে জর্জ ভ্যালেনটিন দেখে গ্লাস শূন্য। ফ্রিজ খুলে বোতল থেকে হুইস্কি ঢালতে যেয়ে দেখে বোতল শূন্য। বোতলকে ডাস্টবিনে ফেলতে যেয়ে দেখে ডাস্টবিন খালি বোতলে পূর্ণ। দর্জির কাছে প্রিয় পোশাক এবং সেরা জুতা বিক্রি করতে গেলে দর্জিওয়ালার বেশি ডলার দেবার ব্যাপারে চূড়ান্ত কার্পণ্য। অনিচ্ছ্বা সত্ত্বেও বিক্রি করতে বাধ্য হওয়া। ঘরের দামী আসবাবপত্র, দেশ-বিদেশের নানান উপহার সামগ্রী, তেল রঙে আঁকা নিজের ছবি সবই নিলামে তুলে বিক্রি করা। স্ত্রীর অবর্তমানে দেখাশোনা করে যে ক্লিফটন তার বেতন এক বছর দিতে না পেরে তাকেও অব্যাহতি দেওয়া। কোটি কোটি ভক্তের এক সময়ের হৃদয়মণি জর্জ ভ্যালেনটিন আজ এক ছোট্ট কামরায় অবহেলা আর অনাদরে একা শুধু একা। পরিচালক মিশেল হাজানাভিসাস সামান্য কিছু শটের মধ্যে দিয়ে নান্দনিকভাবে দেখিয়েছেন, তারকালোকের তারকা আজ মর্ত্যরে ধূলিতে ধুলায় মিশে দেউলিয়া।
দেউলিয়া হোক কিংবা অগাধ সঞ্চয় হোক একজন শিল্পী তা মেনে নিতে পারেন। কিন্তু যেটা মেনে নিতে পারেন না সেটি হলো জীবদ্দশায় শিল্প নির্মাণ থেকে অবসর। অথচ জর্জ ভ্যালেনটিনের জীবনে আজ তো সেই বাধ্যতামূলক অবসর। অভিনয় জানেন কিন্তু কোথা থেকেও অভিনয়ে ডাক নেই। নির্দেশনা দিতে জানেন কিন্তু তার নির্দেশনার কারও প্রয়োজন নেই। প্রযোজনা করার মানসিকতা আছে কিন্তু এক পেগ হুইস্কি নগদ কিনে খেতে যিনি অপারগ তিনি প্রযোজনা করবেন কিভাবে। অথচ জর্জ ভ্যালেনটিনের আস্ত জীবনটাই তো সেলুলয়েডের ফিতায় ফিতায় নিবেদিত। প্রজেক্টরের মধ্যে দিয়ে সেলুলয়েডের ফিতার রিফ্লেক্টই তো তার আলো আঁধারী জীবন। যে সেলুলয়েডের জন্যে এই জীবন, সেই জীবন থেকে সেলুলয়েডের যদি দূরে সরে রাখে তবে এত যতœ মমতা দিয়ে ক্যানের মধ্যে সেলুলয়েডকে সন্তান জ্ঞানে বাঁচিয়ে রাখার আর কি প্রয়োজন। ওরে সেলুলয়েডের দল তোরা বেঁচে থাকা মানে আমার দিকে তাকিয়ে নানান ভঙ্গিমায় উপহাস করা। আমি এত বড় ঠাট্টা আর সহ্য করব না। হয় তোরা থাকবি নচেৎ আমি থাকব। আমার জীবন থেকে চলচ্চিত্র শূন্য করতে যা যা লাগবে আমি তার সবই করব। সবাকের সাথে নির্বাক হয়ে যুদ্ধে টিকে থাকতে পার না আবার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে টিনের ক্যানের মধ্যে জামাই আদরে আয়েশ করে পাস ফিরে ঘুম পাড়া ঘুম আমি তোমারে পাড়াচ্ছি। এমনভাবে ছিঁড়ব না সেলুটেপের বাবারও সাধ্য নেই তোমাদের জোড়া দেয়। এই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কর্তাব্যক্তিরা আমার ওপর যে নৃশংস আচরণ করেছে তার বদলা আজ আমি তোদের ওপর দিয়ে দেব। দাঁড়া, নড়বি না, আমি আগে দেশলাইটা আনি। আজ আমি তোদের পুড়িয়ে মারব...। আক্রোশে জ্ঞান হারিয়ে অভিনেতা ক্যানে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনের দাবানাল যখন ঘরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে তখন সম্বিৎ ফিরে পায় জর্জ ভ্যালেনটিন। