ওবামার মিয়ানমার সফরের মূলে

মিয়ানমারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সফরটা ছিল মাত্র ছয় ঘণ্টার। কিন্তু তা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করল। করারই কথা। একে তো এটা ছিল কোনো ক্ষমতাসীন মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রথম মিয়ানমার সফর, তার ওপর দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম সফরেই এত দিন কার্যত একঘরে থাকা দেশটিতে গেলেন ওবামা। এ কারণে তাঁর এই সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞদের জল্পনার শেষ নেই।
অনেকের মনেই প্রশ্ন, বিশ্বের এত দেশ থাকতে ওবামা এখনই মিয়ানমার গেলেন কেন? দীর্ঘদিন লৌহযবনিকার আড়ালে থাকা মিয়ানমারে গত বছরের মার্চে প্রায় নামকাওয়াস্তে বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এসেছে। তার গায়ে এখনো জান্তার গন্ধ। এই সরকার বেশ কিছু রাজবন্দীকে মুক্তি দিয়েছে। সংবাদমাধ্যমকে কিছু স্বাধীনতা দিয়েছে। এই সংস্কার অনেককে চমৎকৃত করলেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা এখনো যে দূর অস্ত, তা নিয়ে কারও মনে সংশয় নেই। রোহিঙ্গাসহ জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিগ্রহ বন্ধ হয়নি। বিশেষ করে রোহিঙ্গা-রাখাইন সংঘাতে রাষ্ট্রযন্ত্র রোহিঙ্গাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে কিনা সে দেশে পা দিলেন বারাক ওবামা!
অনুষ্ঠানসূচির দিকে তাকালে দেখা যাবে, মিয়ানমারে ওবামার সংক্ষিপ্ত সফরের বিষয়বস্তু তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। আসল বিষয় হচ্ছে, এর প্রতীকী তাৎপর্য। থেইন সেইনের সরকারকে একধরনের সতর্ক বৈধতাদান হয়েছে এ সফর দিয়ে। ওবামার সফর ছিল মূলত
ইয়াঙ্গুনকেন্দ্রিক। তাঁর কর্মসূচিতে ছিল প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ও নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎ এবং ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভাষণ।
গণতন্ত্রের পথে সংস্কারের সূচনার জন্য প্রেসিডেন্ট থেইন সেইনকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও অধিকতর নাগরিক অধিকারের তাগিদ দিয়েছেন ওবামা। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, থেইন সেইন গণতান্ত্রিক সংস্কারের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা মিয়ানমারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
এরপর অং সান সু চির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওবামা। এই পর্বটি ছিল খুব হূদ্যতাপূর্ণ ও আবেগঘন। ওবামা পরে সাংবাদিকদের জানান, সু চি কেবল মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীদের নন, গোটা বিশ্বের মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া ভাষণে সরকারের প্রতি জানান, দমন-পীড়ন নয়, মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে একসঙ্গে চলতে হবে। জাতীয় ঐক্য ছাড়া কোনো সংস্কারই পুরোপুরি সফল হবে না। তিনি সংবাদমাধ্যমের প্রতি আরও উদার হওয়ার আহ্বান জানান সরকারকে। এ ছাড়া হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সমাজের অন্য সবার মতো অধিকার দেওয়ার তাগিদ দেন।
হোয়াইট হাউস থেকে ওবামার মিয়ানমার সফরের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হওয়ার পরই আলোচনা শুরু হয়। এর একটা বড় অংশই ছিল সমালোচনা। গুঞ্জন ওঠে, বড় বেশি আগাম হয়ে যাচ্ছে ওবামার এই সফর।
মিয়ানমারের সরকার তো বটেই, অনেকেই ওবামার এই সফরকে দেশটির রাজনৈতিক সংস্কারের প্রতি বড় ধরনের স্বীকৃতি বলে মনে করছে। কাজেই, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই মুহূর্তে ওবামার সফরটি করা উচিত হয়নি। কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ওবামার মিয়ানমার সফরের কঠোর সমালোচনা করেছে।
থাইল্যান্ডের ব্যাংককে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মকর্তা ফিল রবার্টসন জানান, ওবামার সফরকে সামনে রেখে মিয়ানমার সরকার একদল বন্দীকে মুক্তি দিলেও অনেক রাজবন্দীর মুক্তির বিষয়টি উপেক্ষিত হয়েছে। কাজেই, ওবামার সফর যে শুভ ফল বয়ে আনবে, তা বলা যায় না। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই সফরে মিয়ানমার সরকার এই ধারণা পোষণ করতে পারে যে তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উতরে গেছে।
ওবামা অবশ্য পরে ব্যাংককে থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সময় মিয়ানমারের সংস্কারকে পুরোপুরি স্বীকৃতি দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। ওবামা সেখানে জানান, তাঁর মিয়ানমার সফর সেখানে সংস্কারপ্রক্রিয়া চলার স্বীকৃতি হতে পারে, তাই বলে এই নয় যে দেশটিতে গণতান্ত্রিক সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, ওবামার মিয়ানমার সফরের মূলে রয়েছে বাণিজ্য। দীর্ঘদিন ধরে একঘরে হয়ে থাকা মিয়ানমার কাঠ, গ্যাস, মূল্যবান রত্নসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের এই দেশে বিনিয়োগের সুযোগ ও মুনাফার সম্ভাবনা অপার। সেই সুযোগ ও সম্ভাবনাকে পুরোমাত্রায় কাজে লাগাচ্ছে উদীয়মান অর্থনৈতিক পরাশক্তি চীন। সামরিক জান্তার শাসনামলে পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় কাবু মিয়ানমারের একমাত্র বন্ধু ছিল চীন। দেশটির উত্তরাঞ্চলে বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দিয়েছে তারা। মিয়ানমারের এখন মনে হচ্ছে, তারা হয়তো আপনা-আপনি কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে চীনাদের কাছে। একসময় এখনকার এই বন্ধু প্রভু হিসেবে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসতে পারে। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, সেই ঝুঁকি থেকে বাঁচতেই তারা বেসামরিক সরকার বসিয়ে গণতন্ত্রের পথ ধরেছে। এদিকে মিয়ানমারে বিনিয়োগ করে দাঁও মারতে উন্মুখ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোও। নিষেধাজ্ঞার খড়্গ ঝুলিয়ে রেখে নিজেদের আর বঞ্চিত করতে চাইছে না তারা। এ কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, জাপান যতটা সম্ভব দ্রুত মিয়ানমারের ওপর থেকে কড়াকড়ি শিথিল করতে তৎপর। ওবামার মিয়ানমার সফরের প্রাক্কালে হোয়াইট হাউস থেকে দেশটির ওপর আরোপিত আরও কিছু বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার কথা ঘোষণা করা হয়। কোকাকোলা ছয় দশক পর ফিরে যাচ্ছে মিয়ানমারে। সুজুকি ও ভিসার মতো বড় বড় কোম্পানিও ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। ২৫ বছর পর গত আগস্টে মিয়ানমারে কার্যক্রম খুলে বসেছে বিশ্বব্যাংক। দেশটিতে বিনিয়োগের জন্য ২৪ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্যাকেজ নিয়েছে তারা। এভাবে মিয়ানমারকে নিয়ে চীনের সঙ্গে অদৃশ্য এক দড়ি টানাটানি শুরু হয়েছে বিনিয়োগে উৎসাহী অন্য দেশগুলোর। প্রেসিডেন্ট ওবামার সফর সেই প্রতিযোগিতারই একটি পার্শ্বঘটনা।
 আশিস আচার্য

No comments

Powered by Blogger.