প্রাণী- রোমিও-জুলিয়েটের গল্প by সুমেল সারাফাত

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রোমিও-জুলিয়েট নেমে এল পানিতে! তা-ও লোনা পানিতে। সুন্দরবনের করমজল পর্যটন এবং বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের পুকুরে তাদের বসবাস। লোনা পানির কুমির এরা। বাংলাদেশে মিষ্টি পানির কুমির প্রায় বিলুপ্ত। যা কিছু দেখা যায়, তা এই লোনা পানির কুমির।
বন বিভাগ সূত্র জানায়, বিলুপ্তপ্রায় লোনা পানির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে বায়োডাইভারসিটি কনজারভেশন প্রকল্পের আওতায় ৩২ লাখ টাকা অর্থায়নে আট একর জায়গার ওপর বন বিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রটি। এরপর কুমির লালন-পালন এবং বন্য প্রাণীর ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য বন বিভাগ তাদের দুজন কর্মকর্তা নির্মল কুমার হাওলাদার ও আবদুর রবকে অস্ট্রেলিয়ার আন্তর্জাতিক ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সেন্টারে পাঠায়।
শুরুতে জেলেদের জালে আটক দুটি কুমির দিয়ে কেন্দ্রের প্রজনন কার্যক্রম শুরু হয়। তখন কুমির দুটি অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। ২০০৫ সালে কুমির দুটি প্রজননক্ষম হয়। সে বছরই নারী কুমিরটি ১৯টি ডিম দেয়। এরপর কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রবের তত্ত্বাবধানে টানা তিন মাস কেন্দ্রের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে ডিমগুলোকে সঠিক তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, পর্যাপ্ত অক্সিজেন ও আলোর ব্যবস্থা এবং পানি যাতে প্রবেশ করতে না পারে—এ রকম পরিবেশে রাখার পর ওই ডিম থেকে ১৬টি বাচ্চা ফোটে। সেই থেকে শুরু।
আবদুর রবের ভাষ্য, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই প্রথম কুমিরের ডিম থেকে কৃত্রিম উপায়ে বাচ্চা বের করা হয়। ফলে কুমির দুটিকে বিশেষ খ্যাতি দেওয়ার জন্য উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের অমর সৃষ্টি রোমিও-জুলিয়েটের নাম অনুসারে আমি তাদের নাম দিই রোমিও আর জুলিয়েট।’
রোমিও ও জুলিয়েটের বর্তমান বয়স ২১ বছর। এ পর্যন্ত জুলিয়েট ৩০৬টি ডিম দিয়েছে। এর মধ্যে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়েছে ১৮৬টি। আ. রব জানান, ভ্রূণের মৃত্যু এবং তাপমাত্রার তারতম্যের কারণে বাকি ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো সম্ভব হয়নি। এটি আরও ৪০ বছর পর্যন্ত ডিম দিতে পারবে। তিনি আরও জানান, এই প্রজাতির কুমির সাধারণত ৮০ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে।
সম্প্রতি করমজল পর্যটন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, প্রচুর দর্শনার্থী কেন্দ্রটির চারদিকে ভিড় করেছে। বাগেরহাট সদর থেকে আসা এক তরুণী বললেন, ‘এই কেন্দ্র সম্পর্কে নানা তথ্য জেনে কৌতূহলের বশে দেখতে এসেছি।’
এখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেন্দ্রে কুমিরের চরম খাদ্যাভাব রয়েছে। বন বিভাগ থেকে যে বরাদ্দ পাওয়া যায়, তা প্রয়োজনের মাত্র ৩০ শতাংশ। তারপর কুমিরের ওষুধ ও চিকিৎসা বাবদ কোনো বরাদ্দ নেই।
আ. রব বলেন, বিলুপ্তপ্রাপ্ত এই প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের এ খাতে অবশ্যই বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ ছাড়া গত আইলার জলোচ্ছ্বাসে কুমির ভেসে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি সরকারের কাছে অবকাঠামোগত উন্নয়নেরও দাবি জানান।
সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসাইন চৌধুরী অর্থসংকটের কথা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, গত অর্থবছরে এ খাতে সরকারি অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এখন পর্যন্ত এ খাতে কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

No comments

Powered by Blogger.