একচল্লিশ বছর পর বিজয়ের আরেক বার্তা- প্রতিবেদনগুলো তৈরি করেছেন দৈনিক জনকণ্ঠের সিনিয়র রিপোর্টার বিকাশ দত্ত

দীর্ঘ ৪০ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে একজনের সাজা দেয়া হলো। বাচ্চু রাজাকার হিসেবে পরিচিত আবুল কালাম আজাদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মৃত্যুদন্ড প্রদান করেছেন।
কিন্ত এ বিচারের একটি পটভূমি রয়েছে। দীর্ঘদিন আন্দোলনের ফসল এ বিচারের রায়। ১৯৭২ থেকে ২০১৩ সাল। এ সময়ের মধ্যে ঘটেছে নানা ঘটনা। বিচারের জন্য সুশীল সমাজকে করতে হয়েছে অনেক আন্দোলন। সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের শহীদ পরিবারের সদস্যরা মিলিত হয়ে মিছিলসহকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ জারি করেন। এরপর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য এরই ধারাবাহিকতায় গঠন করা হয় ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি দেশের এক শ’ একজন বরেণ্য নাগরিক কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক ঘোষণার মাধ্যমে ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠন করা হয়। এর এক মাসের কম সময়ে নির্মূল কমিটিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ৭২টি রাজনৈতিক দল ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’। এ সমন্বয় কমিটির উদ্যোগেই ২৬ মার্চ গণআদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচারের কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হয়। নির্মূল কমিটি গঠনের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সাত নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব) কাজী নুরুজ্জামান, লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবীর ও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠনের পর শহীদ জননী পুরো সময় সমন্বয় কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করেন।

গণআদালতের পটভূমি
১৯৯২ সালে যুদ্ধাপরাধীদের দুষ্কর্ম অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয়েছিল জাতীয় গণতদন্ত কমিশন। ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য প্রায় ৫ লাখ লোকের সমাগম ঘটেছিল। এরপর গণআদালতের কর্মসূচী বানচাল করতে ব্যর্থ হয়ে তদানীন্তন বিএনপি সরকার ২৪ বরেণ্য ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের করে। ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গোলাম আযমের বিচারের যৌক্তিকতা তুলে ধরে এবং ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তখন জাতীয় সংসদে এক অসাধারণ ভাষণ দিয়েছিলেন। তখন সংসদের ভেতরে ও বাইরে বিরোধী দলের চাপে এবং জাহানারা ইমামের তুঙ্গস্পর্শী আন্দোলনে সরকার ২৯ জুন ’৯২ তারিখে বিরোধী দলের সঙ্গে চারদফা চুক্তিতে বাধ্য হয়। যে চুক্তির প্রথম দুই দফা ছিল, সরকার যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার করবে এবং গণআদালতের উদ্যোক্তা ২৪ বরেণ্য নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করবে। বিরোধী দলকে সংসদে আনার জন্য খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার এ ধরনের চুক্তি অনুযায়ী কাজ করেনি। গোলাম আযমের বিচার করার বদলে খালেদা জিয়া তাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করেন। শত হযরানি ও নির্যাতন সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নির্মূল কমিটি ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিল।

দালাল আইন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশ জারি করেন। এ আদেশ ৬ ফেব্রুয়ারি, ১ জুন ও ২৯ আগস্ট ১৯৭২ সালে তিনদফা সংশোধনের পর চূড়ান্ত হয়। দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারের জন্য সারাদেশে ৭৩টি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে ৩০ নবেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সাধারণ ক্ষমায় ৩৭ হাজারের মধ্যে ২৬ হাজার ছাড়া পেয়েছিল। ১১ হাজারের বেশি ব্যক্তি আটক ছিল। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিচারপতি সায়েম ও জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার দালাল আইন বাতিল করে। ফলে এই ১১ হাজার ব্যক্তির পক্ষে আপীল করে জেল থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ ঘটে।
গণআদালতের বড় সাফল্য গোলাম আযমসহ অন্য শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গণতদন্ত কমিশন গঠন করা। বেগম সুফিয়া কামালকে চেয়ারপার্সন করে ১৯৯৩ সালের ২৬ মার্চ ১১ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় গণতদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এ কমিশন প্রথম পর্যায়ে ৮ এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ৭ যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্ম সম্পর্কে মাঠপর্যায়ে তদন্ত করে প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে দুটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। এই ১৫ যুদ্ধাপরাধী হলেন: (১) আব্বাস আলী খান; (২) মতিউর রহমান নিজামী; (৩) মোঃ কামারুজ্জামান; (৪) আব্দুল আলীম; (৫) দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী; (৬) মাওলানা আব্দুল মান্নান; (৭) আনোয়ার জাহিদ; (৮) আব্দুল কাদের মোল্লা; (৯) সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী; (১০) এএসএম সোলাময়মান; (১১) মাওলানা আব্দুস সোবহান; (১২) মাওলানা একেএম ইউসুফ; (১৩) মোহাম্মদ আয়েন উদ্দিন; (১৪) আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ; (১৫) এএম খালেক মজুমদার । তৃতীয় তালিকায় ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনের নাম ছিল, কিন্তু তিনি মৃত্যুবরণ করায় তার যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কে তদন্ত স্থগিত রাখা হয়। জাহানারা ইমামের জীবদ্দশায় এ আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ৭২টি রাজনৈতিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক-মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্রছাত্রী, যুব, পেশাজীবী সংগঠন। এ গণতদন্ত কমিশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে ২ খ-ে ১৬ যুদ্ধাপরাধীর দুষ্কর্মের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর জাতীয় সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়। শহীদ জননী জাহানার ইমাম সূচিত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের এ আন্দোলনের গুরুত্বের কথা বিবেচনায় রেখে রাজপথে এ আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ১৯৯৫ সালে নির্মূল কমিটি পুনর্গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।

শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি আসনে বিজয়ী হয়ে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসে। এ অবিস্মরণীয় বিজয়ের অন্যতম কারণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি মহাজোটোর অঙ্গীকার, যা তরুণ প্রজন্মের নির্বাচকম-লীকে বিপুলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে দ্রুত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সর্বসম্মত প্রস্তাব পাস হয়। এখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধসমূহ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩ অনুযায়ী। সেই অনুযায়ীই ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার কথা বিবেচনা করে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা ছিল। সেদিক দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পর তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা করলেন।

ট্রাইব্যুনাল গঠন
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ ও ২ গঠন করা হয়। বর্তমানে দুটি ট্রাইব্যুনালে বিএনপি ও জামায়াতের ১৪ জনের বিচার চলছে। এরমধ্যে বাচ্চু রাজাকারের মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। এখন যাদের মামলা রয়েছে তাঁরা হলেনÑ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আরেক নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, হাজী মোবারক ও পটুয়াখালীর রুস্তম আলী। এদের বিচার চলছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২-এ বিচার চলছে, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও সাবেক মন্ত্রী বিএনপি নেতা আবদুল আলীমের।

সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় এবং-
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর লাক্কাবাগে ইংরেজ সেনাবাহিনীর কাছে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যাসহ ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের করতলগত হয়। এরপরে সুদীর্ঘ ১৯০ বছর বিদেশী শাসকগোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় অবিভক্ত ভারতের জনগণ অব্যাহত লড়াই-সংগ্রাম পরিচালনা করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতার আন্দোলনের একপর্যায়ে হিন্দু আর মুসলমান দু’পৃথক জাতিÑ এ তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং ইতিহাসবিষয়ক বইপত্র, পত্র-পত্রিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাকিস্তান রাষ্ট্রটি পূর্ববঙ্গ (পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান) ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে পৃথক দুটি ভূখ- গঠিত হয়। এই দুই ভূখ-ের দূরত্ব ছিল প্রায় ১২ শত মাইল। মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার তাগিদে পাকিস্তান অর্জিত হলেও শুরুতেই রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে কুক্ষিগত করে নেয়, পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষুদ্র এক গোষ্ঠী যাদের অধিকাংশই ছিলেন পাঞ্জাবী ভূস্বামী।

বৈষম্য
দীর্ঘ দু’ যুগ ধরে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর যে বিদ্বেষপূর্র্ণ ও বৈষম্যমূলক মনোভাব ছিল তা। মূলত ১৯৭১ সালে বিভিন্ন ঘৃণ্য অপরাধ সংগঠনের ক্ষেত্রে মূল উদ্দেশ্য ও মোটিভ হিসেবে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে অপরাধ সংঘটনের পেছনে যে উদ্দেশ্য ও মোটিভ ছিল পাকিস্তান সেনাবািহনী ও এর সহযোগী বািহনীগুলোর (ধীঁরষষরধৎু ভড়ৎপবং) মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। উপরন্তু অপরাধসমূহ সংঘটনের ক্ষেত্রে আরও কিছু উদ্দেশ্য মোটিভ কাজ করেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাপক্ষের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থানকালে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত অপরাধের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল- (ক) তৎকালীন দখলকৃত বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক শোষণসহ যাবতীয় শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা; (খ) ৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ে বাংলাদেশের ভূখ-ের জনগণের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মী সমর্থকদের নির্মূল করা ; (গ) বাঙালী জনগোষ্ঠীর প্রতি জাতিগত বিদ্বেষ; (ঘ) ধর্মীয় সঙ্কীর্ণ মনোভাব ; (ঙ) স্বাধীনতার আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসার জন্যে বাঙালী জনমনে ভীতি সঞ্চার করা ; (চ) তৎকালীন দখলকৃত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার মাধ্যমে তথাকথিত ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ প্রতিষ্ঠা করা ; (ছ) বাঙালী জাতিকে মেধাশূন্য করা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যেসব সহযোগী বাহিনী ছিল- (ধীঁরষষরধৎু ভড়ৎপবং) যেমন, কনভেনশন মুসলিম লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, কাইউমপন্থী মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী, কৃষক শ্রমিক পার্টি, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর বাহিনী, আলশামস বাহিনী, সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্স ইত্যাদি।

