রেলওয়ের ১০ থেকে ৩০ লাখ টাকার কাজে বেশি জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়- নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজে ‘ঘুপচি বিজ্ঞাপন’! by একরামুল হক

নথিপত্রে উল্লেখ আছে, দরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। এমনকি পত্রিকায় ‘প্রকাশিত’ বিজ্ঞাপনের কাটিংও রাখা আছে নথিপত্রের সঙ্গে। কিন্তু বাস্তবে এসব বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি।
এভাবে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে রেলওয়ের বিভিন্ন কাজ পছন্দের ব্যক্তিকে পাইয়ে দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট লোকজন এ ধরনের অস্তিত্বহীন বিজ্ঞাপনকে ‘ঘুপচি বিজ্ঞাপন’ বলে থাকেন।
রেলওয়ে সূত্র জানায়, বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ বছরে ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার কাজ হয়। রেলওয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ১০ লাখ থেকে ৩০ লাখ টাকার নির্মাণ, মেরামত বা রক্ষণাবেক্ষণকাজের ক্ষেত্রে সাধারণত এ রকম জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া হয়।
চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাক-এ সিলেট রেলস্টেশনের ভিআইপি কক্ষের মেরামতের জন্য দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে বলে রেলওয়ের নথিপত্রে উল্লেখ আছে। কিন্তু চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরিতে রাখা ওই দিনের ইত্তেফাক পত্রিকায় সিলেট স্টেশনের সংস্কারসংক্রান্ত রেলওয়ের কোনো বিজ্ঞাপন দেখা যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মেসার্স শফি ইঞ্জিনিয়ারিং নামের ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিলেট রেলস্টেশনের ভিআইপি কক্ষের মেরামতের কার্যাদেশ পায়। এ জন্য বরাদ্দ ছিল ১৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬১০ টাকা। মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজ নামের আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেয় বলে দরপত্রের নথিতে দেখা যায়। নথিতে মেসার্স শফি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ঠিকানা রাজধানীর সবুজবাগ দক্ষিণগাঁওয়ের ১/এ সড়কের ২১ নম্বর বাড়ি দেখানো হয়েছে। মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজের ঠিকানাও সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও দেখানো হয়েছে।
জানতে চাইলে মেসার্স শফি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক শফিউল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি পত্রিকার বিজ্ঞপ্তি না দেখে সিলেট স্টেশনের ভিআইপি কক্ষের মেরামতকাজের দরপত্রে অংশ নিয়েছি। কাজও পেয়েছি।’
দরপত্রের নথিপত্র থেকে পাওয়া মেসার্স শারমিন এন্টারপ্রাইজের ফোন নম্বরে যোগাযোগ করে সেটি ঢাকার খিলগাঁওয়ের একটি বেসরকারি হাসপাতালের পিএবিএক্স নম্বর বলে জানা গেছে।
একইভাবে ঢাকায় রেলওয়ের বৈদ্যুতিক বিভাগের একটি মেরামতকাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করে ১৮ জানুয়ারি কালের কণ্ঠ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে বলে রেলওয়ের নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ‘প্রকাশিত’ বিজ্ঞাপনের কাটিং নথিতে দেখা গেছে। কিন্তু চট্টগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরিতে রাখা ওই দিনের কালের কণ্ঠ পত্রিকায় এই বিজ্ঞাপনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। পরে রেলওয়ের বৈদ্যুতিক বিভাগে খোঁজ নিয়ে এ-সংক্রান্ত নথির হদিস পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘুপচি বিজ্ঞাপন’ দিয়ে রেলওয়ের কোটি কোটি টাকার কাজ করানো হয়েছে। ইউসুফ আলী মৃধার আমলে এ প্রবণতা বেশি ছিল। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘পূর্বাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের অধীনে ৭০ শতাংশ নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণকাজ ঘুপচি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পছন্দের ঠিকাদার দিয়ে করানো হয়েছে বলে আমার ধারণা।’ তিনি বলেন, কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারেরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগসাজশ করে ৩০ শতাংশ কাজও করেন না। রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, নথিতে ‘ঘুপচি বিজ্ঞাপন’ কোত্থেকে এসেছে, তা আসলে রহস্যজনক। তদন্ত করলেই রহস্য উদ্ঘাটিত হবে।
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. তাফাজ্জল হোসেন এ প্রসঙ্গে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগটি গুরুতর। তবে আমি যোগ দেওয়ার আগেই যদি এসব কাণ্ড ঘটে, তাহলে দেখেশুনে আমাকে মন্তব্য করতে হবে। এখন বিষয়টি সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না।’

No comments

Powered by Blogger.