প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি- সরকারি নীতিমালা অগ্রাহ্য by তুহিন ওয়াদুদ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুর প্রথম পাঠ হচ্ছে প্রথম ভিত্তি। সেই ভিত্তি গড়ে তোলায় রয়েছে বিবিধ বিশৃঙ্খলা। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকারের চেষ্টা সত্ত্বেও প্রথম শ্রেণীর প্রবেশপদ্ধতি-পাঠক্রম-পাঠপদ্ধতিতে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আসেনি।
বর্তমান সরকার প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা না নিয়ে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত সাধুবাদ পাওয়ার মতো। প্রথম শ্রেণীতে শিশুর প্রথম পাঠ হবে। সুতরাং তাদের প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে না। আর তা ছাড়া ভর্তিযুদ্ধে শিশুসন্তানকে টিকিয়ে রাখতে পিতা-মাতারা যে অমানবিক চাপ প্রয়োগ করেন, সেটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কিন্তু সরকারের এ সিদ্ধান্ত দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানা হচ্ছে না।
২৪ ডিসেম্বর ২০১১ সালে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিশৃঙ্খলা দূরীকরণে সরকার ভর্তির নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি-প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়ে যুগোপযোগী, অধিকতর স্বচ্ছ প্রক্রিয়া করার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘১ম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য আবশ্যিকভাবে লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচন করতে হবে। ভর্তি কমিটির সদস্যদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে। লটারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অপেক্ষমাণ তালিকা প্রস্তুত রাখতে হবে।’ সরকারের এ সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করেছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
অনেক প্রতিষ্ঠানে লিখিত পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠানে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে। সরকারের নীতিমালা যথাযথভাবে না মানার নানান ফাঁক খোঁজা হচ্ছে। কী বিস্ময়ের বিষয় যে আমরা সরকার প্রবর্তিত ভর্তিপদ্ধতির ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। তবে, পরীক্ষা মৌখিক-লিখিত, যাই-ই হোক না কেন, এ পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে শিশুদের জন্য সেই ভয়ংকর বাস্তবতা অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। আমরা শিশুদের খেলার মাঠ চেনানোর পরিবর্তে কোচিং সেন্টার আগে দেখাই। শরীরের কোমল হাড়গুলো শক্ত হওয়ার আগেই পিঠের ওপর অনেক বড় বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিই। আক্ষরিক অর্থেই সেগুলো আলোর ভান্ডার না হয়ে ভার অর্থে যে বোঝা, তা-ই হয়ে থাকে। সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করার পরও যদি মৌখিক পরীক্ষা কিংবা লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তাহলে নীতিমালা শুধু কাগুজে নীতিমালাই হয়ে থাকবে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ বছর রংপুর ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজে ১৯১১ জন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির আবেদন করলে মৌখিক পরীক্ষা ও মেডিকেল টেস্ট পরীক্ষায় প্রায় এক হাজার জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুই রকম চিত্র লক্ষ করা গেছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার মূল্যায়নপূর্বক ছাঁটাই করে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে কিন্তু নীতিমালা সম্পূর্ণরূপে মেনে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ শুধু লটারির মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি করাচ্ছে। এ রকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষাপদ্ধতি চালু রয়েছে। এই যদি হয় বাস্তবতা, তাহলে অভিভাবকেরা লিখিত পরীক্ষা হলে যে পরিমাণ লেখাপড়ার চাপ প্রয়োগ করতেন, শিশুর ওপর এখনো তাই-ই করবেন। তবে এখন শুধু শিশুকে পড়িয়ে হবে না, তার সঙ্গে প্রয়োজন হবে তদবির। যেহেতু মৌখিক পরীক্ষায় বাদ যাবে অনেক শিক্ষার্থী, সে জন্য অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-পারিবারিক-প্রশাসনিক—সব ধরনের তদবিরের পথ উন্মোচিত হবে।
হায় বাংলাদেশ! সরকারের দেওয়া লটারিও থাকল, নিজস্ব পদ্ধতির লিখিত-মৌখিক পরীক্ষাও থাকল। আমরাও হতাশাগ্রস্ত মানুষ তা-ই মেনে নিচ্ছি। এই শিশুগুলো যদি আন্দোলন করতে পারত, তাহলে নিশ্চয়ই এ রকম করা সম্ভব হতো না। ভর্তি নীতিমালার কোথাও বলা নেই যে লটারির মাধ্যমে ভর্তি না করলে সরকার তার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেমন অতিরিক্ত অর্থ আদায় করলে সরকার সেই স্কুলের এমপিও বাতিল করবে বলে উল্লেখ করেছে। সেই মর্মে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের দায়ে মনিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে। তাদের এমপিও বাতিল করলেই হবে না, যাঁরা ওই স্কুলগুলোর সভাপতি, তাঁদের সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। কারণ, অর্থ আদায়ের সিদ্ধান্ত দেয় ব্যবস্থাপনা পরিষদ। যাঁর সভাপতি অধ্যক্ষ নন। কিন্তু যে স্কুলগুলো এমপিওভুক্ত নয়, তারা ইচ্ছেমতো টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। শাস্তিতে তাদের কিছুই যায়-আসে না। কিন্তু যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রথম শ্রেণীতে লটারির বাইরেও মেধার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর জন্য সরকারকে এখনো কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ না মানে, তাহলে আমাদের মনে করতে হয় যে তারা আসলে সরকারের তোয়াক্কাই করে না। আর সরকারকে তোয়াক্কা না করলেও যে কোনো শাস্তি হয় না, হলেও লঘু শাস্তি, সেটা তারা মেনে নিয়েই এ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সরকার যদি নীতি প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক হয়, তাহলে যে স্কুলগুলোতে মৌখিক-লিখিত পরীক্ষার নামে পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাতিল করা হোক। পরীক্ষার মাধ্যমে যদি অধিক মেধাবীদের ভর্তি করানো হয়, তাহলে স্কুলের কৃতিত্ব কী থাকে? বরং লটারির মাধ্যমে সব মেধার শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হতো, তাহলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই ভালো মানের হয়ে উঠত এবং নির্দিষ্ট গুটি কয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপ কমত।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দেখা যায়, সরকার-নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অনেক বই পড়ানো হয়। সরকারের উচিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্য সরকার-নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে যেন অন্য কোনো বই না পড়ানো হয়, তা নিশ্চিত করা। সরকার-নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক অনুযায়ী শিশুরা প্রথম শ্রেণীতে বর্ণপরিচয় শিখবে, সংখ্যার ধারণা লাভ করবে। প্রথম শ্রেণীর জন্য এ পাঠক্রম বজায় থাকলে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা শিক্ষার্থীরা প্রথম শ্রেণীর পাঠ গ্রহণে কোনো অসুবিধায় পড়বে না। শুধু লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করালেই হবে না, তাদের ওপর প্রথম শ্রেণীতে যাতে করে বাড়তি চাপ না পড়ে, সে বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে।
এ বছর দেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই লটারির মাধ্যমে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির কার্যক্রম চলছে। কিন্তু যেগুলোতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হলো না, সেগুলোর বিষয়ে আমরা সরকারের দৃষ্টান্তমূলক হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।
 তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@-gmail.com

No comments

Powered by Blogger.