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সদ্য আগুন লাগা একটি ক্যানের পরে। বুক পিঠ দিয়ে আগুন নেভাতে থাকে। কিন্তু ঘরভর্তি আগুনের ধোঁয়ায় জর্জ ভ্যালেনটিন জ্ঞান হারায়, বুকে তখনও দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেলুলয়েডের ক্যানটি। জর্জ ভ্যালেনটিনের পোষ্য কুকুর জ্যাকের বুদ্ধিমত্তায় জর্জ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে জায়গা করে নেয় হাসপাতালের বিছানায়। দুর্ঘটনার কথা শোনা মাত্র শূটিং স্পট ফেলে হাসপাতালের উদ্দেশে অভিনেত্রী পিপি মিলার কিছুটা স্বস্তিতে কিন্তু বিস্ময় হসপিটালের রোগীর বিছানায় পাশের টেবিলে সেলুলয়েডের ক্যান দেখে। সেলুলয়েডের রিল দেখে পিপি মিলার নিশ্চিত এটি সেই চলচ্চিত্র যার নাম এ জার্মান এ্যাফেয়ার, যেখানে জর্জের কারণে জর্জের সাথে তার প্রথম অভিনয়। অসংখ্য চলচ্চিত্রের ক্যানের মাঝ থেকে রক্ষার প্রশ্নে এ জার্মান এ্যাফেয়ার ক্যান। তবে কি জর্জ ভ্যালেনটিন আজও তাকে সেই প্রথম দিনের মতো ভালবাসে। নানান ভাবনায় পিপি মিলারের মনের মাঝে যখন ভ্রমণের গুঞ্জন তখন ডাক্তার বলে, জর্জ ভ্যালেনটিন অজ্ঞান তথাপি তার বাহুবন্ধন থেকে ক্যানটিকে মুক্ত করতে আমাদের অনেক জোরে টানতে হয়েছে। ডাক্তারের কথায় পিপি মিলারের ঠোঁটের কোনায় লুকানো হাসি। অভিব্যক্তিতে উদ্ভাস, লোকে একেই তো বলে প্রেম। ডাক্তারের কাছে পিপি মিলারের সবিনয় নিবেদন, রোগীকে কি এখন আমি আমার বাড়িতে নিয়ে তুলতে পারি। বৃদ্ধ ডাক্তারের মনস্তাত্ত্বিক উত্তর, নাও না। অভিমানী জর্জ ভ্যালেনটিনকে নিয়ে সুহৃদয়া পিপি মিলার ঘরে ফেরে।
ঘরে ফেরার আনন্দ পূর্ণতা পায় যখন জর্জ ভ্যালেনটিনের জ্ঞান ফেরে। বিস্ময়ের ঘোর কেটে জর্জ ভ্যালেনটিন দেখে বুকের পাশে পিপি মিলার।
