ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থানের কথা by তোফায়েল আহমেদ

আজ ২৪ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। বাঙালী জাতির বীরত্ব আর সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৬৯-এর এই দিনে উত্তাল সংগ্রামের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল তা কখনও মন থেকে মোছা যায় না।
ক্ষমতার মদমত্তে অহঙ্কারের পাহাড়ে বসে স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মনে করেছিল জনগণ বোবা দর্শক, আর তার মসনদ চিরস্থায়ী। তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিন বিক্ষুব্ধ বাংলার মানুষ দ্রোহের আগুনে এতটাই জ্বলে উঠেছিল যে, গণঅভ্যুত্থানের পথে আইয়ুব খানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় জানায়। আর কৃতজ্ঞ জাতি মুক্ত করে আনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে। আমাদের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে রক্তে লেখা আত্মদান আর বিজয়ের গৌরব। আমাদের ইতিহাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের জেল-জুলুম আর নির্যাতন ভোগের ক্ষতচিহ্ন। সুদীর্ঘ সংগ্রামের রক্তে ভেজা লড়াই-সংগ্রামের আনন্দ-বেদনার স্মৃতিতে মোড়ানো আমাদের ইতিহাস। একদিনে আমরা কোন কিছুই অর্জন করিনি। রাতারাতি আকস্মিক ঘটনার মধ্যে আমাদের কোন অর্জনও নেই। রক্তের সিঁড়িপথে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে জনগণের শক্তিতেই আমাদের সব অর্জন। এ অর্জনের ইতিহাস রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস। রাজনৈতিক নেতৃত্বের জীবন ও যৌবনের ওপর নেমে আসা নির্যাতনের ইতিহাস। কত স্বজন, কত প্রিয় সহকর্মীর মুখ হারিয়েছি এ অর্জনের ইতিহাস নির্মাণে। কত মায়ের বুক খালি হয়েছে। ভাই হারানোর বেদনায় কত বোনের কান্না, সন্তান হারানোর বেদনায় কত মায়ের আর্তনাদ আর রক্তের সিঁড়িপথেই আমরা অতিক্রম করেছি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের গৌরবজনক অধ্যায়।
’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণঅভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভাল লাগে। সেদিনের উজ্জ্বল স্মৃতি আজ যখন চোখে ভাসে একটা কথা খুব মনে হয়, ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকরা যখন স্বৈরাচারী হয় তখন মনে করে ক্ষমতায় তারাই বোধহয় চিরস্থায়ী, আর বাকি সব কিছুই অস্থায়ী। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, সে ইতিহাসের কঠিন শিক্ষাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। জনতার ঐক্য যখন এক সুতোয় গাঁথা হয় তখন কোন অপশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ আর মর্মান্তিক, তেমনি জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম সত্য ও সুন্দর। সেজন্যই ইতিহাসে সত্যের জয় অনিবার্য। ’৬৯-এর ইতিহাসের এ পুনরাবৃত্তি এদেশে দেড় দশকে দু’বার ঘটেছে। ’৯০ এবং ’৯৬-এর সংগ্রামী শিক্ষা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাসের গতিপথে স্থান করে নিয়েছে।
’৬৮-এর ১৭ জানুয়ারি দু’টি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ওইদিন আমি ডাকসু ভিপি নির্বাচিত হই আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই সেবারের ডাকসু ঐতিহাসিক ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। ডাকসুসহ চারটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ঐকবদ্ধ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ’৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। লৌহমানব আইয়ুবের সামরিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে ’৬৯-এর ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। মনে পড়ে সেদিনের সেই গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের সহকর্মী, সহযোদ্ধাদের। আমরা একসঙ্গে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে সফল হয়েছিলাম। আমরা সমগ্র ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে গোটা জাতিকে ১১-দফার পতাকাতলে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। গৌরবময় আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের অন্যতম তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি প্রয়াত আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী; ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি প্রয়াত সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা; অন্য অংশের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ; এনএসএফ একাংশের সভাপতি প্রয়াত ইব্রাহিম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী এবং ডাকসু জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। সে সময়ের জাতীয় ও তরুণ নেতাদের অধিকাংশই ছিলেন কারাগারে। একজনের নাম বলতে হয় যিনি বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন, তিনি সিরাজুল আলম খান। সারা জীবনের জন্যই তার কাছে আমি ঋণী। ’৬৯-র সেই অগ্নিঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি ৫ শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও আইয়ুব বিরোধী যে আন্দোলন আমরা শুরু করেছিলাম, ১৮ জানুয়ারি সংগ্রামের স্রোতে সহস্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলÑ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, আইয়ুব খানের পতন চাই।’ ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমদের মিছিল বের হয়েছিল। ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সেই মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। প্রতিবাদে ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্র সমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠাঁই নেই, ঠাঁই নেই অবস্থা। গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলিবর্ষণ হলে আসাদুজ্জামান নিহত হয়। আসাদের লাল রক্তে ভেজা শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। এখনও বনানীর বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করে সেই শার্ট দিয়ে তৈরি পতাকার ছবিতে যখন চোখ আটকে যায়, যেন নতুন সংগ্রামের উদ্দীপনা পাই। