জন্মহার হ্রাস বৃদ্ধির কথা by আলমগীর সাত্তার

কয়েকদিন আগে একজন সাংবাদিক বন্ধু আমাকে বললেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয় নিয়ে তাদের পত্রিকায় কিছু লিখতে। তিনি জানেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং বীরত্বের জন্য খেতাবও লাভ করেছি।
সাংবাদিক বন্ধুকে বললাম, আমার যুদ্ধাভিজ্ঞতা নিয়ে বারবার প্রায় একই কথা আর লিখতে ইচ্ছা করছে না। তার চেয়ে ভালো হবে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কিছু লেখা।
বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের অনেক সফলতার অন্যতম হলো, দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনা। এ বিষয়ে আমরা ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে ভালো করছি। আমাদের এই অর্জনের পেছনে সরকারের অবদান কতটা তা আমি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বলতে পারব না। আর এ কথাও বিশ্বাস করি, এ বিষয়ে অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি হ্রাসে লাগাম টেনে ধরেছে অন্য কিছু বিষয় এবং ফ্যাক্টর। যেগুলো প্রত্যক্ষভাবে নয়, পরোক্ষভাবে কাজ করছে।
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় আশি থেকে নব্বই লাখ বাংলাদেশি লোক শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। তারা সবাই প্রজননক্ষম। তারা অনেকে বিবাহিত এবং অনেকে অবিবাহিত। তারা এত অল্প বেতনের চাকরি করেন যে, ওইসব দেশে পরিবার-পরিজন নিয়ে যেতে পারেন না। প্রতি বছর দেশে আসতেও পারেন না। চার-পাঁচ বছর পর তারা অল্প সময়ের জন্য দেশে আসেন। আমি বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন হিসেবে প্রায় ২৫ বছর প্রতি মাসে তিন-চারবার ফ্লাইট নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছি। তাই তাদের সম্পর্কে আমি প্রায় নির্ভুল তথ্য দিতে পারি। বিদেশে কর্মরত বিশাল সংখ্যার শ্রমিক ভাইয়েরা দেশে শুধু বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখছেন না, তারা দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতেও সাহায্য করছেন। তারা যদি দেশে বাস করতেন, তবে কত যে সন্তান উৎপাদন করতেন সেটা হিসাব করতে পারছি না। পারি শুধু অনুমান করতে। এমন বিশাল সংখ্যার শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে কাজ না করলে, কতটা পরিমাণ বাড়তি খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজন হতো এবং বেকারের সংখ্যা দেশে কতটা বৃদ্ধি পেত সেটাও গণনার মধ্যে আনতে হবে। দেশে বেকারত্বের হার অনেক বেড়ে গেলে রাজনৈতিক অস্থিরতা, চুরি-ছিনতাই সবকিছু আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেত।
সবকিছু চিন্তা করে সরকারের উচিত বিশ্বের সব দেশে শ্রমবাজার খুঁজে বের করা। প্রয়োজনে প্রজননক্ষম পুরুষদের যত বেশি সংখ্যায় পারা যায় বিদেশে পাঠাতে হবে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যেভাবে বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তুকি দেওয়া হয়, কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়, তেমনিভাবে প্রজননক্ষম শ্রমিকদের বিদেশে পাঠানোর জন্য ভর্তুকি দিতে হবে। অল্প সুদে বা সুদবিহীন ঋণ দিতে হবে।
আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমাতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অবদান রাখছে পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। পত্রিকায় পড়েছি, পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩৬ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। এর মাঝে ৩০ লাখই প্রজননক্ষম নারী শ্রমিক। এই ৩০ লাখ নারী শ্রমিকও এক বা দুয়ের অধিক সন্তানের মা হতে ইচ্ছুক নয়। গার্মেন্ট শিল্পে কর্মরত এই শ্রমিকরা অর্থকড়ি উপার্জন করে সংসার চালাতে স্বামীদের সহায়তা করছেন। তাই স্বামীর ইচ্ছামতো অনেক সন্তান উৎপাদনে রাজি হচ্ছে না। আর স্বামীরাও তাদের কথা শুনতে বাধ্য হচ্ছেন। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি না হওয়ার জন্য এটাও আংশিকভাবে অবদান রাখছে।
পোশাকশিল্প রফতানির সমস্ত সূচকই নির্দেশ করছে যে, দেশ থেকে পোশাক রফতানির পরিমাণ তিন থেকে চার বছরের মধ্যে দ্বিগুণ হবে। এর অর্থ, এই শিল্পে আরও ৩০ লাখ নারী শ্রমিক নিয়োজিত হবেন। এমনটা হলে বিদেশে কর্মরত শ্রমিক এবং পোশাকশিল্পের কল্যাণে আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে স্থিতি আসবে বলে প্রত্যাশা করতে পারি।
শিক্ষার বিস্তারও জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের দেশে বর্তমানে বাল্যবিয়ের ওপর আইনত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু অশিক্ষিত পরিবারে বাল্যবিয়ে থেমে নেই। শিক্ষিত পরিবারের চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা আজকাল ছেলেদের মতোই লেখাপড়া শেষ করে চাকরি-বাকরি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েই বিয়ের কথা চিন্তা করে। আমাদের শিক্ষার হার প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই বাল্যবিয়ের সংখ্যাও কমে আসছে।
আমাদের সামাজিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনও জন্মহার নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখছে। আমার বাবার দাদা কাজী জমিরউদ্দিন সাহেবকে সবাই সুফি-দরবেশ বলে মান্যগণ্য করতেন। তার ছিল চার স্ত্রীর দশ ছেলে এবং তিন মেয়ে। সুফি-দরবেশ হলেও তিনি কী করবেন? তখন তো জন্মনিরোধের ব্যবস্থা ছিল না। অথচ আজকাল দেখছি, কট্টর ধার্মিক লোকও একের অধিক স্ত্রী রাখছেন না। ধার্মিক হলেও আজকাল চাকরি-বাকরি করতে হয়। কারও দশ-বারোটি সন্তান থাকলে তো কেউ তাকে বাসা ভাড়া দেবে না। গ্রামের বাড়িতে তেমন বেশি ঘরদোর নেই। চার স্ত্রী এবং সন্তানের জন্য তো একাধিক ঘর থাকা চাই, সে ব্যবস্থাও তো করা সম্ভব নয়।

আলমগীর সাত্তার :মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক বৈমানিক

No comments

Powered by Blogger.