একটি মৃতু্য এবং কয়েকটি প্রশ্ন- পিন্টু রঞ্জন অর্ক

আবারও মৃতু্যকালিমায় কলঙ্কিত হলো আমাদের ক্যাম্পাস। ছাত্রলীগের দুই পরে 'ক্রসফায়ারের' বলির পাঁঠা হলেন অদম্য মেধাবী আবু বকর। এই সন্তানকে ঘিরে তাঁর দিনমজুর পিতা-মাতা যে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন,
একটি টিয়ার শেলের (অথবা বুলেটের) আঘাতে তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেল। আরও একটি মৃতু্য, আরও একটি তদনত্ম কমিটি, দেয়া হবে আরও একটি তদনত্ম প্রতিবেদন। আমাদের প্রশ্ন, আলোর মুখ দেখবে কি এসব প্রতিবেদন? নাকি গতানুগতিক ধারায় ফাইলের নিচেই চাপা পড়ে থাকবে? আর কত আবু বকর পড়তে এসে লাশ হয়ে ফিরে যাবে? আমরা হতাশ হই যখন দেখি, আবু বকরের মৃতু্য সংবাদ শুনেও অধিকাংশ শিকই নীরব ভূমিকা পালন করেন। শ্রদ্ধেয় শিক মহোদয় যাঁরা আমাদের আলোর পথ দেখাবেন, তাঁরাই জড়িয়ে পড়েন দলীয় লেজুড়বৃত্তিতে। তাহলে কি আমরা প্রতিবাদের ভাষাও ভুলে গেছি? আমাদের আরও বেশি অবাক করে, প্রশাসনের শীর্ঘ পর্যায়ে 'দায়িত্বশীল' পদে থাকা ব্যক্তিদের 'দায়িত্বজ্ঞানহীনের' মতো বক্তব্য। এ রকম মৃতু্যকে তাঁরা 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' হিসেবে অভিহিত করেন। আমাদের মনে আছে, বিগত জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাসীদের গুলিতে পিতার কোলে শিশু নিহত হওয়ার ঘটনায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন_ 'আলস্নার মাল আলস্নায় নিয়ে গেছে।' যার ফলে তার কী পরিণতি হয়েছিল, তা সকলেরই জানা। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি ভুলে গেছেন সেই কথা?
ছাত্র রাজনীতি কথাটি বিশেস্নষণ করলে দু'টি শব্দের দেখা মেলে : আগে ছাত্র, পরে রাজনীতি। কিন্তু বর্তমানে হচ্ছে এর উল্টোটাই। অথচ এই ছাত্র রাজনীতির অতীত ইতিহাস গৌরবময়। ১৯৫২'র ভাষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভু্যত্থান, '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ বহু আন্দোলন-সংগ্রামে সাফল্য লাভের মূলে ছিল এই ছাত্রসমাজ। কিন্তু বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির সাথে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখল শব্দগুলো ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে ছাত্র রাজনীতির অতীত গৌরবগাথা। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কোন ছাত্রকে হলে উঠতে হলে ধর্ণা দিতে হয় হলের বড় ভাইদের কাছে। বাধ্য হয়ে যেতে হয় মিছিল-মিটিংয়ে। অনেক সময় কারও কারও হাতে কলমের বদলে শোভা পায় লাঠিসোটা কিংবা অস্ত্র। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না।
গত ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর নির্বাচনে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে মতায় আসে মহাজোট। সরকার গঠনের পর থেকেই বহু েেত্র সাফল্য ও দতার পরিচয় দিয়েছে তারা। কুড়িয়েছে দেশের এবং বিদেশের মানুষের প্রশংসা। কিন্তু সরকারের এ সাফল্য ক্রমেই মস্নান হয়ে যাচ্ছে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু অছাত্র ও সন্ত্রাসীদের কল্যাণে আমরা দেখেছি, বিএনপি-জামায়াত জোটের শাসনামলে ছাত্রদল নামধারী সন্ত্রাসীদের তা-ব। ফলাফল, গত নির্বাচনে ৪দলীয় জোটের করম্নণ পরিণতি। বর্তমান সরকার যদি এখনই এসব দুষ্কৃতকারীর লাগাম টেনে ধরতে না পারে, তাহলে ভবিষ্যতে মহাজোটকে হয়ত জোট সরকারের পরিণতিই বরণ করতে হতে পারে এবং সেটা হবে আমাদের গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতার জন্য খুবই ভয়াবহ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দেশবাসীর ব্যাপক সমর্থনে আপনারা মতায় অধিষ্ঠিত। তাই আপনাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও বেশি। ছাত্রলীগ যেহেতু আওয়ামী লীগেরই সহযোগী সংগঠন, তাই এর যে কোন সাফল্যের দাবিদার যেমন আওয়ামী লীগ, তেমনি এর ব্যর্থতার দায়ভারও তাদের ঘাড়েই চাপবে। তাই আপনাদের কাছে অনুরোধ, এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করম্নন, যাতে আর কোন আবু বকরের মায়ের কোল খালি না হয়। কেউ যেন ছাত্রলীগের নাম ভাঙ্গিয়ে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ না চালাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি, আবু বকরের হত্যাকারীদের যাতে নিশ্চিত শাসত্মি হয় সে পদপে নিন। অবিলম্বে হল সংসদ ও ডাকসু নির্বাচন দিয়ে যোগ্য ও মেধাবীদের নেতৃত্বে আনুন। তা না হলে আমাদের এই 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' ক্রমেই মৃতু্যপুরীতে রূপ নেবে। আমরা এমন ক্যাম্পাস চাই যেখানে লেখাপড়া হবে, গবেষণা চলবে, চলবে আড্ডা, সুস্থ বিনোদন। আমাদের ক্যাম্পাসে থাকবে না কোন অস্ত্রবাজ। আমরা চাই না আর কোন বকরের কলমের কালি চাপা পড়ে যাবে তারই তাজা রক্তে।
বাংলা বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.