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে শহীদ আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র। যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আপোসহীন সংগ্রামের শপথ নিতে এসেছে সবাই। মওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতাও এসেছেন জানাজায়। ডাকসু ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিনদিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালোব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশাল মিছিল আর ২৪ তারিখ ২টা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা উড়লো। সে এক অসাধারণ দৃশ্য। শোক নয় যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল ঢাকা নগরী। একজন মানুষও ঢাকায় দেখা গেল না যার বুকে শোকের চিহ্ন কালোব্যাজ নেই। ২৩ তারিখ ঢাকা নগরী মশাল আর মিছিলের নগরীতে পরিণত হলো। প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠল ঢাকায়। ২৪ তারিখ হরতালের সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এলো রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল নগরী। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ হল। পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র মতিয়ুরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তমসহ চারজন নিহত হয়। লাশ নিয়ে বেলা ১২টার দিকে পল্টনে যাই। সর্বত্র এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিগর্ভ ঢাকার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন জ্বালানো হয়। এমএনএ এনএ লস্করের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এসএ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পালালেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশসহ সবাইকে নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের মাঠে চলে আসি। বিকাল ৩টার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা নিয়ে আসত। এখনও ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা যোগায়, তেমনি মতিয়ুরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারি হয়ে আসে। মতিয়ুরের বুক পকেটে পাওয়া চিরকুট নিয়ে দেখলাম, লেখা আছে- “মা, তুমি মনে করো তোমার মতিয়ুর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি-মতিয়ুর রহমান, ১০ম শ্রেণী, পিতা আজহারউদ্দিন মালিক, নবকুমার ইনস্টিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।” সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিয়ুরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় তা হৃদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিয়ুরের মা আমাদের বলেছিলেন, “আমার সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।” ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিয়ুরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। এদিকে ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনের সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় একটানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে এই সেøাগানে ইতি টানি “শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব, শপথ নিলাম, শপথ নিলাম মাগো তোমায় মুক্ত করব।” মণি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আব্দুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন কারাগারে। ছাত্র-জনতার বুকের আগুনে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে তাই সবাই ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। আজও সেসব স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ‘ডাক’-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিন বঙ্গবন্ধু আমায় দেখতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে দেখা করাতে নিয়ে যান। মাজদা গাড়ি ড্রাইভ করেছিল শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনও বুক ভরে যায়, দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হৃদয়পট জুড়ে। বিকেলে ডাকের জনসভায় গেলে সভাপতি পদে নুরুল আমিনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা প্রত্যাখ্যান করে। সংগ্রামী জনতা আমার নাম ধরে সেøাগান দিতে থাকে। তখন আমাকে মঞ্চে নেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করে বলি, শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের প্রিয় নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক, ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুর নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি আবার সান্ধ্য আইন জারি হয়। এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা নিহত হন। ২০ তারিখ সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগরী হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ তারিখ আবার পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে সরকারের উদ্দেশে আল্টিমেটাম দিয়ে বলি, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে। ভাবতে কত ভাল লাগে আমাদের বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে অর্থাৎ ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দির মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখ লাখ জনতা তখন ছুটে যায় পল্টনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিক্ষা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ধানম-ির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িটিতে নিয়ে যাই। পরে পল্টনে অধীর আগ্রহে থাকা জনতার স্বতঃস্ফূর্ত সমাবেশে পৌঁছে বলিÑআজ নয়, ২৩ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে। সেদিনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছিল জনতার বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সভায় সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হৃদয়ের গভীর থেকে উচ্চারণ করি, “যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে। ফাঁসির মঞ্চে বাঙালীর মুক্তির কথা বলেছেন, সে নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পক্ষ থেকে একটি উপাধি দিতে চাই। ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। কৃতজ্ঞচিত্তে সেদিন জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধু মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে আমরা মুক্ত করেছি। অতঃপর ’৭০-এর নির্বাচনে বাংলার মানুষের গণরায় নিয়ে ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জাগো জাগো, বাঙালী জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’Ñহৃদয় উজাড় করা সেøাগানে নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করি।

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
ঃড়ভধরষধযসবফ৬৯@মসধরষ.পড়স

No comments

Powered by Blogger.