খালেদা অন্য রূপে

এক অন্যরকম দৃশ্য। রাজধানীর গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ি হয়ে ভাটারা। দীর্ঘ ৪০ কিলোমিটার পথ। মুহুর্মুহু স্লোগানে মুখরিত এ পথে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে গণসংযোগ করছেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। আগে-পিছে ছুটছে হাজারো মোটর বাইক, গাড়ি।
দু’পাশে মানুষের ঢল। হাত নেড়ে সমর্থন, উচ্ছ্বাস। নেই জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর-সংঘর্ষ; নেই পুলিশের অ্যাকশন। শান্তিপূর্ণ কিন্তু উৎসবমুখর। নেতাকর্মীদের সুশৃঙ্খল অংশগ্রহণে গণসংযোগ কর্মসূচিতে প্রশাসনের সদস্যরা পালন করছেন সহযোগিতামূলক ভূমিকা।
কর্মসূচির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা নিরলস। রাস্তায় যানচলাচল তুলনামূলক কম। চিরাচরিত উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচির চিত্র পাল্টে দেয়া এ এক নতুন দৃশ্য। এক নতুন রূপ। এ রূপায়নের নেত্রী খালেদা জিয়া। তিনি অন্যরূপে এসেছেন রাজপথে। গতকাল রাজধানীর মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ দেখেছে তার। গণসংযোগ, প্রচার-প্রচারণার এখন রূপ আগে দেখা গেছে নির্বাচনকালে। আন্দোলনে সংগ্রামে এ রূপ গতকাল দিয়েছে এক নতুন মাত্রা। এ এক নতুন রকম শোডাউন। এর সাংগঠনিক আয়োজনও ভিন্নতর। তাই শীতের তীব্রতাকে উপেক্ষা করে ভোরে গাবতলীর হানিফ পরিবহন মাঠে জড়ো হন ১৮ দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী। সকাল ১১টায় পথসভার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংযোগ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুরো রাস্তা ও প্রতিটি পথসভায় বেড়েছে সমাগম। কর্মসূচিতে রাজধানীর প্রতিটি নির্বাচনী আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো। রাজধানীর পাশাপাশি দেশের ৬টি বিভাগীয় শহরেও অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৮ দলের শান্তিপূর্ণ গণসংযোগ।
অন্য রূপ দেখা দিলেও বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের ভাষায় ছিলেন সমান শাণিত। এখানে ছাড় দেননি কোন। বিএনপির আন্দোলন নিয়ে সরকারের অপপ্রচারের জবাবে তিনি পথসভায় সমবেতদের দেখিয়েছেন আওয়ামীলীগ-জামায়াত নেতাদের মধ্যে অতীতে অনুষ্ঠিত নানা বৈঠকের ছবি। বলেছেন, আওয়ামীলীগের সঙ্গে থাকলে জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধী হন না। বিএনপির সঙ্গে থাকলেই চালানো হয় অপপ্রচার। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে অঙ্গীকার করেছেন ভবিষ্যতে ক্ষমতা গেলে বিএনপিই করবে প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। এছাড়া গণসংযোগে দিনভর সরকারের দুর্নীতির সমালোচনায় মুখর ছিলেন খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অন্য সময়ে পরোক্ষভাবে দুর্নীতির অভিযোগ তুললেও গতকাল বলেছেন সরাসরি। বলেছেন, তীর্যক বাক্যবাণে। প্রধানমন্ত্রীসহ তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের নাম উচ্চারণ করেছেন বারবার। সরকারের পাশাপাশি দুর্নীতি দমন কমিশনকে বিদ্ধ করেছেন অভিযোগের তীরে। তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে আওয়ামীলীগের অতীতের নৈরাজ্য এবং এবার ক্ষমতায় এসে আদালতের মাধ্যমে বাতিলের ঘটনা তুলে ধরে বলেছেন, সাপকে বিশ্বাস করা যায়, আওয়ামীলীগকে নয়। তারপরও সংসদে বিল এনে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালের আহ্বান জানিয়েছেন সরকারের প্রতি। বলেছেন, অন্তত একটি ভাল কাজ করুন। কথা দিয়েছেন- সরকার বিল আনলে আগামী অধিবেশনেই সংসদে ফিরবে বিরোধীদল। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে সরকারকে দায়ী করে ভবিষ্যতে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের হকুমের আসামি করে মামলার হুমকি দিয়েছেন। বিচারের অঙ্গীকার করেছেন সিরাজ সিকদার ও স্টুয়ার্ট মুজিব হত্যা, ইলিয়াস আলী গুমসহ আওয়ামীলীগ সরকারের সময়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের। তবে ন্যায়বিচারের দাবিতে সহযোগিতা চেয়েছেন বিচার বিভাগের। সরে এসেছেন প্রশাসনের কড়া সমালোচনা থেকে। কর্মসূচি শেষে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, চলমান আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতেই গণসংযোগ কর্মসূচি। নৈরাজ্যের মাধ্যমে রক্তক্ষয়, সম্পদের অপচয় ও সাধারণ মানুষের জানমালের ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া নয়- আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের পদ্ধতি ও পরিবেশ নিশ্চিত করতে চান তারা। তাই সাধারণ মানুষের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ এ গণসংযোগে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে বিরোধীদল। আন্দোলনে ভিন্ন রূপ তাদের, অন্য রূপ নেত্রীরও। রাজধানী গাবতলী থেকে যাত্রাবাড়ী হয়ে ভাটারায় পথসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী সরকারের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে বক্তব্য রাখেন।
