রাজনীতি-উপায় গণতন্ত্র, উদ্দেশ্য মৌলবাদী স্বৈরতন্ত্র by অনিরুদ্ধ আহমেদ

গলার জোরে (এবং গায়ে জোরেও) গণতন্ত্রের কথা যারা বলেন, তাদের বোধকরি সবার আগে এই বিষয়টি স্থির করা প্রয়োজন, যে গণতন্ত্রকে তারা ক্ষমতা আহরণের কিংবা ক্ষমতায় আরোহণের একটি উপায় হিসেবে মনে করছেন, নাকি গণতন্ত্রকে তারা লক্ষ্য হিসেবে ভাবছেন।
মিসরের কথিত ইসলামপন্থি দল, মুসলিম ব্রাদারহুড, হোসনি মোবারকের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রকৃত অর্থে ছিনতাই করে নেয়। এই একই ঘটনা ঘটেছিল ইরানে, ১৯৮৯ সালে যখন ইরানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগে মোল্লারা ক্ষমতা দখল করে। সত্য বটে, ইরান ও মিসর উভয় জায়গাতেই যথাক্রমে রাজতন্ত্র এবং স্বৈরতন্ত্র মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করেছিল; কিন্তু বৈপল্গবিক আন্দোলনের সুফলটুকু যারা ভোগ করছেন ক্ষমতাসীন হয়ে, তারা কি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মেনেছেন? এ জিজ্ঞাসার জবাব সম্পূর্ণ নেতিবাচক। আরব বসন্তে গণতন্ত্রের যে ফুল ফোটার কথা ছিল, কথা ছিল যে ফল ফলাবার, তার আগেই ফল তো দূরের কথা, ফুলই গেছে ঝরে। সাময়িক গণতন্ত্রের সুবিধাটুকু ভোগ করেছে নির্বাচনে জয়লাভ করে ইসলামিক ব্রাদারহুড। কিন্তু নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের পর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি নিজেই সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত করলেন, তার দলের সংখ্যাধিক্যে গঠিত আইন পর্ষদ যাতে নির্বিঘ্নে ইসলামী সংবিধান রচনা করতে পারেন সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, মোহাম্মদ মুরসি, যাকে অনেকেই মধ্যপন্থি বলে মনে করেন কট্টর একটি সংবিধানও কথিত গণতান্ত্রিক উপায়ে অনুমোদন করিয়ে নেবেন। প্রথম দফা গণভোট শেষে মুসলিম ব্রাদারহুড দাবি করছে, ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রথম দফার ভোটে তারা রায় পেয়ে গেছে। অনুমান করা যায় যে, দ্বিতীয় দফার গণভোটেও ছলে-বলে-কৌশলে মুরসি জয়ী হবেন। কিন্তু তারপরই তার মধ্যপন্থি দৃষ্টিভঙ্গির অবসান ঘটবে, স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করবেন তিনি, আবারও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে। ১৯২৮ সালে মিসরের একজন স্কুলশিক্ষক হাসান আল বান্না যখন এই মুসলিম ব্রাদারহুড দলটি গঠন করেন, তখন তার লক্ষ্যই ছিল সরকার সংগঠন এবং পরিচালনায় কট্টর শরিয়া আইন চালু করা। আরব বসন্তের সুযোগ নিয়ে এসব ইসলামী মৌলবাদী দল মিসরে এবং অন্যত্রও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগে সুনি্ন জঙ্গিরা তৎপর রয়েছে বলে আসাদের অভিযোগ পুরোপুরি অগ্রাহ্য করার মতো নয়।
মুসলিম ব্রাদারহুডের মতোই জামায়াতেরও প্রতিষ্ঠা একই লক্ষ্যে। ১৯৪১ সালে মওদুদি যখন জামায়াত প্রতিষ্ঠিত করেন, তখন থেকে এ পর্যন্ত জামায়াত একটি ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে। আর এই ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার মানে হচ্ছে সেখানে অসাম্প্রদায়িক কোনো ব্যক্তির স্থান সংকুলান হবে না। অমুসলমান তো দূরের কথা, আহমদিয়া মুসলমানদের প্রতি জামায়াতের যে নৃশংস আচরণ তৎকালীন পাকিস্তানে এবং