স্বপ্ন আমাদের মুক্তি by রউফুল আলম

প্রজাতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশ চার দশকেরও বেশি সময় পার করছে। আমাদের একটি সংবিধান আছে, যার বয়সও চলি্লশোর্ধ্ব। এটা নেহাত কম সময় নয়। একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্যদিয়ে আমরা পৃথিবীর বুকে যে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক সীমানা অর্জন করেছি, সেখানে আজ ১৬ কোটি মানুষের বসবাস।
কী অসীম বীরত্বে গাথা আমাদের স্বাধিকারের ইতিহাস, স্বাধীনতার ইতিহাস! অথচ কী দুর্ভাগ্য, আমাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি আজও কত দূর! স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্র কালচক্রে এলো, মানুষের রক্তে রাজপথ লাল হলো, মিছিলে মুখর হলো শহর ও গ্রাম, মানুষ নিপীড়িত-নিগৃহীত হলো, প্রজাতন্ত্রে রাজা এলো, মন্ত্রী এলো_ শুধু প্রজাদেরই প্রকৃত মুক্তি এলো না। এই মুক্তি যেন শুধু আশা-দুরাশার এক দোলক। গত দুই দশকেরও বেশি সময় আমাদের গণতন্ত্র চলছে এক অমসৃণ পথে। সর্বত্র হচ্ছে দলীয়করণ আর আত্মীয়করণের সর্বোচ্চ চর্চা। একটি বহুস্তরবিশিষ্ট দক্ষ, সমন্বয়যুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠছে না, এর পরিবর্তে সর্বত্র হচ্ছে দুষ্ট রাজনীতিকরণ। রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার পরাকাষ্ঠা সমাজকে করেছে অস্থিতিশীল।
প্রতিদিন খবরের কাগজজুড়ে মৃত্যুর এত খবর আমাদের অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়েছে, অনুকম্পা ক্ষণস্থায়ী; বেদনার রেশ না ঘুচতেই আরও মৃত্যুর খবর কড়া নাড়ে। মৃত্যু এত বেশি মাত্রায় এখানে ঘটেছে যে, বেঁচে থাকাটাই এখন বড় প্রাপ্তি। এটাই স্বস্তি। আইন-শৃঙ্খলার অবনতির সঙ্গে দুর্বৃত্তদের দুর্বৃৃত্তপরায়ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিচার ব্যবস্থার অ্যামিবীয় গতির কারণে এবং সঠিক আইনের প্রয়োগ না থাকায় অপরাধ, হত্যা, সহিংসতা, নৈরাজ্য সমাজে লাগামহীন। আমাদের গণতন্ত্র দিনকে দিন অকেজো ও ভোঁতা হচ্ছে। আমাদের রাজনীতি আজ ধ্বংসাত্মক ও রক্তপিপাসু। এই প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি এখন হঠকারী আর দুর্বৃত্তদের হাতে; বিত্ত আর পেশিশক্তির বলয়ে আবদ্ধ-আপামর জনতার মুক্তি। এখানে নিথর রক্তাক্ত লাশ আর জীবিতের আহাজারি-আর্তনাদ আমাদের বিচলিত করে না, আমাদের রাজনীতিকদের বড় বেশি রাজনৈতিক কর্মকা ের কাছে এগুলো হালে পানি পায় না। আমাদের বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক সবাই বহুমাত্রিক চেতনায় বহুবিভক্ত। তরুণ সমাজ সঠিক দিকপালহীন।
সমাজে মূল্যবোধ, মানবতাবোধ, বিবেক, সহিষুষ্ণতা আজ শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের দুঃখবোধ, যন্ত্রণার কাতরতা, ধিক্কার, ক্ষোভ, সবকিছুর ঊধর্ে্ব নরপিশাচদের বাঁচানো সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে ওঠে। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে চলে নিরন্তর কুরুচিপূর্ণ বিষোদ্গার। এখানের সংসদীয় গণতন্ত্রে বরাবরই সংসদ নিষ্প্রাণ এবং একপেশে। নির্বাচনে জয় লাভই বর্তমান রাজনীতির একমাত্র তপস্যা। ক্ষমতার জন্য আমরা সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরাচারী রাজনীতির আশ্রয় নিতেও দ্বিধা করি না। এমন বাংলাদেশ কী আমরা চেয়েছি? এ দেশের অসংখ্য মানুষ তাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসে, মাতৃভূমির বদন মলিন হলে নয়ন জলে ভাসায়। বাংলাদেশের অসংখ্য প্রবাসী দেশের সামান্য যন্ত্রণায় বড় কাতর হয়ে ওঠে, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় কাটায় সময়। তারা দেশকে সুখী ও সমৃদ্ধ দেখতে চায়। এই চাওয়া কী খুব বেশি? লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়ে এই দেশের স্বাধীনতা এনে পরবর্তী প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছিল; এই দেশের মানুষের সার্বিক মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য। আমরা সেই দায়িত্বে কতটুকু ব্রতী হয়েছি? আমরা কতটুকু নিষ্ঠাবান ছিলাম? প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন সেই লক্ষ্য থেকে অনেক বেশি দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত একটি আলোকিত ভোরের স্বপ্ন দেখি। এই দেশের দরিদ্রতা অচিরেই জাদুঘরে স্থান পাবে, বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থেই মানুষের সুবিচার নিশ্চিত করবে, সর্বত্র দলীয়করণের পরিবর্তে সত্যিকারের গণতন্ত্রের চর্চা হবে এমনটা সবারই প্রত্যাশা। মানুষ চায় প্রচারমাধ্যমগুলো কপোরেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত না হয়ে মানুষকে সঠিক ও সমন্বিত সংবাদ দিয়ে বিভ্রান্তির জাল থেকে মুক্ত করবে। একটা আধুনিক, যুক্তিনির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক তরুণ সমাজ তৈরি হবে_ তারা দেশের যে কোনো প্রতিকূলতায় ত্বরিত দানা বাঁধবে। তারা সত্যিকার অর্থে এদেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা চিন্তা করবে, দল-জাতি-ধর্ম সবকিছুর ঊধর্ে্ব এদেশের সব নাগরিকের সুবিধা ও অধিকার বিবেচনা করবে। আমাদের অসংখ্য মানুষের স্বপ্ন এক, আর সেই স্বপ্নের আধার আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমরা স্বপ্নভঙ্গ হই, তবুও স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি সমৃদ্ধির, স্বপ্ন দেখি অধিকারের, স্বপ্ন দেখি মুক্তির। আমাদের মুক্তি হয়তো বহুদূর নয়, শুধু জাগরণ চাই একই সময়ে, স্ফুরণ চাই একই মুহূর্তে। জাগো বাহে, কোনঠে সবাই।
য়রউফুল আলম
সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত
redoxrouf@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.