হৃদয়নন্দন বনে-মুক্তবুদ্ধির পরাজয়! by আলী যাকের

বিজয় দিবস পেরিয়ে এলাম বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল। কিন্তু এবারের বিজয় দিবসের স্মৃতি আমার মনে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। বস্তুতপক্ষে আমার জন্মের পরে কয়েক বছর পার হওয়ার পর এমন রমরমা বিজয় দিবস খুবই কম দৃষ্টিগোচর হয়েছে আমার।
পতাকা, ফেস্টুন, ব্যানার দিয়ে গাড়িতে, দোকানে, বাড়িতে সর্বত্র লাল-সবুজে ভরিয়ে দিয়েছিল সারা শহরটাকে। প্রাণোচ্ছল তরুণদের দেখেছি অনুষ্ঠান থেকে অনুষ্ঠানে ছুটছে জীবনের সবচেয়ে আনন্দঘন দিনটিকে হৃদয়ের সকল উত্তাপ দিয়ে উদযাপন করতেই বুঝি-বা। সকলেরই হাস্যোজ্জ্বল মুখ। তা সে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরেই হোক কিংবা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অথবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিভিন্ন মঞ্চে। আমি একাধিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি। হয়তো যেতাম না, তবে এবারে প্রাণের তাগিদেই গিয়েছি এবং সন্ধ্যার দিকে এক অনাবিল আনন্দ নিয়েই হাজির হয়েছি ঢাকার অদূরে আটি ভাওয়াল গ্রামে, যেখানে আমার এক সময়ের গুরু ওয়াহিদুল হক স্মরণে 'সরজ সংস্কৃতি বৃত্ত পরম্পরা' আয়োজন করেছিল একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের। ঢাকা থেকে কণ্ঠশীলন এবং ছায়ানট গিয়েছিল সেখানে সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে। আর আমাদের দু'চারজনকে ডাকা হয়েছিল বিজয় দিবস নিয়ে আলোচনা করার জন্য। ওই অনুষ্ঠানে ওই অঞ্চলের কিছু বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনাও জানানো হয়েছিল এ উপলক্ষে। অনুষ্ঠানে সমাগত প্রায় ১০০-১২৫ মানুষ ছিল প্রাপ্ত বয়স্ক। বাকিরা তরুণ এবং শিশু। ভালো লেগেছে দেখে যে, বক্তাদের আলোচনার সময় আবালবৃদ্ধবনিতা সকলেই পরম আগ্রহ নিয়ে কথা শুনেছে। এ বিষয়টি সচরাচর দেখা যায় না। আমি অনুমান করি যে, ওয়াহিদুল হকের প্রয়াণের পর তার জ্যেষ্ঠ কন্যা অপালা তার একাগ্র সাধনায় আটি ভাওয়ালে সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহকে উজ্জীবিত রাখতে পেরেছে। আজ অপালা আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তার কর্মকাণ্ডের ছাপ রেখে গেছে ওই অঞ্চলে। অবশ্য ওয়াহিদ ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম যে, আটি ভাওয়াল সবসময়ই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে। অতএব, কোনকালে এর ব্যত্যয় ঘটবে সেটাও আমি আশা করিনি।
যা হোক, ওই দিন বিজয়ানন্দের যে ছোঁয়া আমি দেখেছি ঢাকা শহরে, তা আটি ভাওয়ালেও পরিলক্ষিত হয়েছিল। শেষ বক্তা হিসেবে আমার আলোচনার পালা যখন এলো, তাৎক্ষণিকভাবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আজ মুক্তি এবং স্বাধীনতা বিষয়ে কিছু বলব। কেন যেন আমার মনে হয়েছিল যে, এই বিষয় দুটির যে নিজস্বতা আছে, সে সম্বন্ধে ওই সমাবেশে বলা যেতে পারে। যারা উপস্থিত ছিলেন তারা শুনবেন, এই প্রত্যয় আমার ছিল। আমি শুরু করেছিলাম এই বলে যে, যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, কেবল একটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্যই তারা যুদ্ধ করেননি। মুক্তিযুদ্ধের অর্থ অসীম। ১৯৪৭ থেকে শুরু করে '৭১ পর্যন্ত আমরা প্রতি পদেই এমন সব বাধার সম্মুখীন হচ্ছিলাম যে, আমাদের স্বভাবতই মুক্তির কথা চিন্তা করতে হচ্ছিল। সামগ্রিকভাবে মুক্ত হওয়ার জন্যই স্বাধীনতা অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। অর্থাৎ আমরা একটি স্বাধীন দেশে সব বাধামুক্ত একটি জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার এক অত্যন্ত সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলাম। এক কথায় বলা যেতে পারে, এ হচ্ছে বুদ্ধিমুক্তির সংগ্রাম। আমরা যখনই বলি বুদ্ধিমুক্তি কিংবা মুক্তবুদ্ধি তখনই এই শব্দবন্ধের ভেতরে প্রোথিত কতগুলো অনিবার্য বিষয় আমাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এগুলো হচ্ছে, আমরা সৎ এবং সত্য হবো, অসাম্প্রদায়িক হবো, সভ্য-ভব্য এবং শিক্ষিত হবো, রুচিশীল হবো, অহিংস হবো, সর্বোপরি বিশ্বমানবের সঙ্গে হাতে হাত ধরে সভ্যতর জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার জন্য দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে এগিয়ে যাব।