অভিনেত্রী হিসাবে নিজেকে পরিচালকের কাছে সমর্পণ করেছি বলে অভিনেত্রীর নিজস্ব কোন বক্তব্য থাকতে পারবে না সেটা মানতে না রাজি অভিনেত্রী পিপি মিলার। পরিচালক আলজিমারের কাছে তার সাফ কথা, হয় স্পাকলি অব লাভ চলচ্চিত্রে নায়ক চরিত্রে আপনি অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনকে নেবেন নতুবা নায়িকা হিসেবে আপনি আমাকে হারাবেন। হয় আমরা যুগ্মভাবে জুটি হব নয়তো চলচ্চিত্র জগতকে বিদায় জানিয়ে ঘরে বসে নিত্যনতুন রান্না করে টাটকা খাব। প্রযোজক পরিচালক আলজিমার যতই বলে, জর্জ ভ্যালেনটিনকে মানি নির্বাক চলচ্চিত্রের রাজপুত্র কিন্তু এই সবাক চলচ্চিত্রে তাঁর অস্তিত্ব তো শূন্য। শূন্যকে নিয়েতো পুণ্যের খেলায় মাততে পারি না। পিপি মিলারের দৃঢ় বক্তব্য, কে শূন্য আরকে পুণ্য তা আমার বিবেচ্য না। জানি আমি আপনার ব্যবসার পুঁজিতে কতটা মূল্যবতী অন্তত বর্তমান এই সময়ে। ব্ল্যাকমেইল করা বলুন অথবা তুরুপের তাস ভাবুন কথা আমার স্পষ্ট, আমাকে পেতে হলে জর্জ ভ্যালেনটিনকে সাথে নিয়েই আপনাকে পেতে হবে। পিপি মিলারের কথা শুনে প্রযোজক-পরিচালক আলজিমারের অভিব্যক্তি, কত মেয়েকে দিয়ে অভিনয় করিয়ে কত চরিত্রকে যে জীবন্ত করে তুললাম এই জীবনে তার ইয়াত্তা নেই। কিন্তু আজ এই পড়ন্ত বেলায় এসেও এটা বুঝতে পারলাম না মেয়েদের কোনটি আসল চরিত্র। মোহিনী নাকি মোহের বিনাশিনী। অভিনয় শিল্পী নাকি বাস্তববাদী। জল না আগুন। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের কোন হিসেবেই যখন সম্যসার সমাধান মিলল না তখন আলজিমারের নির্দেশ, স্ক্রিপ্ট পাঠাও জর্জ ভ্যালেনটিনের কাছে, পিপি মিলারকে ক্ষেপিয়ে মাঝপথে কাজ বন্ধ রেখে হাত পা গুটিয়ে বসে বসে ভাবনা করার কোন মানে নেই। আলজিমারের পরিবর্তনে পিপি মিলারের আনন্দ আর ধরে না। সত্যি সত্যি জর্জ ভ্যালেনটিনের সাথে আবার অভিনয় করা হবে। পিপি মিলার শূটিং প্যাকআপের আগেই লোক মারফত স্ক্রিপ্ট পাঠায় জর্জ ভ্যালেনটিনের হাতে। স্ক্রিপ্ট হাতে পেয়ে থমকে পুনঃ নড়েচড়ে বসে জর্জ ভ্যালেনটিন।
চলচ্চিত্রের শেষের এই জায়গায় এসে দি আর্টিস্ট চলচ্চিত্রের পরিচালক মিশেল হাজানাভিসাস তাঁর সর্বোচ্চ শক্তি, মেধা-মনন এবং অনুভূতি নিয়ে যে কোন মাধ্যমের শিল্পী তথা ক্রিয়েটারদের মনন খনন করে তলের অতলে লুকিয়ে থাকা আত্মার ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন আবেগ এবং যুক্তির যুগ্ম মিশেলে। কথা তো সত্য বাইরে থেকে পাথরে জমা আগুন চক্ষুষ্মান হয় না। দূরদৃষ্টি বলে পাথরকে পাথর দিয়ে আঘাত কর, তবে আগুন ছিটকে বের হবে। পাথরের খ- কিংবা এঁটেল মাটির দলায় মূর্তি থাকে না, মূর্তি থাকে ভাস্কর কিংবা পালের কল্পনায়। কারিগরের হাতে পরে পাথর কিংবা মাটি মূর্তির আদল পায়। প্রকৃতির আবেশ কবির কল্পনায় জারিত হয়ে কাব্যের রূপ পায়। সমস্ত কাব্য, গল্প, উপন্যাস, চিত্রাঙ্কন প্রভৃতি