২৫ মার্চ একাত্তরের স্মৃতি by বদরুদ্দীন উমর

র্যাবের ষষ্ঠ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মহাপরিচালক বলেন, ‘ক্রস ফায়ারে যেসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে তার প্রতিটিই আইনসিদ্ধ, কোনোটিই আইনবহির্ভূত নয়। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে আইনানুগ তদন্ত হয়েছে। সবকিছু আইনের কাঠামোতেই সম্পন্ন হয়েছে।’
(আমার দেশ ৩০.৩.২০১০) তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ছয় বছরে ক্রসফায়ারে মারা গেছে ৬২২ জন। এর মধ্যে ১৪ জন মারা গেছে চলতি বছরের প্রথম দু মাসে।’
র্যাব মহাপরিচালকের এই দাবি থেকে বোঝা যাচ্ছে, তাদের কথামত বিএনপি আমলে প্রতিষ্ঠিত র্যাব বিএনপি এবং সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন সরকারের আমলেও ক্রসফায়ারে যেসব হত্যা করেছে সেগুলো সবই ছিল আইনানুগ, কোনোটিই আইনবহির্ভূত নয় এবং প্রত্যেকটির ক্ষেত্রেই যথাযথ তদন্ত হয়েছে।
এখানে বর্তমান সরকারের আমলে ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের কথা না বলে এবং পূর্ববর্তী দুই সরকারের আমলের কথা বলা হচ্ছে এ কারণে যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে জনগণকে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, বিএনপি ও ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে যেসব ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড হয়েছে তারা সেগুলোর বিচার করবে এবং তাদের শাসন আমলে তারা নিজেরা ক্রসফায়ার একেবারে বন্ধ করবে। অর্থাত্ এক্ষেত্রে তাদের বক্তব্যের মূল কথা ছিল আগে ক্রসফায়ারে আইন বহির্ভূতভাবে হত্যাকাণ্ড হয়েছে এবং সে ধরনের হত্যাকাণ্ড তারা বন্ধ করবে।
বর্তমান র্যাব মহাপরিচালক যে বক্তব্য প্রদান করেছেন সেটা হলো আওয়ামী লীগের নির্বাচনকালীন বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি যদি শুধু বর্তমান সরকারের আমলের কথা বলতেন তাহলে সেটা হতো এমন যাতে আওয়ামী লীগ সরকারের আপত্তি করার মতো কিছু থাকত না। কিন্তু র্যাব-এর পক্ষ থেকে তাদের মহাপরিচালক যে বক্তব্য এখন প্রদান করেছেন তার জবাবদিহিতা শুধু জনগণকেই নয়, বর্তমান প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগকেও চাইতে হবে। সরকার যদি র্যাব মহাপরিচালককে এই জবাবদিহিতার জন্য নির্দেশ না দেয় তাহলে বুঝতে হবে এদেশে এখন সরকারি সংস্থাসমূহ তো বটেই, এমনকি খোদ ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যেও নিম্নতম শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। কাজেই এক্ষেত্রে জনগণ সরকারের কাছেও দাবি জানাতে পারেন যাতে সরকার র্যাব মহাপরিচালককে তার বক্তব্যের জবাবদিহিতা করতে বাধ্য করে। আসলে এ ধরনের আচরণের জবাবদিহিতার জন্য জনগণের দাবির কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা এখন শোচনীয়। এখানে নিয়ম-শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ও সংস্থাগত দায়িত্ববোধ বলে কিছুই নেই। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে র্যাব মহাপরিচালকের উপরোক্ত দায়িত্বহীন বক্তব্যের জবাবদিহিতা এখন পর্যন্ত সরকার থেকে না চাওয়ার কারণেই জনগণ কর্তৃক এই দাবির যথার্থতা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এবার আসা যেতে পারে র্যাবের ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ডের অপরাধমূল চরিত্রের বিষয়ে। মহাপরিচালক বলেছেন, প্রত্যেকটি ক্রসফায়ার ঘটনাই আইনসিদ্ধ এবং প্রতিটি ঘটনারই আইনানুগ তদন্ত হয়েছে। এসব কথাবার্তার সত্যতা এই দেশে কে বিশ্বাস করবে? মানুষ কি জানে না কীভাবে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে? এই ক্রসফায়ারের মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বামপন্থী রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরকে হত্যা করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে একই রকম গল্প তৈরি করে তারা কয়েকশ’বার এমনভাবে তার পুনরাবৃত্তি করেছে যাতে এটা সারা দেশের জনগণের মুখস্থ হয়ে গেছে। একজনকে গ্রেফতার করার পর তাকে তার এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার ও লোকজন পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির লোকদের সঙ্গে সংঘর্ষে তাদের হাতে আটক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। লক্ষ্য করার বিষয় যে, এই সশস্ত্র সংঘর্ষে আটক ব্যক্তির দলভুক্ত অন্য কোনো লোক এবং র্যাবের কোনো লোক নিহত হন না। নিহত হন শুধু র্যাবের হাতে আটক ব্যক্তিই!