মাঝে মধ্যে বাংলাদেশেও তাদের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার যে প্রবণতা, তাদের অমুসলিম হিসেবে ঘোষণার যে দাবি এসব কিছুই জামায়াতের আদর্শকে গণতন্ত্রের পরিপন্থী করে তুলেছে। স্থানীয় রাজনীতি কিংবা আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বিধানের জন্য বাংলাদেশে এই দলটি ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে তাদের গঠনতন্ত্রে কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছে_ প্রধানত এটা প্রমাণ করার জন্য যে জামায়াত একটি আন্তর্জাতিক দল নয়, নিতান্তই একটি জাতীয় দল। কিন্তু জামায়াতের মৌলিক আদর্শই জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এক সময়ে তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিল। কারণ মূলত এর প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহর পাশ্চাত্য ধরনের জীবনযাত্রা দেখে তারা নিশ্চিত হয়েছিল যে, ধর্মের জিকির তুলে পাকিস্তান একটি পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও পরে পাকিস্তান একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হয়ে যেতে পারে। তবে জামায়াতের ভাগ্য ভালো যে, জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তান কিন্তু ধাপে ধাপে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে এবং অতএব, পাকিস্তানের আদর্শিক সমর্থক হয়ে দাঁড়াল এই জামায়তে ইসলামী। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সক্রিয় বিরোধিতা করেছে তারা। সেই বিরোধিতা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, কতখানি নৃশংস হতে পারে, সে তো আমাদের জানা ইতিহাস। বাংলাদেশে বহুদলীয় শাসনের নমুনা হিসেবে জিয়াউর রহমানের আনুকূল্যে জামায়াত আবারও রাজনীতি করার সুযোগ পেল। সেই থেকে জামায়াত যে বিভ্রান্তিমূলক কথা বলে আসছে, সেটি হলো তারা গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। সে কথা ইরানের ইসলামী বিপল্গবীরাও বলেছিলেন, বলছেন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডও; কিন্তু কেউ কথা রাখেনি, রাখবে না।
জামায়াতে ইসলামীকে গণতন্ত্র মানতে হলে তাদের শরিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। জামায়াতের গঠনতন্ত্রে নানাবিধ লোক দেখানো সংশোধনীর পরও ইসলামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কথা জামায়াত বলছে। সোনার পাথরবাটির এই কনসেপ্ট থেকে জামায়াত বেরিয়ে না এলে গণতান্ত্রিক দল হিসেবে তাদের স্বীকৃতি প্রশ্নসাপেক্ষ হবে। বিভিন্ন সময়ে আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধুর প্রশ্নের জবাবে জামায়াত নেতারা কখনোই বলতে পারেননি, কোরআন ও সুন্না অনুযায়ী দেশ শাসনের কোনো সূত্র কোরআনে আছে কি-না। তারা যে আদর্শ শাসন ব্যবস্থার কথা বলেন, সে রকম আদর্শ ব্যবস্থা কোনো দেশে আদৌ চালু আছে কি-না, সে ব্যাপারেও তারা কিছু বলতে পারেন না। ইসলামের উৎপত্তি যে দেশে, সে দেশের রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা কিংবা ইরানের মোল্লাশাসিত নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র কোনোটাই যে ইসলামী নয় জামায়াতও সে কথা অকপটে স্বীকার করে।
