বিজয়ের মাস-একাত্তরে অবরুদ্ধ স্বদেশে by আখতার জাহান ফরিদা বানু

একাত্তরের কত স্মৃতি। আমার নন্দাই মনজুর আহমেদ এমপি তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী খুকিকে বাজিতপুরে রেখে ১১নং সেক্টর শিলংয়ে চলে গেছেন। খুকি পরে নিরাপত্তার কারণে ছোট ছোট সন্তানসহ প্রত্যন্ত গ্রাম বোয়ালিয়া যায়। পাক আর্মির হামলার ভয়ে তাদের কখনও কখনও বনজঙ্গলেও ঘুরতে হয়েছে।
আমার এক মামা আর্কিটেক্ট মাজহারুল ইসলাম সপরিবারে কলকাতা চলে গেছেন। আর এক মামা কর্নেল কাজী নুরুজ্জামান তো সেক্টর কমান্ডার হয়ে সরাসরি যুদ্ধের সঙ্গেই সম্পৃক্ত। তার দুই মেয়ে নায়লা ও লুবনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদান এবং সংস্কৃতি দলের সঙ্গে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধের অনেক খবরাখবর পাচ্ছি আমার বড় ভাই সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ রসুল, ছোট ভাই সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, সঙ্গীত ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, তার শ্যালক ও বড় আপার ভাশুরের ছেলে ইকু-সোহেলদের কাছ থেকে।
বড় আপার বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া তার ভাশুর ও দেবরের বাড়ি। আলতাফ মাহমুদ তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-স্বজন নিয়ে থাকতেন বড় আপার ভাশুরের নতুন বাড়ির একতলায়। প্রাণবন্ত, সদাশয় আলতাফ মাহমুদ গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রাতের বেলায় বড় এক ট্রাক অস্ত্র নিয়ে তার বাসায় লুকিয়ে রাখতে বলেন। তিনি তখন বড় আপাদের বাগানে গর্ত খুঁড়ে সেটি লুকিয়ে রাখেন। এক গেরিলা যোদ্ধা ধরা পড়লে তার শিশুসন্তানকে হত্যার ভয় দেখিয়ে তাকে বাধ্য করা হয় যে, কোথায় অস্ত্রশস্ত্র রাখা হয়েছে তা জানাতে এবং তার মুখে আলতাফ মাহমুদের নাম শোনার পর পাক আর্মি আলতাফ মাহমুদের বাসায় উপস্থিত হয় ৩১ আগস্ট ভোরে। আলতাফ মাহমুদকে আর্মি জওয়ানরা মারতে মারতে চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলে। শেষে পরিবারের সবাইকে রক্ষার জন্য অগত্যা তিনি বড় আপার বাগানের জায়গাটা দেখিয়ে দেন।
বড় আপার দোতলায় থাকতেন আমার বড় ভাই। ছোট ভাই নাসের একতলার ঘরে শুয়েছিল। হৈচৈ শুনে সবাই উঠে পড়েছে। বড় ভাই ওপর থেকে নেমে এসেছেন। নাসের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে আর্মি ক্যাপ্টেন তাদেরও জিপে তুলে নিল। বড় আপা বারবার থামিয়ে বলেছেন, 'বাড়ির মালিক আমি। জিজ্ঞাসাবাদ করলে আমাকেই নিয়ে যাও।' কিন্তু ক্যাপ্টেন নাছোড়বান্দা বলে, 'বাজি, আপ ঠাহর যাইয়ে ওহঃবৎৎড়মধঃরড়হ-কে বাদ ছোড় দেঙ্গে।' 'বোন আপনি থাকুন, জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেওয়া হবে।' ভাই জানালেন, তিনি সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার, তার কাছে চাবি আছে, অতএব তাকে অফিসে যেতেই হবে। নাসেরও স্টেট ব্যাংকের অফিসার। তারও এক কথা 'অফিসে যেতে হবে।' ক্যাপ্টেন কোনো কিছু মানল না। ধরে নিয়ে গেল।
ওহঃবৎৎড়মধঃরড়হ-এর নাম করে ভাইদের প্রাক্তন এমপি হোস্টেলের পাশে এক ড্রাম ফ্যাক্টরিতে নিয়ে পাক আর্মি অমানুষিক নির্যাতন শুরু করল। বড় ভাইয়ের আঙুলের হাড় ভেঙে গেল বুটের তলায় হাত রেখে চাপ দেওয়ায়, আর বুকে বুট পরা জওয়ানের চাপে নাসেরের পাঁজরের হাড় ভাঙল দুটি। অপরিসীম যন্ত্রণায় তারা কাতর। তিন দিন ধরে চলল ওই নির্যাতনের পর নির্যাতন। আলতাফ মাহমুদ আর ফিরলেন না। শহীদ হলেন সঙ্গীত ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ।
ইতিমধ্যে গেরিলা যুদ্ধ জোরেশোরে চলছে। গেরিলা যোদ্ধা রুমী হারিয়ে গেছে। শহীদ জননী জাহানারা আপার স্বামী ইঞ্জিনিয়ার শরীফ ইমাম আমার বড় দুলাভাইয়ের অন্যতম বন্ধু, হার্ট অ্যাটাকে পিজিতে ভর্তি হলেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের ফলে সুচিকিৎসা না পেয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। জাতির দুর্ভাগ্য, পাক আর্মির সঙ্গে এখন যোগ দিয়েছে এ দেশে রাজাকার নামে আধা-সামরিক বাহিনী ও আলবদর, আলশামসের মতো দুর্বৃত্ত ঘাতক দল। প্রতিদিন মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠন, খুন-খারাবি, জ্বালাও-পোড়ার মধ্যে তারা নারকীয় কাণ্ডকারখানা চালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিরোধ গড়তে জেগে উঠেছে আবার ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে আপামর জনসাধারণ, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক ও শ্রমিক। পালিয়ে স্বাধীন বেতার কেন্দ্রে যোগ দিল আমার দেবর মানিক আশফাকুর রহমান খান। এ জন্য কাকাকে আর্মিরা ক্যান্টনমেন্টে বারকয়েক জবাবদিহিও করতে হয়েছে। 'ছেলে তার অগোচরে কোথায় চলে গেছে, তার তো করার কিছু নেই'_ বারবার এই কথাই কাকা বলে এসেছেন।