প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে বিএনপি: ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতেই বিরোধী দলের আন্দোলন’ সরকারি দলের এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে খালেদা জিয়া বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে নয়, দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় আমরা আন্দোলন করছি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমরা পথে নেমেছি। আমরা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চাই। প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়স্বজন যারা দোষী, অপরাধী তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক। ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হোক। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের ট্রাইব্যুনালের রহস্য ফাঁস হয়ে গেছে। ইকোনোমিস্ট ফাঁস করে দিয়েছে। এটা আর জনগণ খাবে না। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই একজন যুদ্ধাপরাধী। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেছেন। খালেদা জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি কিভাবে দাবি করে? তারা তো যুদ্ধ করেনি। তাদের নেতা ছিল পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। সত্যিকার রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের দল বিএনপি।
টাকার বিনিময়ে অপরাধীদের ছেড়ে দিচ্ছে সরকার: রাজধানীর ধোলাইখাল মোড়ে অনির্ধারিত পথসভায় খালেদা জিয়া বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে। আর অপরাধীদের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশকে ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। বেশ কয়েকজন ফাঁসির আসামিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, টাকার বিনিময়ে গোপনে গোপনে আরও কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ছেড়ে দেয়ার প্রক্রিয়া করছে সরকার।
যুবকরা জাগো: যুবসমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, যুবকরা জাগো, জাগো। নিজের জন্য, দেশের জন্য তোমাদের জাগতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল করতে হবে। আজকে যুবকরা বেকার কেন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা লুটপাটে ব্যস্ত থাকায় দেশে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। অবৈধ ভিওআইপির মাধ্যমে বছরে ২০০০ কোটি টাকা লুটপাট করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সরকারের লোকজন জড়িত। সাংবাদিক নির্মল সেনের কথা উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, আমরা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই। আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে  নির্মল সেনের প্রত্যাশা পূরণ করতে তার গ্রামের বাড়িতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করে দেয়া হবে। হে যুবসমাজ- আপনার ভাই গুম হবে, আপনার মা বিলাপ করবে- এটা আর চলতে দেয়া যায় না। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
পাগল দিয়ে দেশ চলে না: শেখ হাসিনার সমালোচনা করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রীর কথা বিশ্বাস করা যায় না। তিনি শুধু মিথ্যা কথা বলেন, অশ্লীল কথা বলেন। তার কথার জবাব আমার দিতে পারবো না। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা কথা বলেন। গালাগালি করেন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে উচ্চ আদালতের ফুল বেঞ্চ বলেছে তিনি রং হেডেড। একজন মাথাখারাপ লোককে চেয়ারে রাখলে কেউ নিরাপদে থাকতে পারে না। এ রকম মাথা খারাপ, দুর্নীতিবাজ ও বেঈমানদের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। পাগল দিয়ে দেশ চলে না। তিনি জনতার উদ্দেশে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা যে কতটা করুণ তা আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। অনুভব করতে পারছেন। তিনি সমবেতদের উদ্দেশে বারবার বলেন, আপনারা কি গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সক্ষম। যে কোন কর্মসূচি পালনে প্রস্তুত। তাহলে আর চুপ করে ঘরে বসে থাকবেন না। তিনি বলেন, সরকারের ষড়যন্ত্রের কারণেই গার্মেন্টে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। নিরীহ বহু মানুষ লাশ হয়েছে। কিন্তু সরকার কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার জনগনের ভোটে নয়, মইন-ফখরুদ্দীনের দয়ায় ক্ষমতায় এসেছে। তাই জনগণকে দমন করে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে চায়। সরকার একের পর এক কেলেঙ্কারি করছে। একটিকে ঢাকা দিয়ে আরেকটি নতুন ইস্যুর সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে এ সরকার জংলি শাসন চালাচ্ছে। তিনি বলেন, অপরাধ করবেন জেলে যাবেন না তা হবে না। বিএনপির আন্দোলন অধিকার আদায়ের আন্দোলন। দেশ ও দেশের মানুষ রক্ষা, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন। দেশের অর্থনীতি ও শিল্প রক্ষার আন্দোলন। বসে থাকার সময় নেই। এখন ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।
গাবতলী থেকে শুরু হয়ে গণসংযোগ বহরটি শ্যামলী, আগারগাঁও, কাওরানবাজার, মগবাজার, গুলিস্তান, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ী, সবুজবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা হয়ে ভাটারা গিয়ে শেষ হয়। খালেদা জিয়ার গাড়িবহরের সঙ্গে ছিলেন এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার (অব.) হান্নান শাহ, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, সাদেক হোসেন খোকা, সেলিমা রহমান, যুগ্মমহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, যুবদল সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, জামায়াতের মুজিবুর রহমান, কল্যাণ পার্টির সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মো. ইবরাহিম বীরপ্রতীক, এনডিপির গোলাম মর্তুজাসহ ১৮ দলের মহানগরের নেতৃবৃন্দ। পুরো পথে তিনি ৬টি পথসভায় বক্তব্য দেন।

No comments

Powered by Blogger.