নূরুল আমীন ও তার ভ্রান্ত রাষ্ট্রভাষা নীতি- এমএ বার্ণিক

সবকিছু বিবেচনা করিয়া দেখিলে শুধু ইহাই মনে হয়ে যে, প্রাদেশিক আইন সভার অধিবেশনের তারিখ হইতে আরম্ভ করিয়া যতদিন দরকার হয়, ততদিন পর্যন্ত গোলমাল বাঁচাইয়া রাখিবার চেষ্টা করা হইয়াছিল।
সরকার ইহা বুঝিতে পারিয়া সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার স্বীকৃতির দাবিকে দাবাইয়া রাখিবার কোন প্রশ্নই ইহার মধ্যে ছিল না। ঘটনার মাত্র পকাল পূর্বেও ঢাকায় ও অন্যান্য জায়গায় এ সম্পর্কে সভার অনুষ্ঠান এবং শোভাযাত্রা বাহির করা হইয়াছিল। কিন্তু স্থানীয় কর্তৃপ কোথাও কোন হস্তপে করেন নাই। ১৪৪ ধারায় এ ধরনের সভা ও শোভাযাত্রা নিষিদ্ধও নহে। জেলা কর্তৃপরে অনুমতি লইয়া উহা করা যাইত। কিন্তু এরূপ কোন অনুমতি চাওয়া হয় নাই। অধিকন্তু পরবতর্ী ঘটনা হইতে সরকারের এই কথারই সমর্থন পাওয়া যাইতেছে যে, দুষ্কৃতকারীরা ভাষা সমস্যাকে তেমন কোন গুরুত্বই দেয় নাই; যতটুকু দিয়াছে, তাহা শুধু জনসাধারণের সমর্থন লাভের জন্যই।
পাকিস্তানের অন্যান্য শুভাকাঙ্ীদের মতো আমিও আশা করিয়াছিলাম যে, আমাদের জনগণ তাহাদের সহজাত বুদ্ধি, ইসলাম প্রীতি ও পাকিস্তানের প্রতি মমত্ববোধে নিজেদের স্থানীয় বাদবিসস্বাদ ভুলিয়া যাইবে এবং বুদ্ধিমান ও দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসাবে ঐক্যবদ্ধভাবে ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের ন্যায় জাতীয় বিপদ প্রতিরোধ করিতে প্রস্তুত হইবে। ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রুরা অতি সাময়িকভাবে হইলেও কিছুটা সাফল্য লাভ করিয়াছে এবং আমাদের তরলমতি যুবক ও জনসাধারণের মধ্যেও কিছু লোককে বিভ্রান্ত করিতে সম হইয়াছে দেখিয়া আমি খুবই বেদনা বোধ করিতেছি। ঢাকার সাম্প্রতিক গোলযোগের পেছনে যাহারা আছে, তাহারা যে কর্মপন্থা অবলম্বন করিয়াছে এবং যেভাবে তাহাদের ইচ্ছা জনগণের ওপর চাপাইয়া দিতে চাহিয়াছে, তাহাতে অতি সহজেই বুঝা যায়_ তাহাদের আসল উদ্দেশ্য কি। কিন্তু আমি অত্যন্ত বেদনাবোধ করিতেছি যে, জনগণের কতক অংশ আমাদের শত্রুদের আসল উদ্দেশ্য ও পাকিস্তানের বিপদের কথা বুঝিতে না পারিয়া তাহাদের ফাঁদে পা দিয়াছে। রাষ্ট্রভাষা সমস্যাকে এতদিন সরকার বিশেষ গুরুত্ব দেন নাই এই জন্য যে, আরও বহু বছর ধরিয়া উদর্ু বা বাংলার বদলে ইংরেজীই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্থান দখল করিয়া থাকিবে। এ অবস্থায় সময় ও স্বাভাবিক অবস্থা বিবর্তনের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা সমস্যার মীমাংসা করাই সঙ্গত কাজ বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল। আপনারা জানেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ায় আমাদের জাতীয় জীবনে নবীন প্রাণ ধারার সঞ্চার হইয়াছে এবং ইহার ফলে উদর্ু ও বাংলা উভয় ভাষারই নিত্য পরিবর্তন ঘটিতেছে।
উদর্ুভাষী ও বাংলাভাষী লোকদের মিলনের ফলে দুইটি ভাষারই উন্নতি হইতেছে এবং এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষার সঙ্গে মিশিয়া এই দুই ভাষাভাষীদের মধ্যস্থিত ব্যবধান দ্রুত কমাইয়া আনিতেছে। ইহারই জন্য মরহুম কায়েদে আজম বা কায়েদে মিল্লাত কেহই অপরিণত সময়ে এ সম্পর্কে গণপরিষদের নিকট হইতে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন মনে করেন নাই। পূর্ববঙ্গ সরকার ইতোমধ্যে অনুমোদন করেন যে, ভবিষ্যতে বাংলা ভাষা অবশ্যই প্রদেশের সরকারী ভাষা হইবে এবং এ ভাষার সর্ববিধ উন্নতির জন্য সরকার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা দান করেন। এই ভাষার মাধ্যমে পাকিস্তান এবং বিশেষ করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির উৎকর্ষের জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টাকে সরকার উৎসাহিত করেন।
