জীবন দিয়ে দুই সন্তানকে বাঁচালেন মা by এস এম আজাদ

'আম্মু, আব্বু কোথায়? আব্বুর কাছে যাব'- কয়েক দিন ধরে সাত বছরের রশ্মি সারাক্ষণ মাকে এ কথা বলছিল। 'কালই আমরা যাব'- এ কথা বলে প্রতিদিনই শিশুসন্তানকে সান্ত্বনা দিতেন মা রত্না। আর আড়ালে লুকিয়ে ফেলতেন চোখের পানি।
কত দিন হলো স্বামী রিপন খন্দকারকে তিনিও দেখছেন না! 'জেলখানায় না জানি কেমন আছে সে। কী খায়, না খায়। বাইরের পানি পান করে না রিপন। রান্না করে খাবার নেওয়া যাবে তো জেলখানায়?' - নিজে খেতে বসে এসব ভেবে গলা দিয়ে যেন খাবার ঢুকত না রত্নার। দুঃখ করে ছেলে রিফাতকে বলেছেন, 'তোর আব্বু সেখানে না খেয়ে মরে যাবে রে। ওর জন্য পানি আর কিছু খাবার নিতে হবে।' শুক্রবার রিফাতের স্কুল বন্ধ। তাই ছেলের সঙ্গে কথা বলে শুক্রবারই একবার স্বামীকে দেখতে যাবেন বলে ঠিক করেন রত্না। কাকডাকা ভোরে উঠে দুই সন্তান নিয়ে রিকশায় চেপে রওনাও হন। রেলক্রসিংয়ে ওঠার পর হঠাৎ দেখেন দ্রুতগতিতে একটা ট্রেন ছুটে আসছে তাদের দিকে। প্রাণ বাঁচাতে শুরু হয়ে যায় ছোটাছুটি। রত্না দুই সন্তানকে বাঁচাতে তাদেরকে রিকশা থেকে নিরাপদ দূরত্বে ছুড়ে ফেলেন। কিন্তু নিজেকে আর সরাতে পারেননি। মর্মান্তিক দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তাঁর জীবন। শেষবারের মতো স্বামীর মুখ আর দেখা হলো না। বাচ্চারা হয়তো কিছুদিন বাদেই ফিরে পাবে তাদের বাবাকে। কিন্তু মা যে হারিয়ে গেল চিরদিনের জন্য।
মায়ের মৃত্যুর পর গতকাল ছেলে খন্দকার আশফাক রিফাত ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সকালে খিলগাঁও রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মায়ের মৃত্যুর সময় ১৪ বছরের রিফাতও ছিল তাঁর সঙ্গে। আরো ছিল তাঁর সাত বছর বয়সের বোন খন্দকার আতিকা সুলতানা রশ্মি। রিফাত কিছু কথা বললেও মাকে হারিয়ে রশ্মি ছিল পুরোপুরি নির্বাক। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র রিফাত জানায়, তার বাবা রিপন খন্দকার গত ১০ ডিসেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হন। তিনি বনানীর একটি রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক। রিফাতের দাবি, তার বাবা গণগ্রেপ্তারের শিকার। কেন্দ্রীয় কারাগারের হাজতে থাকা বাবাকে দেখার জন্য রশ্মি খুব কান্নাকাটি করত। নানা দুশ্চিন্তায় অস্থির ছিলেন রিফাতের মা-ও। গত বৃহস্পতিবার রিফাতকে তার মা বলেন, 'কাল তোর স্কুল বন্ধ, আমরা কালই যাব। এ নিয়ে মা-ছেলে মিলে নানা পরিকল্পনাও করে। হাজতে রান্না করা খাবার নেওয়া যাবে কি না, তা জানা না থাকায় তারা কিছু বিস্কুট নিয়ে যাবে বলে ঠিক করে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে রওনা হয় তারা।'
রিফাত জানায়, রেলক্রসিংয়ের একটি ট্রেন যাওয়ার পর ব্যারিয়ার তুলে দেওয়া হয়। তাদের রিকশাসহ কিছু যানবাহন সেই ফাঁকে ঢুকে পড়ে। পাশের রাস্তা দিয়ে ঢোকে দু-একটি। কিন্তু ট্রেন দেখে আবার ব্যারিয়ার ফেলে দেওয়া হয়। তখন আর যানবাহনগুলো সরতে পারেনি। প্রাইভেটকার ও রিকশা থেকে সব মানুষ রাস্তার পাশের দিকে দ্রুত সরে যায়। তারা মাঝে আটকা পড়ে যায়। মা প্রথমে রিফাতকে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে দূরে ফেলে দেন। পরে ফেলে দেন রশ্মিকে। এরপর ট্রেন এসে তাদের রিকশাটিকে গুঁড়িয়ে দেয়। দুর্ঘটনার সময় রিফাতের বাবার জন্য নেওয়া পানির বোতল ও বিস্কুটের প্যাকেটটা তার মায়ের হাতেই ধরা ছিল।

No comments

Powered by Blogger.