ট্রেন কেড়ে নিল রত্নাকে

রাজধানীর খিলগাঁও রেললাইনের লেভেলক্রসিংয়ে গতকাল শুক্রবার ট্রেনের ধাক্কায় প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশাসহ তিনটি রিকশা দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন রত্না খন্দকার (৩৫) নামের এক গৃহবধূ।
আহত হয়েছে তাঁর দুই শিশুসন্তান খন্দকার আশফাক রিফাত (১৪) ও খন্দকার আতিকা সুলতানা রশ্মি (৭)। তাদের বহনকারী রিকশার চালক শহিদুল ইসলামও (৩০) গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতরা জানিয়েছেন, কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা লালমনিরহাটগামী লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি সকালে খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ে পৌঁছার সময় রেললাইনে যানবাহন ওঠে গেলে এ দুর্ঘটনা ঘটে। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, একটি ট্রেন যাওয়ার পর গেটম্যান ব্যারিয়ার উঠিয়ে ফেললে আরেকটি ট্রেন চলে আসে। সকালে দুর্ঘটনাস্থল কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। তবে গেটম্যান ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ঘটনার সময় ব্যারিয়ার আটকানো ছিল। যে
যানবাহনগুলো দুর্ঘটনায় কবলিত হয়েছে, সেগুলোর চালকরা দ্রুত যাওয়ার জন্য ব্যারিয়ারের পাশের রাস্তা দিয়ে রেললাইন ওঠে পড়েন। কমলাপুর রেলওয়ে থানার পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোরিকশাটি আটক করেছে। এসব যানবাহনের চালকদের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে পুলিশ।
মোহাম্মদ হাসান ও রুপালি নামের দুই পথচারী প্রত্যক্ষদর্শী কালের কণ্ঠকে জানান, সকাল ৭টা ২০ মিনিটের দিকে খিলগাঁও রেলক্রসিংয়ে লালমনি এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটির ধাক্কায় রেললাইনে থাকা কয়েকটি যানবাহন দুমড়ে-মুচড়ে যায়। ট্রেনটি চলে যাওয়ার পর একটি রিকশার যাত্রী এক নারীকে মারাত্মক জখম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। পাশেই রক্তাক্ত হয়ে পড়ে ছিল দুটি শিশু এবং রিকশার চালক। পথচারীরা কাছে গিয়ে নিশ্চিত হন নারীটি মারা গেছেন। দুই শিশুকে উদ্ধার করে প্রথমে মালিবাগের খিদমাহ হাসপাতাল এবং পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান হাসান ও রুপালি। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় রিকশাচালকেও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। মায়ের লাশের পাশে পড়ে থাকা দুই শিশুকে বাঁচাতে ছুটে যাওয়া হাসান ও রুপালি সাংবাদিকদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা টিভির সাংবাদিকদের গাড়িতে করে শিশুদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। পাঁচ-ছয়টি গাড়ি থাকলেও কেউ আমাদের সহায়তা করেনি।'
প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে রিকশাচালক সোলায়মান, স্থানীয় বাসিন্দা রহমত আলীসহ কয়েকজন জানান, সকালে রেলক্রসিং এলাকা কুয়াশাচ্ছন্ন ছিল। লালমনি এক্সপ্রেস যাওয়ার আগে একটি মালবাহী চার বগির ট্রেন যায়। ট্রেনটি যাওয়ার পর কিছু সময়ের জন্য ব্যারিয়ার ওঠানো হয়। আবার ব্যারিয়ার ফেলে দেওয়া হয়। এই ফাঁকে রাস্তা ধরে এবং ব্যারিয়ারের পাশের ফাঁকা জায়গা দিয়ে কয়েকটি যানবাহন রেললাইনে ঢুকে পড়ে। সব যানবাহনই তিলপাপাড়ার দিক থেকে তালতলা-শাহজাহানপুরের দিকে যাচ্ছিল। অনেকে অভিযোগ করে, এখানে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা নাভানা হিউম্যান হলার ও লেগুনার স্ট্যান্ড এবং রেললাইনের জায়গা দখল করে কাঁচাবাজার বসানোর কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই ক্রসিংয়ে সব সময়ই যানজট লেগে থাকে।