কারা ভিকটিম
এরা ভিকটিম হিসেবে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে গণ্য হতোÑ (ক) মুসলিম নয় এমন জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় ; (খ) বাংলাদেশের সাহিত্যিক সমাজ, শিক্ষক ও সংস্কৃতি কর্মীসহ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষের নিরীহ বেসামরিক লোকজন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার-পরিজন; (গ) গনিমতের মাল হিসেবে দখলকৃত বাংলাদেশের নারী সমাজ ; (ঘ) আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতাকর্মী, সমর্থক ; (ঙ) বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ৯ মাস বেসামরিক নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালী জনগণের ওপর অব্যাহতভাবে চলে নারকীয় নির্যাতন। ২৫ মার্চ মধ্য রাতে দখলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারবাগ, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, পুরনো ঢাকার হিন্দু-অধ্যুষিত এলাকা শাঁখারী বাজার, রমনা কালীমন্দির এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। অভিযানের সূচনায় সেনাবাহিনীর প্রতি জেনারেল টিক্কা খান এক আদেশে বলেন, ‘আমি মানুষ চাই না, মাটি চাই।’ দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর এবং আসামির নেতৃত্বাধীন এবং প্রভাবাধীন সহযোগী বাহিনীর হাতে নির্মমভাবে নিহত হয় ৩০ লাখ বাঙালী, ধর্ষিত হয় প্রায় ৪ লাখ নারী।

রাজাকার
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর যেসব সহযোগী বাহিনী ছিল, যেমন-জামায়াতে ইসলামী, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদিÑ ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা থেকে তারা মুসলিম নয় এমন জনগোষ্ঠীকে, বিশেষ করে হিন্দুদের ভিকটিম হিসেবে বাছাই করত। এ বাহিনীগুলোর আরেকটি লক্ষ্যবস্তু ছিল বাঙালী, যাদের তারা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি এবং হিন্দুধর্ম দ্বারা প্রভাবিত মনে করত। বাঙালীদের সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, বেশভূষা আর সাহিত্যের মধ্যে তারা তথাকথিত হিন্দুয়ানি ভাব খুঁজে পেত। এজন্য তাদের সংঘটিত অপরাধের লক্ষ্যবস্তু ছিল তৎকালীন বাংলাদেশের সাহিত্যিক সমাজ, শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের সব ঘৃণ্য অপরাধের আরেকটি ভিকটিম ছিল দখলকৃত বাংলাদেশের নারী সমাজ। এ যুদ্ধকালে বিশেষত বাংলাদেশের নারীরা ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতার সম্মুখীন হয়। এর কারণ একদিকে যেমন ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগী ধর্মীয় সঙ্কীর্র্ণ মনোভাব। তেমনি তারা মনে করত যে, যেহেতু তারা পবিত্র পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য তথাকথিত ‘জিহাদে’ লিপ্ত, তাই তারা নারীদের যথেচ্ছা ব্যবহার করতে পারে। এক্ষেত্রে তারা নারীদের গনিমতের মাল হিসেবে গণ্য করত এবং অমুসলিম কিংবা সাচ্চা মুসলমান নয় এমন নারীদের ধর্ষণের জন্য বেছে নেয়া হতো তাদের তথাকথিত সাচ্চা মুসলমান বানানোর উদ্দেশ্য থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব সহযোগী বাহিনীর আরেক শ্রেণীর ভিকটিম ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষজন। তারা আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের শত্রু আর ভারতের দালাল মনে করত। এজন্য তারা আওয়ামী লীগকে বিভিন্ন সময়ে দুষ্কৃতকারী, রাষ্ট্রবিরোধী, ভারতের দালাল, ভারতের চর হিসেবে তাদের ওপর ঘৃণ্য অপরাধ সংঘটিত করত।

