বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো আর দাম বাড়ানো সমাধান নয়ঃ জ্বালানি সমস্যায় সরকার দিশেহারা

হচ্ছে হবে বলে সময়ক্ষেপণের পর এখন বলা হচ্ছে ২-৩ বছর অপেক্ষা করার কথা। বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সমস্যা নিয়ে সরকারের বক্তব্য এখন এমনই। অতীতে, বিশেষ করে জরুরি অবস্থার দু’বছর এ খাতে কিছুই হয়নি এটা কোনো নতুন কথা নয়।
মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে তাই জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়ে এ খাতে জরুরি ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। অন্য বিষয় নিয়ে মাতামাতির ফলে এখন জ্বালানি দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন খোদ অর্থমন্ত্রী। এ দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ব্যবহার সঙ্কোচনের পাশাপাশি আবারও বিদ্যুত্ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার রাজধানীতে অর্থমন্ত্রীর মুখে এমন প্রস্তাব সমস্যা জর্জরিত মানুষকে বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ না করে পারেনি।
বিদ্যুত্ ও গ্যাস নিয়ে সারাদেশে হাহাকার ওঠায় বিক্ষুব্ধ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। শুরু হয়েছে ঘেরাও, অবরোধ, হামলা, ভাংচুর। পরিস্থিতি সামাল দিতে রাজধানীতে লোডশেডিংয়ের মেয়াদ এক ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে দুই ঘণ্টা করা হয়েছে। এর ফলে এইচএসসি পরীক্ষার্থী বা হাসপাতালে রোগীদের কী দশা হবে সেটা ভাবার সময় সম্ভবত কারও নেই। এছাড়াও তিন মাসের জন্য সব শ্রেণীর বিদ্যুত্ গ্রাহককে নতুন বিদ্যুত্ সংযোগ না দেয়া এবং সার কারখানায় বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধের একদিন পরই পিক আওয়ারে অর্থাত্ সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হাসপাতাল ও হোটেল-রেস্তোরাঁ ছাড়া সর্বত্র এসি চালানো বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অমান্য করলে জেল-জরিমানার কথাও বলা হয়েছে। এমন নির্দেশ কার্যকর করা কতদূর সম্ভব হবে সে প্রশ্ন না তুলেও এসব পদক্ষেপ উদ্ভূত বিদ্যুত্ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে কতটা ফলদায়ক হবে সেটা ভেবে দেখার বিষয়। এর আগেও ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘড়ির কাঁটা পরিবর্তন ও বিদ্যুত্ সাশ্রয়ী বাল্ব বিতরণের কথা বলা হলেও কাজের কাজ তেমন কিছু হয়েছে, কেউ তা বলতে পারবে না। শুরু থেকে এ নিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এসব শুনেও না শোনার ভান করে অনেক আশার কথা শুনিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
বোরো উত্পাদনের কথা বলে শহরাঞ্চলের বিদ্যুত্ গ্রামাঞ্চলে নেয়ার ঘোষণা দিলেও এখন শহরের মতো গ্রামের মানুষও বিদ্যুত্ না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। রাজধানী ছাড়াও দেশের প্রায় অর্ধেক জেলা থেকে বিক্ষোভ, সড়ক অবরোধ, বিদ্যুত্ অফিস ঘেরাও-ভাংচুরের খবর পাওয়া গেছে। অবস্থা বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রী ধৈর্য ধরার কথা বলেছেন। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী বলেছেন আবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা। দাম না বাড়ালে নাকি সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে। মন্ত্রী-এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতা ও নানাবিধ অনুত্পাদক খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করার সময় অবশ্য অর্থমন্ত্রীর এমন কথা মাথায় আসেনি। এ মাসের শুরুতে বিদ্যুতের দাম এক দফা বাড়ানোর পর এখন মাসের শেষে আবারও তিনি আরেক দফা দাম বাড়ানোর পেছনে যত যুক্তি তুলে ধরেন না কেন, তা মেনে নেয়া কষ্টকর হবে। সরকার কি তবে বিদ্যুত্ সঙ্কট সমাধানে সবকিছু বাদ দিয়ে ব্যবহার কমানো আর দাম বাড়ানোই মোক্ষম পথ বলে ধরে নিয়েছে?
শুধু বিদ্যুত্-জ্বালানি সমস্যা নয়, মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগশূন্যতা নিয়েও সরকার চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করেছে। সময় থাকতে যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে হাত দেয়া হতো তবে ক্ষমতা গ্রহণের এতদিন পর এমন দিশেহারা কথাবার্তা শোনা যেত না মন্ত্রীদের মুখে। তার কথায় অবশ্য অর্থমন্ত্রী ভারত-মালয়েশিয়ার উদাহরণ তুলে ধরেছেন। কিন্তু দেশ দুটোর সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের তুলনা যে হয় না সেটা এখনকার বিদ্যুতের লোডশেডিং, বিশ্বমন্দা মোকাবিলা, জ্বালানি সঙ্কট, মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। অন্য অনেক বিষয়ে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এসব বিষয়কে কেউই গুরুত্বহীনভাবে ফেলে রাখেনি। শুধু মুখের আশ্বাসে আর যাই হোক কোনো সমস্যারই সমাধান হয় না। মাত্র ১৩ মাসে সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয় এটা সবাই বোঝে; কিন্তু সমাধানের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে মানুষকে আশাবাদী করা যায় নিঃসন্দেহে। মহাজোট সরকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো ক্ষেত্রেই এমন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে সেটা কেউ দাবি করতে পারবে না। জনগণের সমস্যা বাদ দিয়ে শুধু নিজেদের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে এমন দিশেহারা হওয়াই স্বাভাবিক। ক্ষমতাসীনরা ছাড়া এটা বুঝতে কাউকে বুদ্ধি খাটাতে হয় না।

No comments

Powered by Blogger.