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ করার যে দাবি উঠেছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের যুক্তি খুব যে অগ্রাহ্য করার মতো তা হয়তো নয়। প্রথমত, গণতান্ত্রিক একটি রাষ্ট্রে সব দলের রাজনীতি করার অধিকার আছে। অতএব, জামায়াত কিংবা যে কোনো দলের নিষিদ্ধকরণ কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়; দ্বিতীয়ত, কেউ কেউ আবার হয়তো ভাবতে পারেন যে, আওয়ামী লীগ সরকার জামায়াত নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে হয়তো বাকশালের যুগেই প্রবেশ করছে। সেটাও কাঙ্ক্ষিত কোনো ব্যাপার হতে পারে না। অতএব, তাত্তি্বকভাবে জামায়াত কেন, কোনো রাজনৈতিক দলেরই নিষিদ্ধকরণের প্রশ্নই ওঠা উচিত নয়। তবে বাস্তব ও ব্যবহারিক দিকটি বিবেচনা করলে দেখা যাবে যে, গণতান্ত্রিক সমস্ত পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়ে জামায়াতে ইসলামী যদি ক্ষমতায় আসে, তখন গণতন্ত্র বিকৃত হয়ে দলতন্ত্রে পরিণত হবে। যে মজলিসে শূরা তারা গঠন করবেন, তাদের নিজেদেরই গঠনতন্ত্র হিসেবে তাতে কোনো অমুসলমানের স্থান থাকবে কি? দেশে ইসলামী দল বাদে অন্য কোনো দলকে কি রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে? নির্বাচনের মনোনয়ন পদ্ধতি কি ইরানের মনোনয়ন পদ্ধতির মতো, ইসলামী কাউন্সিল দ্বারা প্রাক্-অনুমোদিত হতে হবে? এ প্রশ্নগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামী দলের রাজনীতি করার অধিকার নিয়ে কেউ যদি আপত্তি জানায়, তা হলে তার পেছনেও যুক্তি থেকেই যাচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী দল যদি ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটসদের মতো, গণতন্ত্রকে মেনে নিয়ে সমাজের রক্ষণশীল নীতিকে বাস্তবায়িত করতে চায়, তা হলে সেটা গণতান্ত্রিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতেই পারে। জামায়াতে ইসলামী এখন যাদের বয়স পঞ্চাশের কম, তারা রাজাকার, আলবদর নয় অথচ তারা বহন করছে তাদের নেতাদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের ভার। এর কারণ তারাও বিশ্বাস করে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা যা কি-না গণতন্ত্রের সহায়ক নয়, ইসলামী তো নয়ই। সে জন্য দাবি উঠছে তাদের নিষিদ্ধকরণের। জামায়াতের রাজনৈতিক আদর্শে এবং তাদের ব্যবহারিক আচরণে সত্যিকারের সংস্কার না আসা পর্যন্ত গণতন্ত্রের নামে রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের অবাধ বিচরণ কতটা যুক্তিসঙ্গত তাও ভেবে দেখা দরকার। যারা জামায়াত নিষিদ্ধকরণের দাবিতে গণতন্ত্র ধ্বংস হলো বলে হয়তো দুঃখ প্রকাশ করবেন, তাদের মুদ্রার অপর পিঠটিও বিবেচনায় নিতে হবে। গণতন্ত্রের মই বেয়ে যে দলটি ক্ষমতার শীর্ষে যেতে চায়, ক্ষমতায় গিয়ে দলটি তাদের দলীয় ইসলামী গঠনতন্ত্র অনুসরণ করতে গিয়ে যে সে মই সরিয়ে ফেলবে না, সে নিশ্চয়তা কোথায়? সে জন্যই জামায়াতকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূলধারায় থাকতে হলে, ব্যাপক সংস্কার সাধন করতে হবে দলে। নইলে বর্তমান অবস্থায় জামায়াত কেবল 'গণতান্ত্রিক'ভাবে মৌলবাদী স্বৈরতন্ত্রই স্থাপন করতে পারে।

অনিরুদ্ধ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক ও নিবন্ধকার

No comments

Powered by Blogger.