মেধাশূন্য করার ঘৃণ্য চক্রান্ত
সর্বশেষ তাদের ঘৃণ্য অপরাধের চূড়ান্ত ভিকটিম ছিল বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যখন স্পষ্ট প্রতীয়মান, তখন তারা বাঙালীকে মেধাশূন্য করার একটি ঘৃণ্য চক্রান্ত করে, যার বাস্তবায়ন করা হয় ১৪ ডিসেম্বর। তারা ’৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর নির্মমভাবে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজকে হত্যা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পশ্চিম পাকিস্তানীদের মধ্যে সব সময় বর্ণবিদ্বেষী ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব ছিল। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই বাঙালী জনগোষ্ঠীর অর্থাৎ তৎকালীন দখলকৃত বাংলাদেশের অধিবাসীদের ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রে যে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয় তারই ফলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হয়। আর এ যুদ্ধের বিরোধিতা করে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকি সৈন্যরা ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে নারকীয় হত্যাকা- ঘটায়।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এই ঘোষণা দেয়ার পরেই রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর ধানম-ির বাড়ি ঘেরাও করে ব্যাপক গুলিবর্ষণ করে। তাঁকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে ও পরে পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে নিয়ে আটক করে রাখে। এরপর জনগণ পাকস্থানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। ১০ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত ১৬৯ জনের মধ্যে ১৬৭ জন প্রতিনিধি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার আলোকে মুজিবনগরে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এ ঘোষণাবলে বঙ্গবন্ধুকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী কর্তৃক তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী পার্টি, পিডিপি ইত্যাদিসহ ডানপন্থী রাজনৈতিক দল, শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী ঘাতক বাহিনী আল-বদর, আল-শামসের পরাজয় হয়। মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাাঙালীর নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ ও ৪ লাখ মা-বোনের নির্যাতিত হওয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।

মুসলিম লীগ কনভেনশন
যে লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান অর্জিত হয় সে প্রস্তাব উত্থাপন করেন তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশন। শুধু তাই নয়, ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভারতের ১১টি প্রদেশে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে কেবল বাংলা-ই পাকিস্তানের পক্ষে গণভোটে ব্যাপক অংশ নেয়। মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৬টি আসনে জয়লাভ করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠনে সমর্থ হয়। অন্যান্য প্রদেশের মধ্যে সিন্ধু প্রদেশে একটি মাত্র আসনে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠনে সমর্থ হয়। অন্যান্য প্রদেশের মধ্যে সিন্ধু প্রদেশে একটি মাত্র আসনে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তানসহ অন্য সব প্রদেশে মুসলিম লীগ কোন প্রকার প্রাধান্য লাভে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, পাকিস্তান অর্জনে বাঙালী মুসলমানদের ব্যাপক ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান অর্জনের পূর্বাপর সময়ে অবাঙালী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ কর্তৃক তা সর্বতোভাবে অস্বীকৃত হয়। এভাবেই বাঙালীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে।

বাঙালীর স্থান ছিল না
১৯৪৬ সালে ভারত সরকারের অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় যেমনিভাবে কোন বাঙালীর স্থান হয়নি তেমনি বাংলায় মুসলিম লীগের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা সত্ত্বেও ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী মি. এটলী কর্তৃক প্রেরিত ক্যাবিনেট মিশনের সঙ্গে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে কোন বাঙালী মুসলমানের স্থান ছিল না। মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয় ঢাকায় এবং বাংলায় মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল কিন্তু কাউকে কোনদিন এ দলের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়নি ; বরং বাঙালী মুসলমানদের স্বার্থ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার প্রথম থেকেই ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হতো।

