অ্যান্টেনায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার by নুরুন্নবী চৌধুরী

কাজকে সহজ করার জন্য নানা ধরনের প্রযুক্তির উদ্ভাবন হয়। আর এসব প্রযুক্তির উদ্ভাবকেরা উদ্ভাবন করেই থেমে থাকেন না, আরও কী কী বৈশিষ্ট্য বা সুবিধা যোগ করা যায়, সেসব নিয়ে চলে নিরন্তর গবেষণা।
কাজকে আরও সহজ করা এবং কাজে লাগবে এমন প্রযুক্তি বর্তমানে তৈরি করছেন আমাদের দেশের তরুণেরাও।
বেতার যোগাযোগে অ্যান্টেনা লাগেই। আর এখন গবেষণা চলছে পরিধানযোগ্য অ্যান্টেনা নিয়ে। এমন একটি কাজের সুপার ওয়াইড ব্যান্ড (এসডব্লিউবি) অ্যান্টেনা তৈরি করেছেন বাংলাদেশের তরুণ মো. সাদ মাহমুদ। শুধু তাই নয়, অ্যান্টেনাটি তৈরি করে তিনি সম্প্রতি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার।

অ্যান্টেনা প্রযুক্তি
প্রযুক্তির সুবিধা বাড়ার পাশাপাশি বর্তমানে চিকিৎসা, খেলাধুলা ও সামরিক ক্ষেত্রে যেসব প্রযুক্তিতে তারের ব্যবহার ছিল, সেগুলো এখন তারহীন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে যোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যম হিসেবে পরিধানযোগ্য অ্যান্টেনা আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে জানালেন সাদ মাহমুদ। তিনি বললেন, ‘পরিধানযোগ্য প্রযুক্তির ওপর মানুষের আগ্রহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে এবং এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে এসডব্লিউবি অ্যান্টেনার সঙ্গে টেক্সটাইল প্রযুক্তি। সব মিলিয়ে নমনীয় ফেব্রিক অ্যান্টেনার চাহিদা বেড়েই চলেছে, যা খুব সহজে পোশাকের সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়। এই বিষয়টি নিয়ে আমার গবেষণা।’

গবেষণা ও পুরস্কার
গবেষণার শুরুটা হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়। ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের (এআইইউবি) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশল (ইইই) বিভাগের শিক্ষক শুভাশিস দে ও নন্দিতা সাহার তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেন সাদ মাহমুদ। এসডব্লিউবি তৈরির আগে তিনি তৈরি করেছেন আল্ট্রা ওয়াইড ব্যান্ড অ্যান্টেনা (http://goo.gl/8kflZ), লোগো অ্যান্টেনা (http://goo.gl/ZwzuX) ও অ্যান্টেনা ফর হেলথ মনিটরিং (http://goo.gl/T9SQ1)। তিনটি গবেষণাই স্থান পেয়েছে ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার্স (আইইইই) এক্সপ্লোরার নামের ডিজিটাল গ্রন্থাগারে। এর পরেই গবেষণা শুরু করেন এসডব্লিউবি অ্যান্টেনা নিয়ে। এআইইউবি থেকে ইইই বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট সংযোগ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলা লায়নের গবেষণা বিভাগের নির্বাহী হিসেবে কাজ করছেন সাদ মাহমুদ।জানালেন, গবেষণার কাজটি মূলত ছিল এসডব্লিউবি পরিধেয় টেক্সটাইল অ্যান্টেনার নকশা এবং এর কর্মদক্ষতার বিষয় নিয়ে। তিনি বলেন, এই নমনীয় অ্যান্টেনার স্তর একটি টেক্সটাইল ফেব্রিক দিয়ে তৈরি, যার নাম ডেকরন ফেব্রিক। বিষয়টা এমন, আমার তৈরি অ্যান্টেনাটি শরীরে থাকা পোশাকের সঙ্গেই থাকবে। অর্থাৎ পোশাকই হবে অ্যান্টেনা! এর ফলে এই অ্যান্টেনা ব্যবহার করে নানা ধরনের কাজ করা যাবে। এর মধ্যে রয়েছে: রোগীদের সর্বশেষ অবস্থান, মহাকাশচারীদের কার্যক্রম সহজে জানা, বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের কার্যক্রম ইত্যাদি।’
এসডব্লিউবি অ্যান্টেনা তৈরি করে আইইইই আয়োজিত বাৎসরিক অ্যান্টেনা-বিষয়ক সবচেয়ে বড় সম্মেলন ইন্টারন্যাশনাল সিম্পোজিয়াম অন অ্যান্টেনাস অ্যান্ড প্রোপোজিশন (আইএসএপি) ২০১২ (www.isap12.org)-এ বিশেষ পুরস্কার জিতেছেন সাদ মাহমুদ। জাপানের নাগোয়া কংগ্রেস সেন্টারে অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে পোস্টার প্রেজেন্টেশন অ্যাওয়ার্ড, স্টুডেন্ট পেপার কনটেস্টে ফাইনালিস্ট এবং ইয়ং সায়েন্টিস্ট অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। এতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ২৫০টি প্রকল্প নিয়ে অংশ নেন ২৪৯ জন পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পিএইচডি শিক্ষার্থী ছাড়া এই আয়োজনে অংশ নেওয়া একমাত্র ছাত্র ছিলেন সাদ মাহমুদ! গৌরবময় এই আয়োজনে অংশগ্রহণকারীরা নিজের প্রকল্পের পোস্টার প্রদর্শন করেন, যার মধ্যে চারজনকে পুরস্কৃত করা হয়। এর মধ্যেও একজন নির্বাচিত হন সাদ। পুরস্কার হিসেবে সনদপত্র ছাড়াও পেয়েছেন নগদ অর্থ। আগের তিনটি প্রকল্পের পাশাপাশি এসডব্লিউবি অ্যান্টেনা প্রকল্পটিও খুব শিগগির আইইইই এক্সপ্লোরারে যুক্ত হবে।

