বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় জাহাজ নির্মাণ শিল্প by ইফতেখার আহমেদ টিপু

দেশে যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠা, নিঃসন্দেহে দেশের জন্য সুখকর সংবাদ। দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা একান্ত আবশ্যক। আশা করি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান সে চাহিদার অনেকটাই পূরণ করতে পারবে।
স্বাধীনতার আগে বাঙালিদের বড়জোর আদার ব্যাপারি ভাবা হতো। প্রচলিত প্রবচনের তত্ত্ব অনুযায়ী জাহাজ নিয়ে মাথা ঘামানো ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ বিষয়। স্বাধীনতার চার দশক পর একসময়ের নিষিদ্ধ বিষয়টি আজ সমৃদ্ধির হাতছানি হয়ে দেখা দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, জাহাজ শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। নদী-নালার দেশ বাংলাদেশের মানুষ নৌযান তৈরিতে অভ্যস্ত শত শত বছর ধরে। ব্রিটিশ শাসন সম্ভবত সে ঐতিহ্যে ব্যত্যয় ঘটায়। ছোট ও মাঝারি ধরনের নৌযান তৈরিতে বাংলাদেশের সক্ষমতা ইতিমধ্যে প্রশংসা অর্জন করেছে। এ দেশের তৈরি জাহাজ জার্মানিসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে রপ্তানি হচ্ছে। ইউরোপ বা অন্যত্র যে খরচ হয় বাংলাদেশে তার অন্তত ২৫ শতাংশ কম খরচে জাহাজ তৈরি করা সম্ভব। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় এ খাতে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সমূহসম্ভাবনা রয়েছে। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান যেমন সম্ভব হবে, তেমনি প্রযুক্তি আয়ত্তের ক্ষেত্রেও অগ্রগতি ঘটবে।
নতুন সম্ভাবনার পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এ অবস্থায় পুঁজি বিনিয়োগকারীরা এ খাতে আরো মনোযোগী হলে ভবিষ্যতে এ শিল্পকে ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন বিপ্লবের সূচনা ঘটবে। শুধু তা-ই নয়, জাহাজ নির্মাণে এ মুহূর্তের বিশ্ববাজারের বিশাল চাহিদা কাজে লাগানো সম্ভব হলে এ খাতটি দেশের বিদ্যমান সব রপ্তানি খাতকে ছাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রথম স্থানে উন্নীত হতে পারে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বিনিয়োগকারী ও এ খাতের বিশেষজ্ঞরা এমন মন্তব্য করেছেন।
এ ছাড়া জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আসবাব, দরজা-জানালা, গ্রিল, ট্রলি, লাইফ জ্যাকেট, লাইফ বোট, মেরিন লাইটিং, নোঙর, লোহার শিকল, ইলেকট্রনিকস সামগ্রী ইত্যাদি তৈরি ও সরবরাহ করার জন্য ছোট ছোট অসংখ্য লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠেছে। সব মিলে কর্মসংস্থানের অপার সম্ভাবনা হিসেবে দেখা দিয়েছে এ শিল্প।
নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠা জাহাজ নির্মাণ শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। বিদেশে যে জাহাজ তৈরি করতে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি টাকা ব্যয় হয়, মাত্র ৯-১০ কোটি টাকা দিয়ে তা এখানকার ডকইয়ার্ডগুলোতে নির্মাণ করা সম্ভব। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা অর্থাৎ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ সহজলভ্য করা এবং এ শিল্পের আমদানি করা কাঁচামালের কর কমানো হলে বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প বিশ্বের সমীহ অর্জনে সক্ষম হবে। জাহাজ শিল্পের বিকাশ দেশে দক্ষ কারিগর গড়ে তুলতে অবদান রাখবে। আজকের যুগে যার গুরুত্ব অপরিসীম বললেও অত্যুক্তি হবে না। বাংলাদেশ নদী-নালার দেশ। খুব সহজেই এ দেশে ডকইয়ার্ড গড়ে তোলা সম্ভব। উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। এ সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহার আমাদের কর্তব্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।
জানা গেছে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার অনেক দেশ জাহাজ নির্মাণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ সমাগম করেছে। জাহাজ নির্মাণ করে তারা অর্থনৈতিক উন্নয়নের চরম শিখরে পেঁৗছেছে। বলা বাহুল্য, বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সন্দেহ নেই এতে বাড়বে রপ্তানি আয়। তবে এর জন্য সরকারি সহযোগিতা ও সাহায্যের প্রয়োজন রয়েছে। প্রয়োজন রয়েছে জাহাজ নির্মাণ ও জাহাজ ক্রেতার কাছে হস্তান্তরের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।
জাহাজ নির্মাণ শিল্প নিঃসন্দেহে জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সরকার জাহাজ শিল্প নির্মাণে নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। দেশকে বেকারমুক্ত করতে হলে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার বিকল্প নেই। আর সে জন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। দেশে জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে অনেক কর্মকর্তা ও শ্রমিক যেমন আর্থিক দিক থেকে লাভবান হবেন, অন্যদিকে দেশও অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হবে।
দেশে যেভাবে জাহাজ তৈরির অর্ডার আসছে সেগুলো যদি গ্রহণ করা যেত তাহলে এখনই বছরে অনায়াসে কয়েক বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করেছে। তাই এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন আরো উন্নত প্রযুক্তি দক্ষ শ্রমিক গড়ে তোলা। সেই সঙ্গে প্রয়োজন ব্যাংকের সহায়তা এবং সরকারের সুনজর।

লেখক : সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক নবরাজ, চেয়ারম্যান ইফাদ গ্রুপ।
chairman@ifadgroup

No comments

Powered by Blogger.