বঞ্চনার শিকার
পশ্চিম পাকিস্তানী কেন্দ্রীয় শাসক গোষ্ঠীর কাছে পাকিস্তান সৃষ্টির গোড়া থেকে পূর্ববঙ্গকে (পূর্ব পাকিস্তান) বঞ্চনার শিকার হতে হয়। স্থলপথে ১২০০ মাইল দূরে আর সমুদ্রপথে ২৪৫০ বর্গমাইল দূরত্বে থাকা পশ্চিম পাকিস্তানীরা নিজেদের বীরের জাতি হিসেবে ভাবত। আর বাঙালীদের দেখত হেয় চোখে। তাদের বর্ণবিদ্বেষী আর বিভেদপূর্ণ মনোভাব ছিল সব সময়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম-অধ্যুষিত ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিম এলাকার সমন্বয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও একমাত্র ৮০ ভাগ জনগোষ্ঠীর ধর্ম ছাড়া বাদবাকি সবটাই অর্থাৎ সামাজিক রীতিনীতি, পোশাক-পরিচ্ছদ, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৩ লাখ ১০ হাজার বর্গমাইলের পশ্চিম পাকিস্তানের জনবসতি ছিল প্রতি বর্গমাইলে ১৭৮ জন; আর ৫৫ হাজার বর্গমাইলের পূর্ব পাকিস্তানের জনবসতি ছিল প্রতি বর্গমাইলে ৯২২ জন। মননের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনেক কাছাকাছি; আর পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ববঙ্গ) সীমানা যেখানে শেষ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সীমানা সেখানে শুরু। পশ্চিম পাকিস্তানের শতভাগ মানুষের মধ্যে ছিল পাঞ্জাবী, বেলুচ, পাঠান ও সিন্ধি আর পূর্ব পাকিস্তানের ৯৮ ভাগ জনগণ ছিল বাঙালী। ১৯৬৬’র ২০ মার্চ ঢাকায় কনভেনশন মুসলিম লীগের সমাপ্তি অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তার সমর্থকদের প্রয়োজনে গৃহযুদ্ধ মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। বাঙালীদের বুঝিয়ে যদি জয় করা না যায় তবে দমননীতি প্রয়োগ করে তাদের স্তব্ধ করে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে সামরিক চক্র। নির্দয়ভাবে তা প্রয়োগ করতে থাকে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। সর্বস্তরের বাঙালী এ দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। তীব্র গণঅভ্যুত্থানের মুখে পাকিস্তান সরকার ১৯৬৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ২৮ জন আসামিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। আগরতলা মামলা হতে মুক্তি পাওয়ার পর তদানীন্তন ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমেদের সভাপতিত্বে রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় বাঙালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। অনেক ঘটনার পর ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট ভবনে সব প্রদেশের গবর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকদের সঙ্গে এক গোপন বৈঠকে মিলিত হন। এতে অন্যদের মধ্যে সহকারী প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারের আব্দুল হমিদ খান ও প্রেসিডেন্টের প্রধান স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল জিএম পীরজাদা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ৬ দফা থেকে বঙ্গবন্ধুকে বিরত রাখা না গেলে নিরস্ত্র বাঙালীদের ওপরে সামরিক অপারেশনের গোপন পরিকল্পনা ‘ব্লিৎজ’ বাস্তবায়নের অনুমোদন করা হয়। সব প্রদেশের গবর্নর ও সামরিক প্রশাসকদের সঙ্গে গোপন বেঠকে মিলিত হওয়ার আগে ১১ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং পরবর্তীতে ২৬ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া-ভুট্টো গোপন শলাপরামর্শ করে। ব্লিৎজ পরিকল্পনা অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে ১৬তম ইনফ্রেন্টি ডিভিশন ও খরিয়াম থেকে ১৯তম ডিভিশনকে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণের আদেশ দেয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণআন্দোলন
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে তীব্র গণআন্দোলন। একপর্যায়ে একাত্তরের ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ পুনর্ঘোষণা করেন। এরই মধ্যে সামরিক বাহিনীর রহস্যজনক গতিবিধিতে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালী জনমনে এ বিশ্বাস দৃঢ়মূল হয় যে, ইয়াহিয়ার এ প্রস্তাবনা বস্তুত পাকিস্তান সরকার, সামরিক বাহিনী ও তাদের তল্পিবাহক রাজনৈতিক নেতৃত্বের সুগভীর চক্রান্তেরই আরেক অংশ মাত্র। ওইদিন রাতে পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালীদের বিরুদ্ধে গোপন সামরিক অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ও পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ বলে পরিচিত লে. জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগ দেয়া হয়।
৭ মার্চ ঢাকায় এসে দায়িত্ব নিয়ে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের ব্যাটালিয়ন ও পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করার, চট্টগ্রাম নৌ-ঘাঁটি এবং লালমনিরহাট ও ঈশ্বরদী বিমান ক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য গোপনে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয়। এরপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাংলাকে মরুভূমি করার লক্ষ্যে নানামুখী ষড়যন্ত্র করতেই থাকে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরীহ বাঙালীর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান শুরুর পর পরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
বাংলার নিরীহ জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী দখলদার হানাদার বাহিনী কর্তৃক তাদের এদেশীয় সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, পিডিপি ইত্যাদি ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ও শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং তাদের সহযোগী ঘাতক বাহিনী আল-বদর, আল-শামস, সিভিল পাইওনিয়ার ফোর্সের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতায় ও চক্রান্তে আগ্রাসী হামলার মোকাবেলায় বাঙালীর মুক্তির সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর তৎকালীন ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কামান্ডের কাছে তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বাঙালীর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।

No comments

Powered by Blogger.