একইভাবে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর প্রভৃতি নির্মাতাদের হাত হয়ে রূপান্তরিত হয় নবজন্মে ভিন্ন সময়ে ভিন্ন নামে। দক্ষ নির্মাতা যে বিন্দুর মধ্যে দিয়ে আস্ত সিন্দু দেখায় সেটা দেখতে পারে সে তার অদ্ভূত কল্পনা শক্তির সুনিপুণ প্রয়োগে। ফলে বিন্দু নির্মাণে শিল্পীরা ততটাই স্পর্শকাতর হয় যেমনিভাবে সামান্য স্পর্শে লজ্জ্বাবতী গাছের পাতা শিহরিত হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ব্যাধের হাতে যুগল পাখীর একটির মৃত্যু এবং অপরটির বিলাপ চাক্ষুস করে তাই মহাকবি বাল্মীকি লিখে ফেলতে পারে মহাকাব্য রামায়ণ যেখানে শেষ পরিণতি সীতার পাতাল-প্রবেশ এবং রামের আর্তনাদ। এই যে শিল্পীর বেড়ে মহীরূহে পরিণত হয় তার কারণ তার কল্পনায় ঘটনার ঘাত কিংবা প্রতিঘাত। ঘটনা ভাল হোক কিংবা মন্দ হোক দুটোই তাকে সমপরিমাণে আন্দোলিত করে এবং এই আন্দোলিত অনুভূতির তারতম্যের ব্যবধানে নির্মিত শিল্পের অস্তিত্ব হয়ে দাঁড়ায় ক্ষণকালের কিংবা মহাকালের। অভিমানে, আক্রোশে অভিনয় জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন আজ আবার সেই আন্দোলিত অনুভূতির খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে।
কি হলো! একদিন মতামত নিয়ে বনিবনা হলো না বলে যে আমাকে ছিটকে যেতে হলো কিনোগ্রাফ স্টুডিও থেকে, পরিচালক আলজিমারের পাওয়ার পেলের কারণে আমার স্থান হলো রাজপ্রাসাদ থেকে নোংরা ডাস্টবিনে ভরা ফুটপাতে, সেই আমাকে আজ আবার স্ক্রিপ্ট পাঠায় কিনোগ্রাফ স্টুডিও, পরিচালক আলজিমারও। রেসের সেরা অশ্বারোহী হয়ে সেদিন ডাক পেলাম না অথচ আজ হলিউডের অভিনয় জীবন থেকে সরতে সরতে খাদের কিনারা থেকে পিছলে পড়ে যখন পাতালের পূতিগন্ধময় অন্ধকার কোঠরে তখন আবার আমায় ডাক। আমায় তো আমার অভিনয় দক্ষতার গুণে ডাকেনি কিংবা আমার অবর্তমানে কিনোগ্রাফ স্টুডিও দেউলিয়া হয়েছে অথবা পরিচালক আলজিমার একটার পর একটা ফ্লপছবি নির্মাণ করে বাজার মূল্য হারিয়েছে। তবে আবার আমায় ডাকল কেন। সেকি এ কারণে যে আমার হয়ে অভিনেত্রী পিপি মিলার সুপারিশ করেছে। একটা পরিত্যক্ত, অযোগ্য, অক্ষম অভিনেতাকে যদি যৎসামান্য কাজ পাইয়ে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আরে আমি কি পাগল হয়ে গেলাম। একদিন ঐ আলজিমারের রোষানল থেকে বাঁচিয়ে এই আমি যাকে অভিনয়ের সুযোগ করে দিয়েছিলাম আজ তার দয়ায় আবার আমাকে অভিনয় জগতে ফিরতে হবে। দুধের হাঁড়িতে আগুনের তাপ লাগলে দুধ যেভাবে উতলে ওঠে ঠিক তেমনিভাবে