বিশ্লেষণ-নাটক, কূটকৌশল আর সিদ্ধান্তহীনতায় জাপার দুর্গে পতন by পাভেল হায়দার চৌধুরী

জাতীয় পার্টির (জাপা) ঘাঁটি রংপুর। সেই রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে হেরে গেছেন জাতীয় পার্টির নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। শেষ মুহূর্তে এসে এরশাদের সমর্থন পেয়েও ভোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তৃতীয় অবস্থানে চলে গেছেন জাপা নেতা মানিক।
মূলত জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় আওয়ামী লীগ নেতা শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু রংপুর সিটির প্রথম নগরপিতা হওয়ার সুযোগ পেয়ে গেছেন। অবশ্য এরশাদের এমন সিদ্ধান্তহীনতার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে জাপা প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গার রাজনৈতিক কূট কৌশল।
জাতীয় পার্টির কৌশল-নাটক সব প্রত্যাখ্যান করে ভোটের লড়াই শেষে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নগরবাসী মেয়র হিসেবে বেছে নিয়েছেন শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টুকে। মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে ঝন্টু পেয়েছেন এক লাখ ছয় হাজার ২৫৫ ভোট। তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রংপুর জেলা উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য। কৌশলগত কারণে আওয়ামী লীগ প্রত্যক্ষ সমর্থন না দিলেও ভোটের দুই দিন আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ঝন্টুর পক্ষে কাজ করেছে। এদিকে গণমঞ্চের ব্যানারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী বিএনপি নেতা কাউছার জামান বাবলা ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কিছু আগে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন।
নবগঠিত রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রার্থী সমর্থন দেওয়া নিয়ে ভোটের আগের রাত পর্যন্ত নানা নাটকের জন্ম দেয় জাতীয় পার্টি। প্রথম অবস্থায় এইচ এম এরশাদ কোনো প্রার্থী না দেওয়ার ঘোষণা দিলেও তফসিল ঘোষণার এক দিন পরই দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গাকে সমর্থন দেন। কিন্তু স্থানীয় রাজনীতিতে রাঙ্গার অবস্থান নড়বড়ে। এ অবস্থায় জাপার দুই নেতা মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা ও এ কে এম আবদুর রউফ মানিক তৃণমূল দল থেকে পদত্যাগ করে তৃণমূল জাতীয় পার্টি গঠন করেন। জাপা চেয়ারম্যান এ অবস্থায় রাঙ্গাকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিয়ে মোস্তফা ও মানিককে দল থেকে বহিষ্কার করেন। বহিষ্কৃতরা এর পরও ভোটের মাঠে ভালো অবস্থান ধরে রেখেছিলেন।
সর্বশেষ মঙ্গলবার রাঙ্গা সংবাদ সম্মেলন করে মানিকের পক্ষে কথা বলেন এবং জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান মানিককে সমর্থন দিয়েছেন বলে প্রচার চালান। এ অবস্থায় স্থানীয় জাপা নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা দোদুল্যমান অবস্থায় পড়ে যান। মাঝখান ধেকে ভোটের মাঠে এগিয়ে যান শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু।
ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রার্থী বাছাইয়ে এরশাদের এমন সিদ্ধান্তহীনতার পেছনে কাজ করেছে মেয়র পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেওয়া মসিউর রহমান রাঙ্গার কৌশল ও নাটক। মোস্তফা নির্বাচিত হলে ভবিষ্যতে নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়তে পারে- এমন আশঙ্কায়ই মূলত মোস্তফার বিরোধিতা করেন রাঙ্গা।
তবে মসিউর রহমান রাঙ্গা কালের কণ্ঠকে বলেন, দলীয় কোন্দল, বহিষ্কার আর গ্রুপিংয়ের কারণে এই ভরাডুবি হয়েছে। দু-একজন নেতা জাপা চেয়ারম্যানের আদেশ উপেক্ষা করে দল থেকে পদত্যাগ করে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তাঁরা যে কত বড় মাপের নেতা, তা রংপুরের এরশাদ-ভক্ত ও সমর্থকরা ব্যালটের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন। নবনির্বাচিত মেয়র শরফুদ্দিন আহমেদ ঝন্টু সম্পর্কে রাঙ্গা বলেন, 'তিনি অত্যন্ত অভিজ্ঞ লোক। তিনি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবেন, এ প্রত্যাশা আমার আছে।'
রংপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য এরশাদের ভাতিজা হোসেন শাহরিয়ার মোহাম্মদ আসিফ বলেন, জাপা চেয়ারম্যান ও রাঙ্গার ভুল সিদ্ধান্তে মেয়র নির্বাচনে পরাজিত হতে হয়েছে জাতীয় পার্টির দুই প্রার্থীকে। এই নির্বাচন নিয়ে জাপা চেয়ারম্যানকে ভুল বোঝানো হয়েছে।
পরাজিত প্রার্থী মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, 'দলের চেয়ারম্যানের কারণে জাপা চুরমার হয়ে যাবে। বারবার প্রার্থী বদল, নেতাদের বহিষ্কার এবং শেষ মুহূর্তে একজনকে আশীর্বাদ- এতে মাঠ পর্যায়ে জাপার নেতা-কর্মীদের সংগঠনের প্রতি ঘৃণা চলে এসেছে। এ অঞ্চলে জাতীয় পার্টির যে সুনাম ছিল, তা ম্লান হয়ে গেছে কিছু নেতার কারণে।'

No comments

Powered by Blogger.