চার নতুনকে নিয়ে ওয়ানডেতে নতুন স্বপ্নে বাংলাদেশ by মাসুদ পারভেজ

নাসির হোসেনের কাছে ক্রিকেটটা 'গোল বলের খেলা'। তা ওয়ানডেতে ফিল্ডিং বাধ্যবাধকতার নতুন নিয়মের ফলে সেই গোল বলের 'চ্যাপ্টা' হওয়ার সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে কাল রসিকতায়ও মজলেন কারো কারো সঙ্গে!
এটা রসিকতা ঠিক আছে। একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে নতুন নিয়মের চাপে তাঁর দলেরও 'চিঁড়ে-চ্যাপ্টা' হওয়ার আশঙ্কা আছে। কারণ নতুন নিয়মানুযায়ী ৩৫টি 'নন-পাওয়ার প্লে' ওভারে ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে চারজন ফিল্ডার রাখা যাবে। এতে পেসারদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনার কথা উচ্চারিতই হচ্ছে না। আর তাঁদের জন্য যদি 'মাইনাস' কিছু হয়েও থাকে, নতুন নিয়মে 'প্লাস'ও হয়ে যাচ্ছে ওভারপ্রতি দুটি করে বাউন্সার দেওয়ার বিধানে। সেখানে স্পিনারদের জন্য কিছুই নেই, বরং নতুন নিয়মে তাঁদেরই সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ার কথা বলছেন সবাই। আর বাংলাদেশও যেহেতু স্পিননির্ভর দল এবং ক্যারিবীয় দলেও যখন বিশাল বিশাল শট নিতে জানা শক্তিধর ব্যাটসম্যানের ছড়াছড়ি, নতুন নিয়মের খাদে স্বাগতিকদের পড়ার আশঙ্কা নিয়ে আলোচনায় তাই দোষের কিছু নেই।
ক্যারিবীয় অধিনায়ক ড্যারেন সামি যেমন কাল উচ্চকণ্ঠে বলে দিলেন তাঁর দলে 'বিস্ফোরক'-এর মজুদ যথেষ্টই আছে। বাংলাদেশ অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের মৃদু স্বরে হলেও সদলবলে 'বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট' হয়ে ওঠার ঘোষণায়ও লড়াইয়ের উত্তাপ আছে। দুয়ে মিলে আজ খুলনার শেখ আবু নাসের স্টেডিয়ামে পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম ওয়ানডে নিয়ে কৌতূহলী হওয়ার কারণ আছে যথেষ্টই। বিশেষ করে নতুন নিয়মের চ্যালেঞ্জটা বাংলাদেশের স্পিনাররা কিভাবে সামলান, সেটিও দেখার। আর তাঁদের সামনে যেন মৃত সঞ্জীবনী হয়ে উঠতে চাইছেন স্পিন বোলিং কোচ সাকলায়েন মুশতাক। কাল দুপুরে নিজের মাথা ও বুকের বাঁ দিকটায় হাত দিয়ে আশ্বস্তও করতে চাইলেন এই বলে, 'এখানে (মাথায়) যদি বুদ্ধি থাকে আর এখানে (বুকে) সাহস থাকে, তাহলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।'
বুদ্ধি আর সাহসের উদাহরণ হিসেবে তিনি তুলে আনছেন ঢাকায় সিরিজের প্রথম টেস্টের প্রথম ওভার করা অভিষিক্ত সোহাগ গাজীকে, 'আপনারা দেখেছেন প্রথম ওভারে মার খাওয়া সোহাগ পরের ওভারেও বাউন্ডারি খেয়েছে। কিন্তু তৃতীয় ওভারে এসে ক্রিস গেইলকে ঠিক তুলেও নিয়েছে।' স্পিনারদের জন্য নতুন নিয়মের অসুবিধার কথা বলছেন সবাই। তবে তাঁর সময়ের অন্যতম সেরা স্পিনার সাকলায়েন দেখালেন সুবিধার দিকটাও, 'রিংয়ের ভেতরে পাঁচজন ফিল্ডার থাকার অর্থই হলো সেটা আক্রমণাত্মক ফিল্ডিং সেটআপ। তখন সিঙ্গেলও খুব সহজে আসবে না, ফলে স্পিনারদের উইকেট নেওয়ার সুযোগও থাকবে।' যদিও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের পর বিসিবি একাদশের বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র তাঁর অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ্যেই বলেছেন।
