শেকড়ের ডাক-রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ কমাতে হবে by ফরহাদ মাহমুদ

রাজনীতি এখন সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা- এ রকমটা ভাবার নানাবিধ কারণ রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ ধারণাটি ক্রমেই দৃঢ়মূল হচ্ছে। বাস্তবেও তাই দেখা যায়। ব্যবসায়ীরাই এখন রাজনীতি করেন, রাজনীতিবিদরাও নানা রকম ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িত।
অথচ খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, রাজনীতি পরিচালিত হতো আদর্শের দ্বারা, অর্থ বা বিত্তের দ্বারা নয়। বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক নন, কিন্তু দলের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা, সততা, দেশপ্রেম ইত্যাদি গুণের অধিকারী ব্যক্তিরাই রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব দিতেন, পার্লামেন্টের সদস্য হতেন। সরদার ফজলুল করিমকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সাবেক একজন শিক্ষক এবং একজন লেখক হিসেবেই জানি। খুব একটা বিত্তবৈভবের মালিক তিনি ছিলেন না। অথচ তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানে একজন এমএনএ বা জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। নাম উল্লেখ করতে চাই না, কিন্তু এমন অনেক রাজনীতিবিদ বা এমপি ছিলেন, যাঁদের হাতে পরের দিনের সংসার খরচ চালানোর মতো অর্থও থাকত না। স্বাধীনতার পরও মোটামুটি এই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু তার পর থেকেই রাজনীতি বাঁক নিতে থাকে। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বর্তমানে প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক নন, তেমন কোনো ব্যক্তির পক্ষে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিতে আসার ব্যাপারটি রীতিমতো অকল্পনীয় হয়ে উঠেছে। শোনা যায়, বিগত দিনের সংসদ নির্বাচনগুলোতে কোনো কোনো প্রার্থী ১০ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেছেন জিতে আসার জন্য। এই খরচটিকে অনেকেই 'লগি্ন' বা 'বিনিয়োগ' হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সাধারণত, লগি্ন বা বিনিয়োগ তখনই করা হয়, যখন তা থেকে আরো বেশি পরিমাণে লাভ আশা করা যায়। প্রচলিত এই ধারণাটি কতটুকু সত্য, সেটি বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।
সংসদ নির্বাচনে কয়েক কোটি টাকা খরচ করার বিষয়টি ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিসম্পন্ন বিনিয়োগ কি না সেটি বিবেচনা করা যাক। কথিত মতে, রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতির উদ্দেশ্য দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ। যাঁরা রাজনীতি করেন, বিশেষ করে নির্বাচনে প্রার্থী হন, তাঁরাও সবাই 'জনসেবা' করার সুযোগ চান। সেই সুযোগ পাওয়ার জন্য কয়েক কোটি টাকা খরচ করার কোনো প্রয়োজন আছে কি? কিংবা যাঁদের প্রচুর অর্থবিত্ত আছে, তাঁদের পক্ষ নিয়ে বলা যায়, জনগণের কল্যাণে কয়েক কোটি টাকা খরচ করলে ক্ষতি কি? এ দুটি প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। শুধু একটু তুলনামূলক বিচার করে দেখতে পারি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গিয়ে যে বিত্তবান ব্যক্তিটি কয়েক কোটি টাকা খরচ করলেন, তিনি অতীতে জনকল্যাণে কত কোটি টাকা খরচ করেছেন? হতে পারে, তাঁদের মধ্যে হাজী মুহম্মদ মুহসীনের মতো দানবীর ব্যক্তিও তো থাকতে পারেন! আর হঠাৎ করে কেনই বা তিনি এত জনদরদি হয়ে উঠলেন এবং তাঁর বিত্তবৈভবের উৎসই বা কী- এগুলোও একটু ভাবা দরকার। যদি জনকল্যাণে ব্যয়ের তেমন কোনো রেকর্ড না থাকে, তাহলে নির্বাচনকালীন ব্যয়টিকে বিনিয়োগ হিসেবে সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে। আর তাঁর অর্থবিত্তের উৎস যদি পরিষ্কার না হয়, তাহলে সেই ব্যক্তির প্রার্থিতার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সন্দেহই থাকা উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, ব্যয়ের ধরনটি বিবেচনায় আনতে হবে। সেই ব্যয়টি যদি দাতব্য ধরনের হয় কিংবা দুস্থদের সাহায্যার্থে ব্যয় করা হয়, তাহলে সন্দেহ কিছুটা কম হতে পারে। তার পরও প্রশ্ন থাকে, নির্বাচনের আগে আগে কেন এ ধরনের ব্যয়? আর যদি সেই কোটি টাকা খরচ হয় ক্যাডার তোষণ ও ভোটারদের প্রকারান্তরে ঘুষ প্রদানের মতো কাজে, তাহলে ব্যয়কে বিনিয়োগ না ভেবে উপায় থাকে না। এটা নিশ্চিত যে এই বিনিয়োগ নির্বাচনে জেতার পর বহুগুণে উসুল করে নেওয়া হবে, যা আমরা দেখছি। তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে রুষ্ট হচ্ছি, কিন্তু যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনে একই ভুল করে চলেছি।
