সদরে অন্দরে-কার স্বার্থে এই হরতাল by মোস্তফা হোসেইন

বাসটি একটু সামনেই থামবে। যাত্রী নামবে কিছু, উঠবেও কেউ কেউ। গাড়ির গতি তাই কিছুটা মন্থর। যাদের অন্য স্টপেজ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, তারা কেউ বাইরে তাকিয়ে আছে যাত্রাবাড়ীর মানুষের ভিড়ের দিকে। ঠিক ওই মুহূর্তে কিছু যুবক হামলা চালায় বাসে।
তাদের হাতে মশাল, লাঠি ও অন্য অস্ত্রশস্ত্র। ওরা পাগলের মতো পেটাতে শুরু করে বাসের গায়ে। জ্বলন্ত মশালের আঘাত, অগি্নসংযোগের চেষ্টা চলে তাদের পক্ষ থেকে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে কেউ কি স্থির থাকতে পারে? শিশু-মহিলাদের চিৎকার, ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা- এ এক অস্বাভাবিক দৃশ্য। মিনিট কয়েকের মধ্যে বাস প্রায় খালি হয়ে যায়। বাসচালকও নিরুপায়। সামনে গাড়ি, পাশে গাড়ি, পেছনে যাওয়ারও সুযোগ নেই। প্যান্ট-শার্ট কিংবা টুপি-পাঞ্জাবি পরা এসব যুবক ইটের আঘাতে জানালার কাচ ভাঙছে, মশালের আগুন গাড়ির গায়ে লাগানোর চেষ্টা করছে। কাগজে আগুন জ্বালিয়ে গাড়ির ভেতরে ফেলছে একজন। অগি্নসংযোগকারীরা হয়তো মনে করেছে, দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকবে গাড়িটি। আবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তারা পিছু হটতে থাকে। মশালও নেভাতে থাকে কয়েকজন। এমন সময় পথচারী একজন এসে জড়িয়ে ধরে মশালধারী একজনকে। সঙ্গী একজন এগিয়ে আসতেই পথচারীদের কয়েকজন যুক্ত হয়ে যায় পূর্বসূরির সঙ্গে। দেখতে দেখতে বেশ কিছু মানুষ চলে আসে ফুটপাত থেকে। শুরু হয় গণপিটুনি। টেলিভিশনের ক্যামেরায় ধারণকৃত এই দৃশ্য প্রচারিত হওয়ার সময় স্পষ্ট কানে বাজে আরেক পথচারীর চিৎকার- ধর, রাজাকারকে ধর। ঘটনাটি ডিসেম্বর মাসের প্রথমার্ধে জামায়াতের ডাকা হরতালের আগের সন্ধ্যার।
এ ঘটনা যে কাউকে ভাবনার খোরাক জোগায়- নিশ্চিত করে বলা যায়। পরদিন হরতাল ডেকেছে জামায়াতে ইসলামী। রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে হরতাল ডাকার আগের রাতে মশাল মিছিল, খণ্ড মিছিল, লিফলেট বিতরণ করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের, যা আমরা পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে তরুণদের করতে দেখেছি। দেখেছি পরবর্তীকালে রাজনৈতিক ও সামরিক সরকারের আমলেও। কিন্তু এভাবে যাত্রীবোঝাই গাড়িতে আগুন লাগানোর ঘটনাকে কি রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি হিসেবে মেনে নেওয়া যায়? প্রশ্ন আসতে পারে, এভাবে অগি্নসংযোগ করে কি রাজনৈতিক দাবি আদায়ে মানুষের সমর্থন আদায় করা সম্ভব? নিশ্চিত করে বলতে পারি, সেদিন যারা ওই বাসে ছিল তারা মনে করেছে, তাদের সামনে যমদূত। আর তারা একাত্তরের ঘটনারই পুনরাবৃত্তি দেখছে।
এ ঘটনা বিশ্লেষণ হতে পারে নানাভাবে। পথচারীদের একজন যখন ধর রাজাকার বলে মশালধারীকে জাপটে ধরে, তখন কী মনে হতে পারে? ঘটনার সময় মশালধারীদের অতর্কিত হামলার আগে সেখানে প্রতিপক্ষ কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। ছিল না কোনো প্রতিরোধও। স্বতঃস্ফূর্ত এই প্রতিরোধ কি প্রমাণ করে না সাধারণ মানুষ তাদের দাবির প্রতি কোনোমতেই সহমত পোষণ করে না। জামায়াত যদি মনে করে, তারা কোনো রাজনৈতিক দাবি আদায়ের জন্য এই হরতাল করছে তাহলেও কি এর যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যাবে? বরং মনে করার যুক্তি আছে, তারা একাত্তরে যেমন সাধারণ মানুষকে প্রতিপক্ষ ভেবেছে। এ দেশের হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে খুন করার কাজে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে কিংবা কোথাও কোথাও নিজেরা এই কাজে লিপ্ত হয়েছে, তেমনি ২০১২ সালে এসেও বাসযাত্রী সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছে? যদি রাজনৈতিক আন্দোলন হয়ে থাকে, তাহলে এটা হবে সরকারের বিরুদ্ধে। যাত্রাবাড়ীর সেই ঘটনা স্পষ্টতই সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এবং তাদের পুড়িয়ে মারার স্পষ্ট আলামত। মিডিয়ার সুবাদে দেশের মানুষ সেই চিত্র স্পষ্ট দেখেছে। আবার পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন দাবিতে আহূত হরতাল প্রত্যাহারের দাবিতে যখন ২০ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান করে ও সেই হরতালে জামায়াত সমর্থন জানায়, তখনো কি বলতে হবে এটা স্বাভাবিক হরতাল? একটি দল তার দাবি উত্থাপন করতে পারে, সেই দাবির বিরুদ্ধে হরতালকে অভিনব বললেও ভুল হবে। ২০ ডিসেম্বর যে হরতাল ডাকা হয়েছে, তাও জামায়াতেরই ইঙ্গিতে- এমন সংবাদ প্রচারমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তারা সেই হরতাল সমর্থন করে সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট করেছে। অথচ ২০ তারিখের হরতাল আহ্বানকারীদের ১২ দলের আটটিই বলে দিয়েছে, তারা এই হরতাল আহ্বান করেনি। এতেই বোঝা যায়, খেলাটা রাজনৈতিক নয়। এটা হচ্ছে দেশকে অস্থিতিশীল করার মানসে এবং একাত্তরে ফিরে যাওয়ার পাঁয়তারা। একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার পরিকল্পনা মাত্র।