স্বজনরা জানায়, নিহত রত্না খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ার ৪ নম্বর রোডের ৩১৬/এ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রিপন খন্দকারের স্ত্রী। গতকাল সকালে তিনি ছেলে রিফাত ও মেয়ে রশ্মিকে নিয়ে রিকশায় করে পুরান ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে যাচ্ছিলেন। রিপনের ভগ্নিপতি আবদুল লতিফ জানান, রিপন গত ১০ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয় এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন। তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সন্তানদের নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতেই কারাগারে যাচ্ছিলেন রত্না। রিপন বনানীর একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক। নিহত রত্নার গ্রামের বাড়ি নরসিংদীর বেলাব উপজেলায়।
গেটম্যানের বক্তব্য : দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংয়ে কর্তব্যরত গেটম্যান মজিবুর রহমান ব্যারিয়ার ওঠানোর অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'দুর্ঘটনার সময় গেট আটকানো ছিল। কিন্তু পাশের ভুল রাস্তা দিয়ে যানবাহন চালকরা রেললাইন পার হওয়ার চেষ্টা করলে দুর্ঘটনা ঘটে।' গেটম্যান দাবি করেন, এভাবে লাইন পার হওয়ার সময় বাধা দেওয়া হলেও কেউ কথা শোনে না। উল্টো মারধর করে।
দুর্ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মজিবুর জানান, ট্রেনটি দেখে প্রাইভেট কারচালক ও সিএনজি অটোচালক গাড়ি থেকে বেরিয়ে নিরাপদে চলে যান। অন্য দুটি রিকশার চালক ও রিকশার যাত্রীরা যেতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শী মজিব জানান, ওইসব রিকশা, অটো ও প্রাইভেট কারে যাত্রী ছিল না। যে রিকশায় যাত্রী ছিল সেটি ছিল পেছনে। তারা সরতে পারেনি।
মামলা ও পুলিশের বক্তব্য : কমলাপুর জিআরপি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার কামাল কালের কণ্ঠকে জানান, ব্যারিয়ার দেওয়া থাকলেও তিলপাপাড়ার দিক থেকে আসা কয়েকটি যানবাহন রেললাইনে উঠে যায় বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এ কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। রেললাইনের পাশ থেকে প্রাইভেট কার (ঢাকা মেট্রো-গ-১৫৭৪০৮) ও সিএনজি অটোরিকশা (ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-২১৩০) আটক করা হয়েছে। দুর্ঘটনার পর রত্না নামের ওই রিকশা আরোহীকে খিদমাহ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে।
কমলাপুর জিআরপি থানার ওসি আলাউদ্দিন চৌধুরী বলেন, সকাল সোয়া ৭টায় লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে লালমনিরহাটের উদ্দেশে যাত্রা করে। রেলক্রসিংয়ে বেপরোয়াভাবে ঢুকে পড়ার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনায় আরো প্রাণহানি হতে পারত। ওসি আরো বলেন, এ ঘটনায় অজ্ঞাতপরিচয় প্রাইভেট কার ও সিএনজি অটোচালককে আসামি করে থানার এএসআই সিরাজুল ইসলাম বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। তদন্ত করে অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আহতদের অবস্থা : দুর্ঘটনায় আহত তিনজনের মধ্যে শিশু রশ্মি ও রিকশাচালক শহিদুল ইসলামের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছে চিকিৎসকরা। শিশু রশ্মি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ২০৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। শহিদুল আছেন একই হাসপাতালের ১০১ নম্বর ওয়ার্ডে। রিফাতকে চিকিৎসা দেওয়ার পর গতকাল বিকেলে তার ফুফা আবদুল লতিফের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। রশ্মির সারা শরীরে থেঁতলানো জখম আছে। শহীদুলের মাথা ও পায়ে জখম আছে। আমেনা ফেরদৌসী নামের এক প্রতিবেশী জানান, রশ্মির পুরো পিঠের চামড়া উঠে গেছে। মাথা ফেটে গেছে। বাম হাতে একটি লোহার রড ঢুকেছে।

No comments

Powered by Blogger.