যাহা হোক, গত ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বুকে যে দুর্ভাগ্যপূর্ণ পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাহা বিবেচনা করিয়া আমি ভাষা-বিতর্ককে রাজনীতি হইতে পৃথক করিবার সিদ্ধান্ত করিয়াছি এবং ইহার দ্বারা আমি প্রমাণ করিতে চাই যে, ভাষার প্রশ্নটাই আসল প্রশ্ন নহে বলিয়া আমি সব সময় যে ধারণা পোষণ করিতেছিলাম তাহাই আজ বাস্তব রূপ ধারণ করিয়াছে। ভাষা-বিতর্কের আওতায় একটি নিগূঢ় দুরভিসন্ধি রহিয়াছে।
অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ বিশৃক্মখলা সৃষ্টি করিয়া সরকারকে ধ্বংস করিবার জন্য শত্রুর চর এবং দুশমনরা একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করিয়াছে। তারপরদিনই আমি ব্যবস্থা পরিষদে প্রস্তাব করি যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্থান দেওয়ার জন্য গণপরিষদের কাছে সুপারিশ করিয়া একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক। আমার এই প্রস্তাব পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। যাহারা আইন অমানান্যের ষড়যন্ত্র করিয়াছিল, ভাষা সমস্যা ছাড়া যদি অন্য কোন বিশেষ মতলব তাহাদের না থাকিত তবে পরিষদের এই ব্যবস্থায় তাহারা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হইত।
কিন্তু আমরা কি দেখিয়াছি? এই প্রস্তাব গৃহীত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই বিােভকারীরা অন্যান্য দাবি উত্থাপন করিতে থাকে। তাহাদের আইন অমান্য ও বিশৃক্মখলা সৃষ্টি একটি নবপ্রেরণা লাভ করে। সরকার যাহা পূর্ব হইতেই জানিতেন তাহা শীঘ্রই স্পষ্ট হইয়া উঠিল। তাহাদের উদ্দেশ্যে ছিল যে ভীতি প্রদর্শন, শান্তিভঙ্গ এবং প্রয়োজন হইলে আইন ভঙ্গ করিয়া সরকারকে ধ্বংস করা হইবে এবং সেখানে নিজেদের মনোনীত একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করিয়া তাহাদের দ্বারা পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান হইতে বিচ্ছিন্ন ও পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একত্র করার মূল উদেশ্য হাসেল করিয়া লওয়া হইবে। সকলেই জানেন যে, ঐ ঘটনার সময় নারায়ণগঞ্জের একটি মিছিলে প্রকাশ্যভাবে 'যুক্ত বাংলা চাই' এবং 'জয়হিন্দ' প্রভৃতি ধ্বনি করা হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরে তাহারা কোন সাহসে আজ এসব স্লোগান দিতে সাহস পাইল তাহা বিশেষ বিবেচনার বিষয়। তাহাদের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সরকারের কাছে যে সব তথ্য ছিল তদ্দ্বারা সব কিছুই আজ নিশ্চল বলিয়া প্রমাণিত হইল। দুরভিসন্ধি হাসেলের জন্য তাহারা যে পন্থা গ্রহণ করে তাহা সত্যই অভিনব। সকলেই জানেন যে, তাহারা পরিষদের সদস্যবৃন্দকে হত্যা করার ধাতানি দিয়া মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি হইতে পদত্যাগ করাইবার প্রয়াস পায়। সরকারের প্রচেষ্টা ব্যাহত এবং তাহাদের ষড়যন্ত্র সমর্থন করাইবার জন্য সংবাদপত্রগুলোর মালিক এবং সাংবাদিকগণকেও তাহারা অনুরূপ ধাতানি দেয়। তাহাদের পরিকল্পনার একটি অংশ হিসাবে তাহারা 'মনিং নিউজ' প্রেসটি পোড়াইয়া ফেলে এবং ইহার দ্বারা অন্যান্য সংবাদপত্রগুলোকে ভীতি প্রদর্শন করিবার চেষ্টা করে।
এরূপভাবে সরকারী কর্মচারীগণকেও ধমকানি দেওয়া হয় এবং তাহাদিগকে অফিসে যাইতে বারণ করা হয়। শাসনকার্যে অচলাবস্থা সৃষ্টির চেষ্টাও করা হয়। তিন দিন ধরিয়া বহু দোকানপাট, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং যানবাহন চলাচল ব্যবস্থা জোরপূর্বক বন্ধ রাখা হয় এবং তাহাদিগকে হরতাল পালন করিতে বাধ্য করা হয়। টেলিফোন, টেলিগ্রাম এবং ট্রেন চলাচল ব্যবস্থায়ও বিঘ্ন ঘটাইবার জন্য অনুরূপ চেষ্টা করা হয়। ফলে এইসব রাষ্ট্রদ্রোহী কার্যকলাপের মোকাবেলা করিবার জন্য সরকারকে দৃঢ় ব্যবস্থা অবলম্বন করিতে হয়। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.