পোশাক কারখানায় আগুন: স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির অগ্রগতি প্রতিবেদন- কারখানা ঠিকভাবে তৈরি হলে এত মৃত্যু হতো না by রোজিনা ইসলাম

তাজরীন ফ্যাশনস কারখানাটি কোনোভাবেই শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উপযোগী বা যথাযথ মান পরিপালনকারী (কমপ্লায়েন্ট) কারখানা নয়। কারখানার ভবন তৈরিতেও ন্যূনতম ‘ভবন নির্মাণ বিধিমালা’ অনুসরণ করা হয়নি।
কর্মক্ষেত্রের উপযোগী ন্যূনতম শর্তগুলো মানা হলে এত বেশি শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হতো না।
আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানা পরিদর্শনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রাথমিক অগ্রগতি প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। কারখানা ভবনটি পরিদর্শন করে কমিটি এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ২৪ নভেম্বর রাতে তাজরীন ফ্যাশনস কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের পর চার সদস্যবিশিষ্ট এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১১ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার পর তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিল, তাজরীন ফ্যাশনস অত্যাধুনিক এবং যথাযথ মান পরিপালনকারী বা কমপ্লায়েন্ট। অথচ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি বলছে, কারখানাটি মোটেই যথাযথ মান পরিপালনকারী ছিল না।
প্রাথমিক প্রতিবেদনে কারখানা তদারককারী কর্তৃপক্ষের অবহেলা আছে কি না, তা-ও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে অধিকতর তদন্ত ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কমিটিকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়েছে। শিল্পাঞ্চল পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তদন্তে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কমিটির আহ্বায়ক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাইন উদ্দিন খন্দকার গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তবে ঘটনার কারণ প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। আশা রাখি, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’ তিনি বলেন, এতগুলো মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। প্রকৃত অপরাধীদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে, কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড না ঘটে, সে বিষয়ে সুপারিশ করা হবে বলে জানান তিনি।
কমিটির সদস্যরা হলেন, শিল্পাঞ্চল পুলিশের মহাপরিচালক মো. আবদুস সালাম, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন) মো. আবদুস সালাম এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দর।
অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্ত কমিটি প্রাথমিকভাবে অগ্নিকাণ্ডের তিনটি কারণ সামনে রেখে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। যেমন, বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্টসার্কিট), নাশকতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক বা মানুষের তৈরি কোনো কারণ। ১১১ জন শ্রমিকের মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র থাকলেও ঘটনার দিন একটিও ব্যবহার করা হয়নি। সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, আগুনের সতর্কসংকেত বাজার পরও কারখানার মধ্যম পর্যায়ের ব্যবস্থাপকেরা শ্রমিকদের কারখানা ত্যাগে বাধা দিয়েছেন। ফলে প্রাথমিকভাবে আগুন দেখার পর তা নিয়ন্ত্রণের জন্য একদিকে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। অন্যদিকে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা মালিকপক্ষের লোকজন শ্রমিকদের নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ না দিয়ে বরং কারখানার ভেতরে কাজ করতে নির্দেশ দিয়ে শত শত শ্রমিককে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। এমনকি অগ্নিনির্বাপণ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ থাকা বাধ্যতামূলক হলেও কারখানার মালিকপক্ষ বা শ্রমিকেরা কেউ সাধারণ অগ্নি-আত্মরক্ষা ও অগ্নিনির্বাপণ কৌশল প্রয়োগ করেনি। এ কারণে অগ্নিনির্বাপণ-সংক্রান্ত নাশকতা রয়েছে কি না, তা-ও পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে।
কারখানার অবস্থান বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কারখানার অবস্থান একটি পল্লির ভেতরে। কারখানার সামনের দিকে আট থেকে দশ ফুট রাস্তা। পেছনে তিন দিকে লাগোয়া বাড়িঘর। ফলে এ ধরনের স্থাপনায় স্বাভাবিকভাবেই ফায়ার সার্ভিসের বড় গাড়ি অভিযান চালাতে পারে না। কোনো ধরনের বহির্মুখী জরুরি নির্গমন পথ অথবা বিকল্প সিঁড়ি না থাকায় তৃতীয় ও চতুর্থ তলার শ্রমিকেরা লোহার গ্রিল, কাচ, একজোস্ট ফ্যান ভেঙে জীবন বাঁচাতে পাশের টিনের চালে লাফিয়ে পড়ে। এ কারণেই হতাহতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে।
উল্লেখ্য, ফায়ার সার্ভিসের শর্ত হচ্ছে, কারখানার চারদিক খোলা থাকতে হবে। যাতে চারদিক থেকে আগুন নেভাতে দমকল কর্মীরা আগুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারেন।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা নিশ্চিন্তপুরে তাজরীন ফ্যাশনসে একাধিকবার সরেজমিনে দেখে এসেছেন। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, তাজরীন ফ্যাশনস কারখানার নয়তলা ভবনটির নিচতলার পুরোটাই ছিল গুদাম বা ওয়্যার হাউস। এখানে সুতা ও কাপর গুদামজাত করা হয়। সেখানে ঢুকতেই একটি সদর দরজা, এরপর নিচতলার ওয়্যার হাউসের ভেতর থেকেই তিনটি সিঁড়ি প্রতিটি তলা র্স্পশ করে ছাদে গিয়ে মিলেছে। প্রতি তলার প্রবেশমুখেই কলাপসিবল দরজা।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিচতলার ওয়্যার হাউসে আগুন লাগায় এর অগ্নিদাহ্য সিনথেটিক জাতীয় সুতা, কাপড়ের বিশাল মজুদ থাকায় আগুন লাগার পরপরই পুরো ভবনটি ইটভাটার মতো রূপ নেয় এবং সিঁড়িগুলো হয়ে ওঠে উত্তপ্ত চিমনি। নিচতলার ভয়াবহ আগুনের তাপ, শিখা ও কালো ধোঁয়া তিনটি সিঁড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়। ফলে শত শত কর্মব্যস্ত শ্রমিকেরা প্রচণ্ড কালো ধোঁয়ার বহির্গমনের কোনো পথ না পেয়ে দম বন্ধ ও পরবর্তী সময়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যান।
কমিটি বলেছে, কারখানার নিচতলায় কোনো ধরনের ওয়্যার হাউস থাকার বিধান না থাকলেও এ ক্ষেত্রে তা প্রতিপালন হয়নি। ফলে আগুন থেকে অনেক বেশি প্রাণহানি ঘটেছে।
সব শেষে কমিটির মতে, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে একের পর এক পাটের গুদামে আগুন দেওয়ার মতো নাশকতার সঙ্গে সাম্প্রতিক একের পর এক পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনা একই প্রকৃতির কি না বা অন্য কোনো নাশকতা কার্যক্রম রয়েছে কি না, তা বিবেচ্য বিষয় হিসেবে কমিটি পর্যালোচনা করছে। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্ত করার কাজ চলছে। আটক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আজ কথা বলবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

No comments

Powered by Blogger.