তারা দাবি করছে, একাত্তরে মানবতাবিরোধী কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তদের মুক্তি দিতে হবে। তাদের দাবি, ট্রাইব্যুনাল বাতিল করতে হবে। ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধীদের বিচার চলাকালে তাদের এমন দাবি স্পষ্টত প্রমাণ করে, তারা একাত্তরের ভূমিকায় আবার ফিরে গেছে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্টদের বিচার করার রায় এসেছে জনগণের কাছ থেকে। এই রায় তো ৩০ লাখ মানুষের রক্তের শপথছোঁয়া। যুদ্ধ-পরবর্তীকাল থেকে শুরু হওয়া বিচারেরই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। মাঝখানে একাত্তরের খুনিদের সহযোগী কিংবা বৈরীশক্তির প্রতাপের কারণে বন্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে আবারও বাংলার মানুষ রায় দিয়েছে বিচার করার জন্য। মানবতাবিরোধীদের বিচার করার জন্য জাতীয় সংসদও স্পষ্টত রায় দিয়েছে। সুতরাং জনরায় ও আইনগত বাধ্যবাধকতার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ করছে। সুতরাং এই হরতালকে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করার কোনো সুযোগ নেই। তাদের দাবিকে কিভাবে দেখবে একাত্তরের শহীদদের পরিবারগুলো? এই মুহূর্তে মনে আসে কুমিল্লার নগরপাড়া গ্রামের একটি বাড়ির সাত বিধবার কথা। চোখের সামনে আলী আজমের নেতৃত্বে কয়েক রাজাকার বাড়ির সাত পুরুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল একাত্তরের এক রাতে। জীবন্ত পুঁতে মেরেছিল একজনকে, ছয়জনকে হত্যা করেছিল গুলি করে। সেই রাজাকারদের প্রায় সবাই ছিল জামায়াতে ইসলামীর সদস্য। নগরপাড়ার সেই সাত বিধবা কি স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করবে এই দাবি? তাদের এই দাবি ও হরতাল কি স্পষ্টত শহীদদের রক্তের প্রতি অবমাননা নয়? শুধু তা-ই নয়, পরবর্তীকালে হরতাল চলাকালে তারা যেভাবে রাষ্ট্রের সুসংগঠিত পুলিশ বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়েছে, রাজশাহীতে যেভাবে পুলিশের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে পুলিশকে হত্যার চেষ্টা করেছে, কারওয়ান বাজারে যেভাবে পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে, সিলেটে যেভাবে তারা পুলিশকে আক্রমণ করেছে তাতে স্পষ্ট হয়ে যায়, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পুনরায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে।
জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি রাজনৈতিক সরকারের ওপর দায়িত্ব হচ্ছে, রাষ্ট্রের বিপক্ষে পরিচালিত অভ্যন্তরীণ কিংবা বাইরের যেকোনো আঘাত প্রতিহত করা। শত্রু হিসেবে চিহ্নিত শক্তিকে দমন করতে গেলে তা আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শামিল হতে পারে বলেও মনে করি না।
হরতালের বিরোধিতা করার কারণে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই, আওয়ামী লীগের লেজুড়বৃত্তির মানসিকতা নিয়ে এই নিবন্ধ রচনা করা হচ্ছে। তাদের অনেক ব্যর্থতা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের তুলনায় কিছুটা উন্নত হওয়ার পরও রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতির অভিযোগ চারদলীয় জোট সরকারের চেয়ে কম নয়। সরকারের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা কিংবা দুর্নীতির প্রতিবাদে যেকোনো রাজনৈতিক দল আন্দোলন করতে পারে। এটা জনগণ মেনে নিতে পারে, এমনকি চূড়ান্ত পর্যায়ে তারা সেই আন্দোলনের অংশ হিসেবে সহনীয় পরিমাণে হরতালকেও সমর্থন করতে পারে। তবে সেই হরতাল যদি সহিংস হয়, সেই হরতাল যদি প্রায় লাগাতার ও মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়, তাহলে তা কেউই সমর্থন করতে পারে না। কিন্তু হালের হরতালগুলো কি সেই দাবি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছে? মোটেও নয়। আর তাই এসব হরতালের পেছনে কখনো কোনো জনসমর্থন আশা করা যায় না।
mhussain_71@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.