শুরুর কথা
২০১১ সালের শুরুর দিকে অ্যান্টেনা বানানোর সঙ্গে যুক্ত হন সাদ মাহমুদ। বললেন, ‘শুরুতে অ্যান্টেনা-বিষয়ক বিভিন্ন জার্নাল পড়ে জানতে পারি কী কী কাজের অ্যান্টেনা ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে আর কী কী হয়নি। পরে অনেক খুঁজে কয়েকটি বের করি, যেগুলো নিয়ে তেমন কাজ হয়নি। দেখা গেছে, ব্যান্ড অ্যান্টেনা নিয়ে অনেক কাজ হলেও এসডব্লিউবি অ্যান্টেনা নিয়ে তেমন কাজ হয়নি। এর মধ্যেই আল্ট্রা ওয়াইড, লোগো আর মাইমো অ্যান্টেনা তৈরি করি, যা আইইইই অনুমোদন করে। এর পরেই এসডব্লিউবি অ্যান্টেনা বানানোর কাজে হাত দিই।’ তবে বিষয়টা সহজ ছিল না বলে উল্লেখ করে সাদ বলেন, এ কাজে ব্যবহূত সিএসটি স্টুডিও সফটওয়্যারটির মূল্য অনেক বেশি। নানাভাবে সফটওয়্যারটি ব্যবহারের সুযোগ পাওয়ার পর কাজে হাত দিই। সিএসটি স্টুডিও ছাড়া অ্যান্টেনাটি তৈরি করতে ব্যবহার করা হয় এইচএফএসএস সফটওয়্যার।’
‘পরিধেয় অ্যান্টেনা বর্তমান সময়ে একটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র’, বলেন তিনি। যোগ করেন, ‘আমার প্রস্তাবিত অ্যান্টেনা নকশা অন্যান্য অ্যান্টেনার তুলনায় আকারে অনেক ছোট এবং নমনীয় উপকরণের সঙ্গে অনেক বড় ব্যান্ডউইথ প্রদান করে। তার সঙ্গে দেয় ভালো ফলাফল। এতে এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যাতে শরীরের ক্ষতি হওয়ার সম্ভবনা নেই। সাধারণত স্পেসিফিক অ্যাবজরপশন রেট ২-এর নিচে থাকলে শরীরের ক্ষতি হয় না। আমাদের অ্যান্টেনায় এ রেট রয়েছে ১.১।’ তবে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি পুনরাবৃত্তি আর্দ্রতা এবং পোশাক ইস্ত্রি করার পর আচরণ, স্থায়িত্ব ও সিস্টেমের কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন। এসব নিয়ে আরও কাজ করতে হবে বলে জানান তিনি।

ভবিষ্যৎ অ্যান্টেনা কার্যক্রম
বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা অ্যান্টেনা তৈরির কার্যক্রমে তেমন ভালোভাবে জড়িত নন। যদিও এই খাতে রয়েছে যথেষ্ট সম্ভাবনা। সাদ মাহমুদ বলেন, ‘নিজের ভালোলাগা আর ইচ্ছা থেকেই এই গবেষণায় যুক্ত আছি।’ জাপান থেকে ফেরার পর টয়োটা সেন্ট্রাল আর অ্যান্ড ডি ল্যাবস ইনকরপোরেশনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা প্রকল্প ব্যবস্থাপক হাইদিয়ো উজুকা যোগাযোগ করে তাঁর সঙ্গে কাজ করার আমন্ত্রণ জানান সাদকে। এ ছাড়া, এসডব্লিউবি অ্যান্টেনাটি কীভাবে টয়োটায় যুক্ত করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করতে নিজের আগ্রহের কথাও জানিয়েছেন হাইদিয়ো। বর্তমানে হাইদিয়োর সঙ্গে গবেষণাকাজ করছেন সাদ।

এগিয়ে যাওয়া
দেশের তরুণেরা নানা ধরনের গবেষণায় এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের নাম তুলে ধরবেন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। এর জন্য প্রয়োজন দেশে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার জন্য সুযোগ করে দেওয়া। তবেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সাফল্য আসবে তরুণদের।

No comments

Powered by Blogger.