তাচ্ছিল্যের অপমানে অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন যখন পিপি মিলারের ঘরে গিয়ে দেখে সাদা থান কাপড়ে ঢাকা নিলামে ওঠা জর্জ ভ্যালেনটিনের সব মূল্যবান সামগ্রী। আসবাবপত্র, অমূল্য সংগ্রহ, এমনকি তাঁর নিজের পোর্ট্রেট। এর মানে কি হলো। অত অত কি ডলার খরচ করে সামগ্রীগুলো যারা কিনল তারা কেউই আমার ভক্ত না। আমার কোন মূল্য আমার অনুরাগীর কাছে নেই। স্রেফ দুটো ডলার পাইয়ে দিতে পিপি মিলারের দয়া। আরে মেয়ে তুমি তাহলে আমাকে দয়া করলে উপকারের প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে। আজ নিজের অর্থে হুইস্কি কেনার সামর্থ নেই বলে প্রযোজক -পরিচালককে বলে কয়ে একটা কাজ পাইয়ে দিলে। না না কাজটা তুমি ভাল করলে না মেয়ে। হ্যাঁ, আমি অভিনেতা। আমি জানি কিভাবে লোককে হাসাতে হয় আবার কাঁদাতে হয়। তুমিও আমার সাথে অভিনয় করলে। দাক্ষিণ্য, দয়া। আহারে এত লাঞ্ছনা-বঞ্চনা-হতাশার মাঝেও বাঁচার একমাত্র অবলম্বন ছিলে তুমি মেয়ে পিপি মিলার, তুমি। সেই তুমিও আমার সাথে নাটক করলে। সান্ত¡না পাইয়ে দিতে তোমার এত ছলা-কলা। আমায় তুমি দয়া কর। আমি দয়ার পাত্র। কিন্তু শোন মেয়ে, আমি অভিনেতা। আমি জর্জ ভ্যালেনটিন। একদিন যদি কোটি দর্শকের হৃদয়ে আমি নিজেকে বসিয়ে থাকতে পারি, তবে এও পারি সবার চোখের সামনে থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে আজীবনের মতো নিরুদ্দেশ হতে। আমার জীবদ্দশায় তুমি যখন আমাকে বাধ্যতামূলক দয়া করেই ফেললে তবে আমি তোমাকে দয়ার প্রতিদান দিয়ে যাচ্ছি। আমি ঠিকই তোমার সামনে থাকব এবং এমন অবস্থায় থাকব যে অবস্থা থেকে তুমি, তোমার সমস্ত ঐশ্বর্য নিয়েও আমার বিন্দু পরিমাণ কাজে লাগতে পারবে না। তোমার সমস্ত কিছু থাকা সত্ত্বেও তুমি আমার ব্যাপারে করণীয় ক্ষেত্রে যে বাধ্যতামূলক নিরূপায় হবে, সেই উপলব্ধিটা তোমাকে পাইয়ে দেয়াটাই হবে আমার তরফ থেকে তোমাকে দয়া। পিপি মিলারের বাড়ি থেকে বিদ্যুতগতিতে নিজের ঘরে ফিরে বাক্স খুলে হাতে তুলে নেয় জর্জ ভ্যালেনটিন তার অতি প্রিয় আদরের লাইসেন্স করা ছোট্ট পিস্তল। পিস্তলের বুলেটের গতি থেকে আরও দ্রুতগতি সম্পন্ন মানুষের মন। ঘরে ফেরা মাত্রই পড়ে থাকা ব্যান্ডেজের কাপড় দেখেই পিপি মিলার বুঝে যায় ধাবমান গতিতে এগিয়ে আসা আশঙ্কার ইঙ্গিত। সাধারণ মানুষের কাছে যেসব অনুভূতি স্বাভাবিক আবেগ, একজন শিল্পীর কাছে তা অনেক অর্থপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। একজন শিল্পীই বুঝতে পারে অপর