আজ আমাদের স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে কি আমরা বুকে হাত দিয়ে এ কথা বলতে পারি যে, আমরা সত্যিকার অর্থে মুক্ত হয়েছি? আমি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির যাচাই না করেও এ কথা বলতে দ্বিধা করব না যে, আমরা হয়তো আলোকিত পথের দিকে যাত্রা শুরু করে ক্রমেই দিকভ্রষ্ট হয়ে অন্ধকারের পথে পথচলা শুরু করেছি। এটা যে কেবল আমাদের চলমান রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় তা-ই নয়, আমরা আমাদের দৈনন্দিন আচার-ব্যবহার লক্ষ্য করলেও এ কথাটি স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। রাজনীতিতে তো আমরা দিকভ্রষ্ট হয়ে প্রতিক্রিয়াশীলতার পথ ধরেছি সেই ১৯৭৫ সাল থেকেই। তখন থেকেই আমরা পথ চলছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বাসনালব্ধ পথ থেকে ভিন্ন পথে। আমরা একে একে হত্যা করেছি গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, শিক্ষা এবং প্রগতিকে। পথ ধরেছি ধর্মান্ধতার, সাম্প্রদায়িকতার, স্বৈরাচারের এবং অশিক্ষা, কুশিক্ষার। এ কথাগুলো বলে হঠাৎ মনে হলো আমরা কি আসলেই পথ ভুলে এই পথ ধরেছি? নাকি পথ ভোলার জন্যই বেপথে যাত্রা শুরু করেছিল সেই '৭৫ থেকে? এর জবাব খুঁজতে গেলে রাজনীতির ওপর একটি বিশেল্গষণধর্র্মী গ্রন্থ রচনা করা যায়। আজ এখানে আমার সে অভিপ্রায় নয়।
আমরা দৃষ্টি ফেরাই আরও ছোটখাটো এবং আপাত তুচ্ছ দিকগুলোর প্রতি। দৃষ্টি ফেরাই আমাদের ব্যবহারিক জীবনের দিকে। লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, সামগ্রিকভাবে যখন অবক্ষয়ের শুরু হয়, তখন তার ছায়া পড়ে জীবনের বিভিন্ন ব্যবহারিক দিকগুলোতেও। অতএব, চারপাশে দৃষ্টি ফেরালেই আমরা দেখতে পাই যে, আমাদের আচরণ কখনোই যুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, নিয়ন্ত্রিত হয় এক চরম অরাজক এবং অযৌক্তিক আচরণের দ্বারা। পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য আমি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা থেকে কয়েকটি বিষয় উলেল্গখ করতে চাই। সেদিন এক বন্ধু বলল যে, ঢাকার এয়ারপোর্ট রোডে সে একটি সিএনজি অটোরিকশাকে অবৈধভাবে আসতে দেখে সেটিকে থামিয়ে বলে যে, অটোরিকশার চালক এহেন বেআইনি কাজ কেন করছে। চালকের জবাব দেওয়ার আগেই তার যাত্রী, এক মাঝ বয়সী নারী অটোরিকশা থেকে মুখ বের করে বলে, 'আইন-বেআইন বলে কোনো কিছু আছে নাকি এই দেশে? সবাই যখন বেআইনি কাজ করছে, তখন আমিও আমার সুবিধামতো পথে চলব।' আমার সেই বন্ধু এহেন মুখ ভাঙা জবাব শুনে বাক রহিত হয়ে যান। এই সেদিন টেলিভিশনে 'নিরাপদ সড়ক চাই' খ্যাত স্বনামধন্য অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম। তিনি অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছিলেন চালকের দোষ-ত্রুটির চেয়েও যাত্রীদের আচরণের প্রতি। তিনি বললেন, একটি বাস যদি বেপরোয়া চালিয়ে রাস্তায় একটি মানুষকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলে, তাহলেও বাসের যাত্রীরা ড্রাইভারকে গতি না কমিয়ে ত্বরিত সেখান থেকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কেননা বাস যদি থেমে যায়, তাহলে যাত্রীদের গন্তব্যে যাওয়ায় বিলম্ব হয়ে যাবে। শুনে অবাক হইনি। কেননা আমি তো জানি, নিত্যই আমরা দেখতে অভ্যস্ত যে, একটি পরিষ্কার দেয়ালে পানের পিক ফেলা কিংবা কোনো একটি যাত্রীবাহী গাড়ির চেয়ারের গদি কেটে দেওয়া অথবা যত্রতত্র আবর্জনা ফেলা, ফুটওভারব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তা ব্যবহার না করে চলমান যানবাহনকে থামিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হওয়া আমাদের জন্য অতি স্বাভাবিক। এ রকম হাজারো দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। তবে এগুলো তো তুচ্ছ ব্যাপার। আজকাল আমাদের অভিভাবকরাই তাদের সন্তানদের ফাঁকিবাজি, নকল কিংবা অন্যান্য অনৈতিক কাজে উৎসাহিত করেন। এমনকি আমি শুনেছি, অর্থের বিনিময়ে যে কোনো প্রকারে সন্তানের জন্য একটি ডিগ্রি ক্রয় করতেও তাদের বিন্দুমাত্র সংকোচ হয় না। এক কথায় 'বিবেক' বলে যে শব্দটি আছে সেটি আমাদের অভিধান থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
এই যে সামগ্রিক অরাজকতা এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, আমরা আমাদের সকল মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি থেকে যার জন্ম, তাকে সমূলে বিনাশ করেছি। আমরা বেআইনি কাজ করেছি, হত্যার পর হত্যা করেছি, বিবেককে টুঁটি চেপে মেরেছি কিন্তু তা নিয়ে কারও মনে একটুও গল্গানিবোধ হয়নি। গল্গানিবোধ তো দূরের কথা, আমরা নিজেদের বিবেকের প্রশ্নের সামনে দাঁড়াতেও ভুলে গেছি। আমি জানি না এই অবক্ষয় থেকে মুক্ত হবো কবে? কীভাবে?

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.