নির্বাচনে কোটি টাকা ব্যয়ের সবচেয়ে ক্ষতিকর দিকটি হলো রাজনীতিকে কলুষিত করে ফেলা। অর্থ-বিত্তের প্রতিযোগিতায় যোগ্য, ত্যাগী, আদর্শবান নেতা-কর্মীরা হেরে যান। ক্রমে ক্রমে রাজনীতি থেকেই তাঁরা নির্বাসিত হন। রাজনীতি চলে যায় কালো টাকার মালিকদের হাতে এবং রাজনীতির উদ্দেশ্যই হয়ে উঠে দুর্নীতি ও লুটপাট। নির্বাচনে জিতে আসা প্রার্থী, বিশেষ করে তিনি যদি ক্ষমতাসীন দলের হন, তাহলে তিনি ও তাঁর ক্যাডাররা এলাকায় যা করেন ও করতে পারেন, তা তো আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলবাজিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা তাঁরা করেন না। শোনা যায়, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক থেকে শুরু করে পিয়ন, ঝাড়ুদার পর্যন্ত এমন কোনো পদ নেই, যেখানে নিয়োগে ঘুষ-বাণিজ্য নেই। এরপর বিদ্যালয়ের শিক্ষা-পরিস্থিতির উন্নয়ন আশা করা যায় কি? ক্ষমতাসীনদের কথামতো কাজ না করলে ক্যাডার হোক আর ননক্যাডারই হোক, কোনো কর্মকর্তাই রেহাই পান না। শারীরিকভাবেও লাঞ্ছিত হতে হয়। এমনকি সাধারণ মানুষও এদের হাতে নানাভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। এগুলো সবই কলুষিত রাজনীতির ফসল। এ থেকে আমাদের রেহাই পেতেই হবে। তা না হলে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে, গণতন্ত্র বিপন্ন হবে এবং সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ বাড়তেই থাকবে। এই পরিবর্তনের দায়িত্ব নিতে হবে শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদেরই। রাজনীতির উদ্দেশ্য যদি হয় দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ সাধন, তাহলে তাঁদের সে পথেই হাঁটতে হবে। সংসদ নির্বাচনে সৎ, ত্যাগী ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা আছে এমন ব্যক্তিকেই মনোনয়ন দিতে হবে। তথাকথিত মনোনয়ন-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। প্রশাসন দলীয়করণের মতো ভয়ংকর প্রবণতা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। দলের নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি, অপকর্মসহ সব ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশনকে আরো স্বাধীনতা দিতে হবে এবং শক্তিশালী করতে হবে। প্রশাসনের সব স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজনীতির এই অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি, রাতারাতি সেরেও যাবে না। কিন্তু অব্যাহত প্রচেষ্টা থাকতে হবে এবং শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সদিচ্ছা প্রদর্শন করতে হবে।
অন্যদিকে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। নিজের মঙ্গল-অমঙ্গল বুঝতে হবে। দুর্নীতিবাজ, লুটেরাদের নির্বাচিত করে যে নিজেরই অমঙ্গল ডেকে আনা হয় এবং আরো লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়- তা বুঝতে হবে। এ ব্যাপারে অগ্রসর জনগোষ্ঠীকেই প্রধান ভূমিকা নিতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ যে কাজে আসে, তা তো আমরা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনসহ সাম্প্রতিক অতীতের বেশ কিছু নির্বাচনে দেখতে পেয়েছি। আমাদের মনে রাখতে হবে, কলুষিত রাজনীতির লাগাম টেনে ধরতে না পারলে রাজনীতি ক্রমেই আরো বেশি কলুষিত হতে থাকবে। দেশের উন্নয়নপ্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়বে। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুফল থেকে জাতি বঞ্চিত হবে।

লেখক : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.