অনেক 'না' বনাম অনেক 'হ্যাঁ' by রেজা শাওন

সময় হিসেবে ৪১ বছর নেহাত কম কিছু নয়। তিন যুগ ছাড়িয়ে আরও কিছুটা বেশি। দীর্ঘ এই সময়টায় দেশ আমাদের কী দিয়েছে, সে কথাটার চেয়ে আমরা দেশকে কী দিতে পারলাম, সে প্রশ্নটাই বোধহয় বেশি ভাবায়।
সদ্য স্বাধীনতালব্ধ, প্রায় শূন্য থেকে 'বাস্কেট কেসে'র তকমা গায়ে নিয়ে পথ চলতে শুরু করা ভাগ্যবিড়ম্বিত এই ব-দ্বীপটা কি একেবারেই এগোতে পারেনি? এগোতে পেরেছে অবশ্যই। তবে সে পথচলাটা মোটেই সহজ কিছু ছিল না। অদ্ভুত এক অন্ধকার সময়ে এই দেশটা হারিয়েছে তার মুক্তির পথদ্রষ্টাকে। জেলে নির্মমভাবে নিহত হয়েছেন সব স্বার্থের ঊধর্ে্ব থেকে যারা শুধুই এ দেশটার কথা ভাবতে শিখেছিলেন এমন কিছু মহাপ্রাণ। আর যে প্রজন্মটা একসময় বিপুল বিক্রমে একটা সুগঠিত বিশাল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়ে পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল, তারা সেনানিবাসের ভেতরে নিহত হয়েছে অন্তর্কলহে। বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা সে সময়ের মেরুকরণের উত্তাপটা পুড়িয়েছিল এই দেশটাকেও। সূচনালগ্নেই একটা জাতি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মানুষদের হারিয়ে ফেলেছিল অদ্ভুত কিছু দেশীয় মূর্খতা আর সম্ভাব্য বিদেশি সব ষড়যন্ত্রে। তাই দীর্ঘ ৪১ বছর পর আজ আমরা কী পেয়েছি, কিংবা কোন জায়গায় আজ বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে সে প্রশ্নের উত্তরে না পাওয়ার পরিসংখ্যানটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। তবে সে পরিসংখ্যানে যাচ্ছি না এই কারণে যে, '৭১-এর পর সদ্য ভূমিষ্ঠ একটা দেশ হিসেবে আমাদের বেড়ে ওঠাটা মোটেই স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়ার কোনো অংশ ছিল না। আমরা বেড়ে উঠেছি নিতান্তই অস্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়ার মাঝ দিয়ে।
আশার কথা এটাই যে, বাংলাদেশ কিন্তু থেমে থাকেনি। সংগ্রামী মানুষের বিশাল সেই দলটা, যারা পোশাকশিল্পে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতার বাজারে এখনও টিকিয়ে রেখেছে, যারা মধ্যপ্রাচ্যের সূর্যকঠোর রোদে পুড়ে এখনও বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণটা সচল রেখেছে, কিংবা সার আর বীজের দুর্মূল্যকে পেছনে ফেলে নিভৃত পল্লীর সেই কৃষকটি, যে কি-না শেষ পর্যন্ত চালের দামটা সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত স্থিতিশীল রেখেছে, তারা বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাদের কথা বলা হয়েছে বিশেষ একটা উদ্দেশ্য থেকে। এখানে লক্ষণীয়, শত প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে এ দলটি এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে সম্পূর্ণ নিজ তাগিদে। নিজের পরিবারের জন্য সে তাগিদটা সঞ্চারিত হয়েছে পুরো সুবিশাল পরিসরে। তাই স্বাধীনতার পর দীর্ঘ ৪১ বছর ধরে হাজারো প্রতিকূলতাকে পেছনে ফেলে, বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত একটা অবস্থানে আসার পেছনের কৃতিত্বটায় কেবল রাজনৈতিক দল বা মহলের এই কৃতিত্বে অংশীদার হওয়ার সুযোগ নেই। এটা একটা খুব স্বাভাবিক এবং নিয়মিত একটা প্রক্রিয়া, যার পেছনের নিয়ামকটা হচ্ছে_ সংখ্যায় প্রায় ষোল কোটি আমাদের জনসাধারণ। কোনো ঐশ্বরিক উপায়ে নেতা এসে দেশ বদলাবার ধারণাটা বড্ড প্রাচীন। আমাদের বুঝতে হবে যে, আমরা নিজেরাই পরিবর্তনের অংশ। শুধু বাংলাদেশকে একটা দেশ হিসেবে নয়, একটা অনুভূতি হিসেবে হৃদয়ে ধারণ করাটা দরকার। আর সবার আগে দরকার একটা চেতনাবোধের উন্মেষের, যে চেতনাটা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এই দেশটাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে, ভালোবাসতে শেখাবে। আনন্দের ব্যাপার হচ্ছে, এখনকার প্রজন্ম বোধহয় সে বার্তাই বয়ে চলে। বিপল্গব যে শুধু রাজপথ থেকে শুরু হতে পারে, এমন ধারণটায় তারা আর বিশ্বাসী নয়। বিপল্গব সূচিত হতে পারে তরুণ সেই বিজ্ঞানীর গবেষণাগারে, সদ্য পাস করা নবীন চিকিৎসকটির প্রত্যয়ী চোখে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পেরোনো সেসব যুবার নিরলস কর্মতৎপরতায়, যারা এ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে আমূল পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমরা নিজেরা দাঁড়ালেই দেশ দাঁড়াবে। আমরা সবাই এই পরিবর্তন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই এর চেয়ে সহজতর আর কিছু হতে পারে না।
এত সব 'না'য়ের মাঝে 'হ্যাঁ'গুলো কিন্তু আমাদের আশাবাদী হতে শেখায়। আশাবাদী হতে শেখায় জিনবিজ্ঞানী মাকসুদুল আলম আর তার দল। কিংবা বাপেক্সের সেসব তরুণ প্রকৌশলীর, যারা দিনরাত এক করে এ দেশের মাটির নিচ থেকে সম্ভাবনাটুকু খুঁজে আনার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিয়োজিত কিংবা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আর তার তরুণ আইনজীবীদের সেই দলটি, যাদের পরিবেশ রক্ষার যে আন্দোলনটি এখন আর শুধু এ দেশের পরিসরে সীমাবদ্ধ নেই, ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে। আমরা চাইলেই পারি, তবে আমাদের ছড়িয়ে পড়তে হবে। যার যার জায়গা থেকে ভাবতে হবে নিজেদের মতো করে। একা নয়, দেশ বদলাবে এ দেশের হাজারো তরুণের স্বপ্নময়তায়। সে প্রক্রিয়াটা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, বাকি কাজটা শুধু নিরন্তর শ্রম দিয়ে এটাকে চালিয়ে নেওয়া। তাই বিজয়ের এই শুভলগ্নে কোনো আক্ষেপের সুর নয়, এই সময়টা হচ্ছে শুধুই দৃপ্ত একটা আশাবাদের। শুভ কামনা বাংলাদেশ।
য়নেদারল্যান্ডস প্রবাসী

No comments

Powered by Blogger.