প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির বাংলাদেশ by নাজমুস সাকিব অনিক

'স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কঠিন। আজ আমাদের অস্ত্রের সংগ্রাম শেষ হয়েছে। এবার স্বাধীনতার সংগ্রামকে দেশ গড়ার সংগ্রামে রূপান্তর করতে হবে। মুক্তির সংগ্রামের চেয়েও দেশ গড়ার সংগ্রাম কঠিন। তাই দেশ গড়ার কাজে আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
' সদ্য স্বাধীন হওয়া ধুলোমাটির দেশে যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে উক্তিটি করেছিলেন আমাদের স্বাধীনতার নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার মূল্য তিনি এর প্রাপ্তিলগ্নেই জাতিকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। সেই মূল্য আমাদের পূর্বসূরিরা কতটুকু উপলব্ধি করেছিলেন জানি না।
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে আটবার সরকার বদল হয়েছে। এর মধ্যে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া দু'জন নেতাকে খুন করেছি। পরে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আরেকজন একনায়ককে ক্ষমতাচ্যুত করতে হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এই গণতন্ত্রের পতাকাবাহী সরকারগুলো আপনমনে নতুন একতন্ত্রের উদ্ভব ঘটিয়েছে, যার নাম পরিবারতন্ত্র। দুর্নীতির কালিমায় বারবার কলুষিত হয়েছে সরকার ও প্রশাসন। দুর্নীতিতে কয়েকবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরবও (!) অর্জন করেছি আমরা। প্রশাসনে মরণবিষের মতো ঢুকেছে দলীয়করণ ও আত্মীয়করণ। যোগ্যতার মূল্যায়নের বদলে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক মতাদর্শ বা পারিবারিক প্রভাব। মেধাহীন, অযোগ্য ও দুর্নীতিবাজ লোক যে প্রশাসনের ভিত্তি সে জাতি আর যাই হোক উন্নয়নের মুখ দেখতে পারে না।
বিশ্বযুদ্ধের দুই বছরের মধ্যেই জার্মানির ন্যুরেমবার্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব যুদ্ধাপরাধীর বিচার সম্পন্ন হয়। আজ ৪১ বছর হয়ে গেছে। আজও আমরা শুধু আশার বাণী শুনছি। একটি রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিকে আলো-বাতাস দিচ্ছে, অপর রাজনৈতিক দল বিচারের নামে ৪১ বছর পার করে দিয়েছে। একটি রাজনৈতিক দলের গ্রহণ করা কোনো উন্নয়ন প্রকল্প পাঁচ বছর পর ব্যবধানে অন্য দল সরকারি ক্ষমতায় এসে বাতিল করে দিয়েছে। শূন্যতায় হারিয়েছে হাজার কোটি টাকা। লাখো ক্ষুধার্ত পেটের এই দেশ দেখেছে কীভাবে শুধু নাম পরিবর্তন করতে কয়েকশ' কোটি টাকা খরচ করতে হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপান কিংবা দরিদ্র মালয়েশিয়া যেখানে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে, আমরা প্রতিদিন একটু একটু করে পিছিয়েছি।
ভৌগোলিক সূত্রে পাওয়া প্রাকৃতিক সম্পদ স্বদেশী প্রযুক্তিকে বিশ্বাস না করে নামমাত্র মূল্যে আমরা উপহার দিয়েছি শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোকে। ফলে অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা কখনোই লাভ করছি না। ২৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। ৫০ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আজও আসেনি। এ দেশের প্রতিটি শিশু মাথায় কয়েক হাজার ডলার ঋণ নিয়ে জন্মায়। একটা স্বাধীন জাতির প্রতি অনেক প্রত্যাশা থাকে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও শিক্ষিত জনসম্পদ। সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে ভুলে গিয়ে আমরা আঁকড়ে ধরেছি আকাশ সংস্কৃতিকে। আর এই আকাশ সংস্কৃতি রফতানি করতে প্রতিবছর খরচ করছি কয়েক হাজার কোটি টাকা। আমাদের শিশুরা ক্ষুধার দামে বাংলা ভাষা ভুলে গিয়ে হিন্দি কার্টুন চরিত্র চিনে বড় হচ্ছে।
তবে অনেক নিরাশার মাঝে আশার বাণী শুনি। বিশ্ববিখ্যাত সংস্থা জেপি মরগ্যান ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিচারে 'ফ্রন্টিয়ার ফাইভ' শীর্ষক তালিকায় পৃথিবীর পঁাঁচটি অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় দেশের তালিকায় রেখেছে বাংলাদেশকে। অর্থনীতিবিদ জেমস ও. নেইলের ভাষায়, বাংলাদেশ হচ্ছে ইজওঈ বা ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া ও চীনের পর পৃথিবীর পরবর্তী অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র। বাংলাদেশের তৈরি দারিদ্র্য বিমোচনের মডেল কাজে লাগিয়ে অনেক রাষ্ট্র দারিদ্র্য নিরসনে সফল হচ্ছে। এ দেশের পোশাকশিল্প পৃথিবীর অন্যতম পোশাকশিল্পগুলোর একটি। এ ছাড়া জাহাজ নির্মাণ ও ওষুধশিল্প রফতানি খাতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এ দেশের তৈরি ওষুধের ওপর নির্ভর করে থাকে বিশ্বের ৬১টি রাষ্ট্র। বিদেশি রেমিট্যান্স দিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের স্থান সপ্তম। গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ক্ষুদ্রঋণ তত্ত্বের আবিষ্কারক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম মহিমান্বিত করেন। ক্রিকেটের সাফল্যের কল্যাণে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও বাংলাদেশ আজ এক উজ্জ্বল নাম।
অনেক প্রত্যাশার পেছনে কিছু প্রাপ্তি আর কিছু হতাশা থাকে। হয়তো আজ পর্যন্ত প্রত্যাশার তুলনায় আমাদের প্রাপ্তির ঝুলিটা একটি বেশিই হালকা। তবে বাঙালি সে জাতি নয় যারা আশা হারায়। হাজার দুর্যোগের এই দেশে মানুষ খড়কুটোকে ধরেও ভেসে থাকতে শিখে গেছে। এটাই আমাদের শক্তি। দিনের অন্তত একটা কাজ আপন সুখের ঊধর্ে্ব যদি আমরা দেশের স্বার্থ ভেবে করি, দেশটা আমূল পরিবর্তন হয়ে যাবে। এ দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো তরুণ সমাজ। ব্যর্থতার শিকল ভেঙে বের হওয়ার ইঙ্গিত তারা ইতিমধ্যেই অনেক প্রাঙ্গণে রেখেছে। স্বাধীনতার ৪১ বছর পর তাই শুধু এটুকুই কামনা থাকবে, প্রগতিশীল এই প্রজন্মকে কোনো শক্তি যেন থামিয়ে না দেয়। আর তরুণদের প্রতি আহ্বান থাকবে, আসুন আমরা আমাদের সন্তানদের এমন একটা পৃথিবী উপহার দিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করি, যেখানে 'বাঙালি' ও 'বাংলাদেশ' শব্দের প্রতি বিশ্ববাসী মাথা উঁচু করে তাকায়।
য়শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.