শিল্পীকে। উপরন্তু হৃদয়ের ব্যাকুলতা বলে কথা। নষ্ট করার মতো সময় নেই। পিপি মিলারের হাতে। সামান্য বিলম্বে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবার সম্ভাবনা। তাই যে পিপি মিলার জীবনে কখনও গাড়ী চালায়নি, শুধু জানে গাড়ি স্ট্রার্ট দিতে আর বন্ধ করতে এবং না বুঝে স্টিয়ারিং ঘোরাতে, সেই পিপি মিলার ড্রাইভারের দেরি দেখে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। হৃদয় যেখানে ব্যাকুল সেখানে বিপদ সঙ্কেতের কথা ভাববার অবকাশ নেই। মরমীয়া মনে পিপি মিলার ছুটতে থাকে তার হৃদয়ের জর্জ ভ্যালেটিনকে বাঁচাতে।
বাঁচা-মরার দ্বার গোড়ায় জর্জ ভ্যালেটিন। কুকুর ছানা জ্যাক মনিবকে বাঁচাতে প্যান্ট ধরে টানছে। কিন্তু নিরুত্তর জর্জ ভ্যালেটিন। অবশেষে পিস্তল তাক করে মুখের মধ্যে। মুখের অভিব্যক্তিতে সমস্ত ভয়কে জয় করতে চাওয়ার তীব্র চেষ্টা। এবার ট্রিগার টেপার পালা। জর্জ ভ্যালেটিন আস্তে আস্তে ট্রিগারে আঙ্গুল রাখে। ওদিকে গলার দড়ি ছুটলে গরু যেভাবে দিগি¦দিক জ্ঞান হারিয়ে দৌড়াতে থাকে অনেকটা সেভাবে গাড়ি চালিয়ে পিপি মিলার প্রায় জর্জ ভ্যালেটিনের বাড়ির কাছে। জর্জ ভ্যালেটিন যেইমাত্র ট্রিগারে টিপ দিতে যাবে অমনি পিপি মিলারের গাড়ি সজোরে ধাক্কামারে জর্জ ভ্যালেটিনের বাড়ির সামনের দিকে। কি হলো বাড়ির সামনে কি মিসাইল রকেট পড়ল, এত যে শব্দ। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে জনালা খুলে শব্দের উৎস খোঁজে জর্জ ভ্যালেনটিন। ঠিক তখনই দরজা ঠেলে প্রবেশ করে অশ্রু নয়না পিপি মিলার। বিস্মিত জর্জ ভ্যালেনটিন। পিপি মিলার বলে, সত্যিই আমার খারাপ লাগছে। এটি নিদারুণভাবে আমাকে আহত করা। কোন দান প্রতিদানের প্রশ্ন না। যে স্নেহ ভালবাসা আমি আপনার কাছ থেকে পেয়েছি সেখান থেকে চেয়েছি আপনাকে সুখী দেখতে। প্রতিটি মুহূর্ত অপেক্ষায় থেকেছি আপনাকে সেবা করার সুযোগ পেতে। আপনাকে দেখেশুনে রাখতে। ভালবাসার মানুষটিকে আগলে রাখতে চাওয়াটাকি অপরাধ জর্জ ভ্যালেনটিন। আমার অপরাধ! যে মানুষ টিয়ার্স অব লাভ বানিয়ে ভালবাসার অশ্রু নিজে দেখে আবার দর্শককে দেখায় তার মুখে প্রতি উত্তরে আর কি কথাই বা আসতে পারে। আর তাই উভয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়ে হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে হৃদয়ের কথা বলে।