কাকার আরেক ছেলে রতন (ডা. আমানুর রহমান খান) ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। জান হাতে নিয়ে আমরাও সাধ্যমতো যতটা পারি মুক্তিযুদ্ধের ছেলেদের সহযোগিতা দিচ্ছি ওষুধপত্র আর কাপড়-চোপড় দিয়ে। খোকন ভাই (ড. আনোয়ারুর রহমান খান) সাহায্য করছেন তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের। ডাক্তার সাহেব সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের তিনতলায় গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সুচিকিৎসা দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত রেখে দিয়েছিল।
১৬ ডিসেম্বর এক সাগর রক্ত পেরিয়ে বাঙালির চির প্রত্যাশিত বিজয় দিবস। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেছে পাক সামরিক জান্তা। কিন্তু তার আগেই ঘটে গেছে মারাত্মক এক ট্র্যাজেডি। খবরের কাগজে একটার পর একটা বেরিয়েছে সদ্য শহীদ শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তারদের কথা। বিষণ্নতায় মন ভরে উঠেছে। চোখ ফেটে কান্না বেরিয়েছে। কাগজ পড়ছি আর কাঁদছি। ১৩-১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলার সেরা সন্তানদের চোখ, হাত বেঁধে গুলি করে মারা হয় মিরপুরের রায়েরবাজার, মুসলিম বাজার, শিয়ালবাড়ি প্রভৃতি বধ্যভূমিতে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, বাংলাদেশজুড়ে কত বধ্যভূমি, কত কত গণকবর। আমাদের ভাগ্যেও হয়তো এমনটি হতো, যদি না দুলাভাই গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ করতেন।
একাত্তরের মহাবিপর্যয়ের চরম সাক্ষী পাক সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকারদের ডেরা থেকে উদ্ধার পাওয়া বিধ্বস্ত নারীকুল। উদ্ধারকৃতদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছে, কেউ মানসিক বিকারগ্রস্ত, কেউবা অন্তঃসত্ত্বা। প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে নিউ মার্কেটের গেটে ফর্সা, লম্বা এক বিকারগ্রস্ত নারী, যে তার নামধাম কিছুই মনে করতে পারে না; কিন্তু সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে মাতৃত্বের আকুতিভরা চোখে সবার কাছে সাহায্য চেয়ে বেড়াচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বরের পরও মিরপুর পাকবাহিনী এবং আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের কবলমুক্ত হয়নি। এরই মধ্যে প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানকে কে বা কারা ফোনে তার অগ্রজ অমর কথাশিল্পী শহীদুল্লা কায়সার মিরপুরে বন্দি রয়েছেন বলায় তিনি বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে একশ' পুলিশ নিয়ে শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে মিরপুরে যান। পরে নিজেও অন্তর্হিত হন। পুলিশের সঙ্গে পাকবাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর সংঘর্ষে বহু পুলিশও হতাহত হয়। এরপর '৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরলেন। জাতি অগণিত আশায় উল্লাসে উদ্দীপ্ত। যুদ্ধশিশু ও নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হলো। বিদেশ থেকে অনেকে যুদ্ধশিশুদের দত্তক নিতে এসেছেন। 'মাদার তেরেসা হোম' ও নানা প্রতিষ্ঠান এতে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। নারীত্বের অবমাননায় নিগৃহীত নারী বীরাঙ্গনা খেতাবে ভূষিত হলো।
কিন্তু হায়, তাদের অন্তর্দহনের জ্বালা কি মিটেছে? সমাজ নেই, সংসার নেই, তারা যে চরম রিক্ত সর্বহারা!

আখতার জাহান ফরিদা বানু :অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

No comments

Powered by Blogger.