রবীন্দ্রজন্ম সার্ধশততম বছরে আমাদের প্রত্যাশা by আবুল বাশার

২০১১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে এবং ১৪১৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ বাঙালির কবি বিশ্বকবি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মোৎসব ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে পালিত হবে।
এ উপলক্ষে বাংলাদেশে রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শিলাইদহ, শাহজাদপুর, পতিসর ও দক্ষিণ ডিহিতে ৬ থেকে ৮ মে পর্যন্ত তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। ওই অনুষ্ঠানে ভারতের শিল্পী, কবি, বুদ্ধিজীবীসহ বিশিষ্টজনেরা অংশ নেবেন। এ বার্তা আমাদের জন্য আনন্দের। এরপরও আমাদের প্রত্যাশা অনেক। রবীন্দ্র স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হোক। শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্র দর্শন লালিত হোক। এ সবকিছুই আমাদের প্রত্যাশা। ভৌগোলিক অবস্থান এবং আর্থ-সামাজিক ও যোগাযোগ সুবিধার কথা বিবেচনা করে রবীন্দ্রনাথের এ সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীতে তাকে এবং তার দর্শনকে স্থায়ীভাবে রূপ দিতে প্রথমে শাহজাদপুরে এবং পরে শিলাইদহে দুটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন যুক্তিযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয় দুটি স্থাপনের মাধ্যমে শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষি, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রকৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসুলভ জ্ঞানদানে নতুন প্রজন্মকে বিকশিত করার সুযোগ ঘটবে। রবীন্দ্র দর্শনকে স্থায়ীভাবে রূপ দিতে আসুন আমরা সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রস্তাবকে সমর্থন করি, দাবি জানাই, বাস্তবায়নে সহায়তা দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে বরণ করি স্মরণে, মননে, চিন্তায় এবং অনুধ্যানে। এভাবেই পরিপূর্ণতা পাবে রবীন্দ্র স্মরণ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে অবক্ষয়ের সৃষ্টি হয়েছে, এ থেকে উত্তরণের জন্য রবীন্দ্র দর্শনে শিক্ষা গ্রহণের জন্য আজ রবীন্দ্রনাথকে আমাদের বেশি প্রয়োজন। কারণ ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ শিল্প, সাহিত্য, কাব্যে স্রষ্টার ভূমিকায় যতই পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়েছেন, ততই আমরা দেখি তিনি সাধারণ মানুষকে ছুঁতে চেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের কাছে আমরা নানাভাবে ঋণী। এ ঋণ পরিশোধযোগ্য নয়। রবীন্দ্রসাহিত্য এ দেশে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর চিরায়ত সংস্কৃতি, শুভবোধ, মনুষ্যত্ব, চিন্তা, সততা ও মঙ্গলের আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর সে কারণেই বাঙালি জাতীয় চেতনাবোধের উন্মেষ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। সমস্যা, অস্বস্তি, নৈরাজ্য থেকে বাঁচা এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম_ সবসময় রবীন্দ্রনাথ আমাদের আশ্রয়। তাই তো 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' রবীন্দ্রনাথের এ গানটি আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। রবীন্দ্রনাথকে আমরা সঙ্গীত, নৃত্যকলা আর কবিতার মধ্যেই বেঁধে রেখেছিলাম। জীবন সমৃদ্ধির সঙ্গে অঙ্গীভূত করিনি। বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ, কৃষিব্যবস্থা, নদীপাড়ের প্রকৃতি, নদ-নদীর নিত্য ভাঙাগড়ার খেলা রবীন্দ্রনাথের চেতনাজুড়ে স্থান করে নিয়েছিল। সে কারণে তিনি বাংলাদেশের শ্রমজীবী মানুষ ও কৃষির কল্যাণের জন্য নানামুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অর্থনীতির এমন জায়গা নেই, যা স্পর্শ করেননি। তিনি সুষম উন্নয়নের কথা বলেছেন। বলেছেন, 'মজুরির বৈষম্য যেখানে, সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ হতে পারে না।' প্রযুক্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আজও প্রণিধানযোগ্য। মানুষের সীমাহীন লোভের কারণে প্রকৃতি যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এটাও তিনি বলেছিলেন।
শিক্ষা মাত্রই বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার যেনতেন পদ্ধতি রপ্ত করা নয়। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো নিজের প্রশান্তি এবং দেশের উন্নতি সাধন। এই বোধটি বর্তমান প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হলে প্রথমে প্রয়োজন রবীন্দ্র আদর্শে অনুপ্রাণিত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গঠনমূলক শিক্ষাদর্শ এবং কিছু আত্মত্যাগী তরুণ-তরুণীর। আমাদের জাতীয় স্বার্থেই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম ভাবনার সম্মিলন ঘটাতে হবে। 'এই কথাটি মনে রেখো, তোমাদের এই হাসিখেলায়। আমি যে গান গেয়েছিলেম_ জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।' কবিগুরুর এ গানের মর্মবাণী এখনও আমাদের হৃদয়ে বাজাতে হবে। ধর্মে-জীবনে-সমাজে_ সর্বনেশে অন্ধতা, বন্ধনের একচক্ষু বিচার, অপ্রেম আর অবজ্ঞা যেন সমগ্রতই এক দানবীয় অপমানের মতো নেমে এসেছে অচলায়তনের বাধার মতো_ মানবমুক্তির লক্ষ্যপথে।
হ শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
 

No comments

Powered by Blogger.