প্রথম ওয়ানডের আগে তাই বাংলাদেশের আশার বিপরীতে হতাশার ছবিও আছে। সে ছবিটাকে আরো বড় করার হুংকারই ধরতে পারেন সামির এ কথাকে, "আমাদের দলে অনেক বিস্ফোরক ব্যাটসম্যান। আমরা 'বাউন্ডারি হিটিং' দল।" তাও আবার ক্রিস গেইল থেকে শুরু করে মারলন স্যামুয়েলস ও কিয়েরন পোলার্ডরা বিশাল বিশাল ছক্কায় প্রতিপক্ষকে সয়লাব করে দিতে জানা ব্যাটসম্যান। বিস্তারিত না বললেও এঁদের ঠেকানোর রণকৌশলও চূড়ান্ত বলে জানালেন মুশফিক, 'ওঁদের কিছু ব্যাটসম্যান আছেন, যাঁদের সবার জন্যই আমাদের পরিকল্পনা করা আছে। আশা করছি পরিকল্পনামতো খেলতে পারলে খুব একটা সমস্যা হবে না।' সমস্যা যা করার তা করবেন মুশফিকের ভাষায় ওই 'কিছু ব্যাটসম্যান'। যাঁদের শারীরিক শক্তির তুল্য বাংলাদেশ দলের কোনো ব্যাটসম্যানই নন। সেটা মেনে নিয়েই বাংলাদেশ অধিনায়ক লড়াইটাকে সীমিত করে ফেললেন এর মধ্যে, 'ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে যেহেতু অনেক বেশি পাওয়ার হিটার আছেন, কাজেই লড়াইটা হবে ওঁদের শক্তির সঙ্গে আমাদের দক্ষতার।' দক্ষতা মেলে ধরার লড়াইয়ে দল এবং দশের বিবেচনায় সবচেয়ে দক্ষ সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই নামতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। ২০০৮ সালের জুন মাসে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে খেলতে যাননি এ অলরাউন্ডার। এরপর সাড়ে চার বছরে আর কখনোই সাকিবকে ছাড়া ওয়ানডে খেলতে নামেনি বাংলাদেশ। নতুন নিয়মের সঙ্গে সাকিবের শূন্যতা পূরণও তাই আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। মুশফিকও সে জন্য সতীর্থদের বাড়তি দায়িত্ব নিতে বলছেন।
কাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় যত দূর খবর, তাতে চারজন ক্রিকেটারকে একই সঙ্গে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হচ্ছে তাঁদের ওয়ানডে অভিষেকেই। অফস্পিনার সোহাগ গাজীর অবশ্য টেস্ট অভিষেক হয়ে গেছে আগেই। খুলনায় টেস্ট অভিষেকেই কোনো দলের ১০ নম্বর ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ইনিংস খেলার রেকর্ড গড়া আবুল হাসানের একাদশে মাশরাফি বিন মর্তুজার সঙ্গে দ্বিতীয় পেসার হিসেবে জায়গা পাওয়ার কথাই কাল রাত পর্যন্ত বেশি শোনা গেছে। সোহাগ আর হাসান আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উত্তাপ আগেই গায়ে মেখেছেন। তবে এনামুল হক বিজয় আর সাকিবের রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে দলে ঢোকা মমিনুল হক আজই প্রথম সে উত্তাপের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন বলে জানা গেছে। এর আগে একসঙ্গে এত ক্রিকেটারের ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল সেই 'প্রাগৈতিহাসিক' যুগে। ১৯৯৫ সালে শারজায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হয়েছিল একসঙ্গে পাঁচজনের। এবার তামিম ইকবালের সঙ্গে ইনিংস ওপেন করার কথা আছে চারজনের একজন এনামুলের। ওয়ানডাউনে নাঈম আর চারে সুবিধামতো মুশফিক নয়তো নাসির, পাঁচে মমিনুল। সাতে মাহমুদ উল্লাহ। প্রথম ওয়ানডেতে বাংলাদেশের ব্যাটিং সজ্জাটা এ রকম হওয়ার সম্ভাবনার কথাই বেশি শুনিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিপক্ষ শিবির থেকে কাল শোনানো ড্যারেন সামির কথাও প্রথম ওয়ানডের আগে বাংলাদেশ দলের আত্মবিশ্বাসের পালে হাওয়া দিতে পারে। আট মাস পর ওয়ানডে খেলতে নামছে বাংলাদেশ; কিন্তু আট মাস আগে এশিয়া কাপে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সজনিত আত্মবিশ্বাস এখনো তাঁদের সঙ্গী বলে জানালেন মুশফিক। সামির কথাও তাতে বাড়তি উজ্জীবনী শক্তির সঞ্চার করছে নিশ্চিত, 'যখনই আপনি মনে করবেন যে তাঁরা পিছিয়ে পড়েছে, তখনই তাঁরা ফিরে আসে। গত টেস্টেই যেমন ৮ ও ১০ নম্বর ব্যাটসম্যান বিশাল একটা পার্টনারশিপ গড়ে ফেলেছিল।'
নতুন নিয়মের চাপে 'চিঁড়ে-চ্যাপ্টা' হওয়ার আশঙ্কায় থাকা দলটি আবারও সেভাবে ঘুরে দাঁড়ায় কি না, প্রথম ওয়ানডের বাংলাদেশ সেই কৌতূহলও কম জাগাচ্ছে না!

No comments

Powered by Blogger.