সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র ফিলিস্তিন

ইসরাইল, তাদের মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং আরো বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী রাষ্ট্রের বিরোধিতা সত্ত্বেও জাতিসংঘের ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ স্বীকৃতি পেয়েছে ফিলিস্তিন। এতদিন ফিলিস্তিন শুধু জাতিসংঘের ‘পর্যবেক্ষক’ ছিল।
বৃহস্পতিবার সাধারণ পরিষদে এ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক এক প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে ফিলিস্তিন ১৩৮-৯ ভোটের ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।

জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্যের সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেয় ১৩৮টি দেশ। তাদের এই দাবির বিপক্ষে ভোট দেয় ৯টি দেশ। আর ভোটদান থেকে বিরত থাকে ৪১টি দেশ।

জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির পর ফিলিস্তিন জুড়ে উল্লাস শুরু হয়েছে। গাজার রাস্তায় রীতিমত উৎসব চলছে। জনতা রাস্তায় নেমে এসে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা হাতে নানা স্লোগানে মেতে উঠে। এছাড়া নিউ ইয়র্ক জাতিসংঘ ভবনের সামনেও ফিলিস্তিনের সমর্থনে জড়ো হয়ে জনতা উল্লাস প্রকাশ করছে।

এরআগে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস সাধারণ পরিষদে বর্তমানের ‘পর্যবেক্ষক’ মর্যাদা থেকে ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ মর্যাদায় উন্নীত করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব তুলে ধরেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘সংকট থেকে ফিলিস্তিন এবং ইসরাইল- দুটি রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে এটিই শেষ সুযোগ।’

তবে তার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে জাতিসংঘে ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত রন প্রসর বলেন, ‘দুটি রাষ্ট্রের মধ্যকার চলমান শান্তি আলোচনাকে এই স্বীকৃতি এগিয়ে নেয়ার পরিবর্তে আরো পিছিয়ে দিবে।’ আর ভোটে জেতার পর ইসরাইলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্র এটাকে দুর্ভাগ্য বলে আখ্যা দিয়েছে।

এরপর সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হয়। প্রস্তাবটি পাস হতে ফিলিস্তিনের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন ছিল। তবে ফিলিস্তিন ১৩৮-৯ ব্যবধানে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেই ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র’ হিসেবে জাতিংসঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে।

তবে এই প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি নিয়ে কার্যত ইউরোপ বিভক্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ভোটদান থেবে বিরত থাকে। তাদের সাথে জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম এবং কলম্বিয়াও ভোটদান থেকে বিরত থাকে।

অন্যদিকে রাশিয়া, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়ে, অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দেয়। এছাড়া ফিলিস্তিনের পক্ষে ভোট দেয়া উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে- চীন, তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নাইজেরিয়া।

ফিলিস্তিন এতদিন জাতিসংঘের ‘পর্যবেক্ষক অঞ্চল’ নয়, ভ্যাটিকানের মত ‘পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের’ স্বীকৃতি দাবি করে আসছিল।

তবে বিরোধিদের বক্তব্য, এ পদক্ষেপ অর্থহীন এবং এতে হিতে বিপরীত হবে। ভোট হলে পশ্চিম তীর সরকারকে তহবিল বরাদ্দ বন্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল।

প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন আদায়ে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস আগে থেকেই প্রচারণা চালিয়েছেন। তাছাড়া এ মাসে ইসরায়েল-গাজা লড়াইয়ের পর ১২টির বেশি ইউরোপীয় রাষ্ট্র ফিলিস্তিনকে সমর্থন দেবে বলে জানিয়েছিল।

এই স্বীকৃতি পাওয়ায় ফিলিস্তিনের পক্ষে এখন জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য পদ পাওয়া আরো সহজ হয়ে গেল। এছাড়া এখন থেকে ফিলিস্তিন ইসরাইলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) যেতে পারবে। তাছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সদস্য হওয়ার পথেও অনেকটা এগিয়ে যাবে।

ফিলিস্তিনের গাজার নিয়ন্ত্রণকারী হামাস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তারা এর বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। হামাসের শীর্ষ নেতা গাজী হামাস মনে করেন, জাতিসংঘে ইসরাইলের ব্যাপারে ফিলিস্তিনকে আরো শক্ত হতে হবে। এরআগেও এমন অনেক প্রস্তাব পাস হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি।

ফিলিস্তিনিরা পশ্চিম তীর, গাজা এবং পূর্ব জেরুজালেম মিলিয়ে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি চেয়ে আসছে। আর এর বিরোধিদের দাবি, কেবলমাত্র ইসরায়েলের সাথে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মধ্যদিয়েই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটুক।

ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ফিলিস্তিন ১৯৯৩ সালের অসলো শান্তিচুক্তির আওতায় আলোচনার মধ্যদিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের পথে না গিয়ে জাতিসংঘের মধ্য দিয়ে তা অর্জনের প্রয়াস নিয়েছে।

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ মনে করে, ইসরাইলের সাথে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে দেশ গঠনের আর সুযোগ নেই। তাই তারা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদেই এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, ১৯৬৭ সালে ৬ দিনব্যাপী যুদ্ধের আগে যে সীমান্ত ছিল সে অনুযায়ী তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে হবে। সে হিসেবে পশ্চিম তীর, গাজা, পূর্ব জেরুজালেম, যা এখন ইসরাইলের মধ্যে আছে, ওইসব অঞ্চল মিলে তাদের রাষ্ট্রের সীমানা নির্ধারিত হবে।

যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের বিরোধিতা করলেও ভোটে জেতার পরে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই স্বীকৃতি ইসরাইলের সাথে শান্তি আলোচনাকে আরো এগিয়ে নেয়ার সুযোগ তৈরি করল।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন বলেন, ফিলিস্তিনের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আবার ইসরাইলেরও রয়েছে নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার। এই স্বীকৃতি দুদেশের মধ্যকার শান্তি প্রক্রিয়া শুরু করার গুরুত্ব পাবে।

ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাস বলেন, তার দেশ শান্তি চায়, জনগণ শান্তি চায়। আর এজন্যই তিনি জাতিসংঘে শান্তির বার্তা নিয়ে জনগণের দাবির কথা বলতে এসেছেন।

উল্লেখ্য, মার্কিন ও বৃটিশ সহযোগিতার মাধ্যমে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূ-খণ্ডে ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় বিশ্বের একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের। ফিলিস্তিনি জনগণকে উচ্ছেদ করে অস্ত্রের মুখে প্রতিষ্ঠিত হয় সামরিক এ দেশটির।

No comments

Powered by Blogger.