এই গল্প শুনিয়েই র্যাব তাদের ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড চালিয়ে এসেছে। আসলে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রকৃত ক্রসফায়ারের কোনো সম্পর্ক নেই। এর প্রত্যেক ক্ষেত্রে যা ঘটে তা হলো, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে তার এলাকায় তাকে গুলি করে হত্যা করা। এই যখন প্রকৃত ঘটনা তখন ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনা আইনানুগ হয় কীভাবে? কীভাবেই বা এটা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড না হয়ে আইনানুগ শাস্তি হতে পারে?
র্যাবের ক্রসফায়ার হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এসব কথা নতুন নয়। কিন্তু র্যাব নামক একটি মারাত্মকভাবে সশস্ত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থার মহাপরিচালক যখন চরম ঔদ্ধত্যের সঙ্গে বলেন যে, এসব ক্রসফায়ারের প্রতিটি ঘটনা আইনানুগ, ৬২২টি মৃত্যুর ঘটনাই আইনানুগ, তখন একে মহাবিপজ্জনক ও আতঙ্কজনক ব্যাপার ছাড়া আর কী বলা যায়? কারণ, এক্ষেত্রে র্যাব মহাপরিচালক বক্তব্য যেভাবে প্রদান করেছেন সেটা তার পক্ষে সম্ভব হতো না যদি না সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অবস্থা বিশৃঙ্খল না হতো। অর্থাত্ বিশৃঙ্খল ও নৈরাজ্যের গর্ভেই র্যাব মহাপরিচালকের এই ঔদ্ধত্যের জন্ম।
বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যায় যে, শুধু র্যাব নয়, সাধারণ প্রশাসন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, চিকিত্সা ব্যবস্থা, ছাত্র সংগঠন, শিক্ষক সম্প্রদায়, আদালত থেকে নিয়ে প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাঙন এখন স্পষ্ট। এই ভাঙন শুধু উপরোক্ত ক্ষেত্রেই নয়, গ্যাস, বিদ্যুত্, পানি, যোগাযোগ ব্যবস্থা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সর্বত্রই বিদ্যমান। সরকারি ও বিরোধী দলগুলোর নেতৃত্বের নানা বক্তব্যের মধ্যেও এই শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের অভাব খুব প্রকট। শেখ হাসিনা এখন বার বার বলছেন, ফখরুদ্দীন সরকার আটক রাখা অবস্থায় তাকে ঝষড় িঢ়ড়রংড়হরহম করত অর্থাত্ তার খাদ্যে নিয়মিত বিষ প্রদান করত। অথচ সেই ফখরুদ্দীন সরকার বিএনপিকে হটিয়ে সামরিক শক্তির জোরে ক্ষমতাসীন হওয়ার সময় হাসিনা বলেছিলেন যে, সেই সরকার হলো, ‘তাদের আন্দোলনেরই ফসল’। তাদের আন্দোলনের ফসলস্বরূপ সরকার কীভাবে আবার তাকে নিয়মিতভাবে বিষ প্রয়োগ করত সেটা দেখা দরকার। শেখ হাসিনা আটক অবস্থা থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কি নিজের শরীরের ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়েছিলেন? যদি করে থাকেন তবে সে রিপোর্ট তার প্রকাশ করা উচিত। যদি সেটা না করে থাকেন তাহলে তার জবাবদিহিতা তাকে করতে হবে। কারণ, সেটা না করে তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যার ওইসব কথাবার্তা সস্তা রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি ছাড়া অন্যকিছু মনে করার কারণ জনগণের নেই। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া হাসিনার এই কাহিনীর সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে তার বক্তৃতায় বলেছেন, তাকে ফখরুদ্দীনরা ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে বিদেশে পাঠাতে চেয়েছিল। তার ভাগ্য ভালো যে, শেষ পর্যন্ত সে ইনজেকশন তারা তাকে দেয়নি! কিন্তু তিনি কীভাবে জানলেন যে, তাকে ফখরুদ্দীন ইনজেকশন দিতে চেয়েছিল বিদেশে পাঠানোর জন্য এবং শেষ পর্যন্ত কেনই বা তারা এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল?
এসব কথা র্যাব মহাপরিচালকের ক্রসফায়ার সম্পর্কিত বক্তব্য আলোচনা প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু আসলে এটা মোটেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কারণ, এর উল্লেখ করা হয়েছে সারা দেশে, সমাজের প্রত্যেক স্তরে, শাসকশ্রেণীর ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরে থাকা অংশের রাজনৈতিক দল, তাদের নেতৃবৃন্দ, অঙ্গ সংগঠনসহ সর্বত্র আজ যে বিশৃঙ্খলা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, বক্তব্যের স্বেচ্ছাচারিতা ও নৈরাজ্য দেখা যাচ্ছে তার সঙ্গে র্যাব মহাপরিচালকের উপরোক্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য ঘনিষ্ঠভাবে, অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়।

No comments

Powered by Blogger.