এখানে সেখানে- কেট মিডলটনের অপেক্ষায় ৫৯ মিনিট by ইকবাল হোসাইন চৌধুরী

বেকার স্ট্রিটে পা রেখেই বুঝলাম একটা ভুল হয়ে গেছে। সঙ্গে কোনো জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) নেই। মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ। শেষ ভরসা পাতাল রেলস্টেশনের দোরগোড়ার মানচিত্র। পুরোটা আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম। কোথাও কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের নাম-গন্ধ নেই।
এখন উপায়? দুঁদে গোয়েন্দা শার্লক হোমসের ঠিকানায় আছি। মাথা ভালো কাজ করার কথা। উল্টো সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার এমাথা-ওমাথা ঘুরছি। খুঁজে পেতে গেলাম এক দোকানে। দোকানি অতি সজ্জন। কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের কথা বলতেই হলদে দাঁত বের করে হাসলেন। তারপর তার কম্পিউটারে গুগল ম্যাপ দেখে পথ বাতলে দিলেন। সামনে গিয়ে বাঁয়ে। তারপর ডানে। তারপর আবার ডানে গিয়ে...। পুরোটা শোনার আগেই হাঁটা ধরেছি। আগে ডানে গিয়ে বাঁয়ে যাই, পরে দেখা যাবে। ডানে-বাঁয়ে গেলাম। আশপাশে হাসপাতালের দেখা নেই। বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম। ভারতীয় এক মহিলা দেখলাম পত্রিকার দোকানে গম্ভীর মুখ করে বসে। ৫০ পেনস দিয়ে এক কপি মিরর কিনলাম। যদি পত্রিকা কেনার সুবাদে মহিলার সঙ্গে একটু আলাপ জমানো যায়। মহিলা কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের নাম শুনে বেশ খানিকক্ষণ কী যেন হিসাব-নিকাশ করলেন। দোকানের সহকারী ছেলেটাকে ডাকলেন। তারপর দুজনে মিলে খুব আনন্দের সঙ্গে জানালেন, অত্র এলাকায় এই রকম কোনো হাসপাতালের নাম তাঁরা শোনেননি। অতএব, মিরর পত্রিকা বগলে নিয়ে আবার হণ্টন। আরও প্রায় আধঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সাফল্য। রাস্তার নাম বোমন্ট স্ট্রিট। পথে ঢুকতেই সিবিএস নিউজের গাড়ি। বাঁয়ে ঘুরতেই সেই বিখ্যাত দৃশ্য। দুয়ারে সার্বক্ষণিক দুই নিরাপত্তাপ্রহরী। সেই হাসপাতালের প্রবেশদ্বার—বিবিসি, স্কাই নিউজের সুবাদে যেটা চেনা হয়ে গেছে গোটা বিশ্বের মানুষের। কিং এডওয়ার্ড হাসপাতাল! এখানেই চিকিৎসাধীন ব্রিটিশ রাজপুত্রবধূ কেট মিডলটন। তাঁর ‘মর্নিং সিকনেস’ নয়। বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের অতিরিক্ত আগ্রহের মূল কারণ কেট মিডলটন সন্তানসম্ভবা! গোটা দুনিয়ার সংবাদমাধ্যম তাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে এই হাসপাতালের সামনে। আগের দিন যুবরাজ উইলিয়াম এসেছেন অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে। বিবিসি এবং স্কাই নিউজের মধ্যে অলিখিত প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। ব্রিটেনের বাইরের সংবাদমাধ্যমও পিছিয়ে নেই। এক নারী সাংবাদিককে দেখছি সম্প্রচার গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে কায়দা করে ক্যামেরার সামনে কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু কোনোটাই তাঁর ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। পাঁচবারের মাথায় অ-ইংরেজ নারী সাংবাদিক জায়গা পাল্টালেন। তাঁর সঙ্গী ক্যামেরা পারসনের অসীম ধৈর্য। মোটামুটি দশম বারের মাথায় শট ‘ওকে’ হলো। নারী সাংবাদিক ও পথচারীরা (যাঁরা এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন শট ওকে হলে রাস্তা পেরোবেন বলে।) হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
লন্ডনের সময় বেলা দুটা। সামনে কিং এডওয়ার্ড হাসপাতাল। রাস্তার উল্টো পারে ফুটপাত দখল করে রাজ্যের সাংবাদিকের ভিড়। হাড় কাঁপানো শীত। কিন্তু কারও নড়ার লক্ষণ নেই।
দু-তিন দিন ধরে এই ঘটনা চলছে। সঙ্গে ক্যামেরা আছে। বেশ কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের সেই বিখ্যাত সদর দরজার।
এপির লোগোযুক্ত একটা ছাতা দেখতে পাচ্ছি। তার মানে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস হাজির। জ্যাকেট পাল্টাচ্ছেন এক রিপোর্টার। গলায় ঝোলানো পরিচয়পত্র—বিবিসি! পাশেই স্কাই নিউজের ক্যামেরাম্যান। হাসপাতালের দিকে ক্যামেরা তাক করে বসে আছেন চুপচাপ। অসীম ধৈর্য। আগের দিন উইলিয়াম এসে দেখে গেছেন। আজকে জোর গুজব, কেট মিডলটনের মা-বাবা আসতে পারেন। সেই দৃশ্য মিস করা যাবে না কিছুতেই।
বেন নামের আরেক আলোকচিত্রীর সঙ্গে কথা হলো। বেন কাজ করেন লন্ডনের একটি সংবাদ এজেন্সির হয়ে। দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। বেন সকাল থেকে আছেন এই হাসপাতাল এলাকায়। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলিয়ে। ‘তোমার কি মনে হয় ওরা আজকে আসবে?’ ওরা মানে কেট মিডলটনের মা-বাবা।
বেন কাঁধ ঝাঁকালেন। তার মানে হ্যাঁ অথবা না দুটোই হতে পারে।
‘তুমি এত দূর এসেছ শুধু কেট মিডলটনের নিউজ কাভার করতে?’
বেন বিশ্বাসই করতে চান না বাংলাদেশ থেকে একজন সাংবাদিক চলে এসেছে শুধু এই খবরের টানে।
বেনের বিস্ময়ের জবাবে আমিও তার মতো কাঁধ ঝাঁকালাম। যার উত্তর হ্যাঁ অথবা না দুটোই হতে পারে।
দুঁদে সাংবাদিকদের ভিড়ে খুঁজে পেতে এক ব্যতিক্রমী সাংবাদিককে পাওয়া গেল। ছেলেটার নাম গাই লংবটম। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়েছে। শখের সাংবাদিক। কেট মিডলটন এখানে আছেন জেনে স্রেফ নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছে লংবটম। পেশাদার সাংবাদিকদের সঙ্গে দল বেঁধে ঘুরছে। তার কৌতূহলের শেষ নেই।
চারটা প্রায় বাজতে চলল। একজন ট্রলি নিয়ে ঢুকছিল হাসপাতালে। নিরাপত্তাপ্রহরীরা তাকে আটকেছে। রীতিমতো জেরা। পথ চলতি লোকজনেরও হাসপাতালের গেটে দাঁড়িয়ে উঁকি-ঝুঁকি দেওয়ার উপায় নেই। কেটের মা-বাবা বা রাজপরিবারের কেউ আসবেন সে লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু সাংবাদিক-ফটোশিকারিদের অপরিসীম ধৈর্য। তাঁরা বসে আছেন নির্বিকার।

কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালের সামনে থেকে চলে এসেছি। পরদিন চলে গেছি অক্সফোর্ড।
এর মধ্যে কেট মিডলটনবিষয়ক খোঁজখবর নেওয়া হয়নি। ৮ ডিসেম্বর সকালবেলা। খবর পেলাম, অবিশ্বাস্য দুঃখজনক এক ঘটনা ঘটে গেছে কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালে। ঘটনা সংক্ষেপে এ রকম—
অস্ট্রেলিয়ার দুই আরজে (রেডিও জকি) প্রিন্স চার্লস ও রানি এলিজাবেথ সেজে ফোন করেছিলেন হাসপাতালে। দায়িত্বরত সেবিকা যচিন্থা সালডানা সরল বিশ্বাসে সেই ফোনটি দিয়েছিলেন কেটের সেবা-শুশ্রূষার কাজে নিয়োজিত সেবিকাকে। স্বয়ং রানি বলে কথা! অতএব তাঁরা কেটের শারীরিক অসুস্থতার সব তথ্য জানিয়ে দিয়েছিলেন ঠিকঠাক। তাঁদের সেই কথোপকথন প্রচারও হয়ে যায় রেডিওতে।
হয়তো বড়সড় একটা রসিকতাই করতে চেয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার টুডে এফএম রেডিওর দুই আরজে। কিন্তু রসিকতার পরিণতি এমন হবে কে জানত। ৪৬ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভূত সেবিকা যচিন্থা এই রসিকতার শিকার হওয়ার লজ্জা সইতে পারেননি হয়তো। ঘটনা প্রচার হওয়ার পর যচিন্থাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় হাসপাতালের লাগোয়া নিজের কোয়ার্টারে। গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। কবজিতে ছিল জখমের চিহ্ন। দুই সন্তানের জননী যচিন্থা প্রায় চার বছর ধরে কাজ করছিলেন এই কিং এডওয়ার্ড হাসপাতালে।
বিবিসির পর্দায় দেখছি, সাংবাদিকদের অপেক্ষার পালা ফুরিয়েছে। কিং এডওয়ার্ড হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠছেন কেট মিডলটন। হাতে হলুদ ফুলের তোড়া। কেটের মুখে হাসির আভা আছে। কিন্তু হাসিটা কি একটু মলিন ঠেকল শেষে?
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বহিষ্কার করা হয়েছে অস্ট্রেলিয়ান সেই দুই রেডিও জকি মেল গ্রেগ এবং মিশেল ক্রিশ্চিয়ানকে। ভারতের কর্নাটকের সেবিকা যচিন্থার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, তাঁর একটি ‘সুইসাইড নোট’-এ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করেছিলেন যচিন্থা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, তাঁর সেই প্রাণঘাতী ‘ভুল’-এর জন্য কোনোভাবেই তারা দোষারোপ বা সমালোচনা করেনি যচিন্থার।

No comments

Powered by Blogger.