কথার পিঠে কথা বলে পিপি মিলার। জর্জ একমাত্র তুমিই আমাকে সাহায্য করতে পার। অভিনয় করে তুমিই পার ইন্ডাসট্রিতে আমার বলা কথাকে অর্থবহ করে তুলতে। প্রতি উত্তরে জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, পিপি সেটি অসম্ভব। আমি শেষ হয়ে গেছি। কেউই আমার কথা, অভিনয় দেখতে শুনতে চাইবে না। সঙ্কটকে সম্ভাবনায় নিয়ে যাওয়ার বিশ্বাসে বিশ্বাসী পিপি মিলার বলে একটাই মাত্র পথ খোলা আছে যেখানে তোমার কথা বলা লাগবে না অথচ অভিনয় করা চলবে। সেটি হলো আইটেম ড্যান্স। এই একটি মাত্র পথে চল আমরা দু’জনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমার যুবরাজ, আমার এই শেষ অনুরোধটুকু রাখ। চল আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি।
আর ঝাঁপিয়ে পড়া! আইটেম ড্যান্সে উভয়ের পারফরম্যান্স দেখার ঘোরে বিভোর হয়ে ডিরেক্টর ভুলেই গেছে ক্যামেরাম্যানকে বলতে, এখন কর কাট। নিরুপায় ক্যামেরাম্যান যখন ডিরেক্টরকে বলছে, স্যার কাট বলবেন না, তখন ডিরেক্টর আলজিমার বলছে, রাখ তোমার কাট। উচ্ছ্বাসের সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে পরিচালক আলজিমার অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিনকে বলছে, জর্জ তুমি কথা দাও এই স্পাকেল অব লাভ চলচ্চিত্রের পরের চলচ্চিত্রেও তুমি অভিনয় করবে, কথা দাও জর্জ কথা দাও। উচ্ছ্বসিত অভিনেতা জর্জ ভ্যালেনটিন বলে, কথা দিলাম। অভিনয় করাটাই আমার আনন্দের। জর্জ ভ্যালেনটিন এর নবজন্মে আন্দোলিত হয়ে বাহু বন্ধনে জর্জকে আগলে ধরে অভিনেত্রী পিপি মিলার। একঘণ্টা চব্বিশ মিনিট দৈর্ঘের চলচ্চিত্র আর্টিস্টে উচ্চারিত সংলাপ বলতে গেলে শেষ দু’মিনিটে। যখন আইটেম ড্যান্স শেষ হচ্ছে তখন। অনুচ্চারিত সব সংলাপ শোনার বদলে দেখছে সাব আইটেমের সুবাদে। এই উচ্চারিত অনুচ্চারিত সংলাপে ভরা আর্টিস্ট চলচ্চিত্রটি হয়ে থাকল ইতালির চলচ্চিত্র সিনেমা প্যারাডিসোর মতো। চলচ্চিত্র নির্মাতাদের নির্মাণের স্বার্থে পরিচালকের পথচলার চলচ্চিত্র সিনেমা প্যারাডিসো যে কারণে দেখতেই হয় ঠিক তেমনিভাবে সবার বিশেষ করে চলচ্চিত্র অঙ্গনের কর্মী এবং অনুরাগীর অবশ্য দেখার চলচ্চিত্র ফ্রান্সের চলচ্চিত্র দি আর্টিস্ট। আর্টিস্ট চলচ্চিত্রের শেষ মিনিটে জর্জ ভ্যালেনটিনের আইটেম ড্যান্সের ঝলক রোশনাই দেখে যেমন সমস্ত শূটিং ইউনিট বলে ওঠে, তার ক্ষেত্র পৃথিবী জুড়ে। ঠিক তেমনি যেকোন চলচ্চিত্র অনুরাগী আর্টিস্ট চলচ্চিত্রটি দেখলে তার মনে হতেই পারে পরিচালক মিশোল হাজানাভিসাস আর্টিস্ট নির্মাণ করেছেন তারই জন্য। তাঁর এবং তাঁর মতো সকলের জন্য আর্টিস্ট চলচ্চিত্রের ক্ষেত্র সারা পৃথিবীতে।

No comments

Powered by Blogger.