চরাচর-রিকশাচিত্র by আহমেদ রিয়াজ

'রিকশাচিত্রের মধ্যে এমন একটা স্বাতন্ত্র্যের ব্যাপার আছে, যা খুব সহজেই আমাদের একান্ত নিজস্ব শিল্প-আঙ্গিক হিসেবে পরিচিত হতে পারে। এই সম্ভাবনাটিকে আমি খুব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি এবং আমার ছবিতে একে ব্যবহার করি, বিশেষ করে রং ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমি আমাদের রিকশাচিত্রীদের কাছে ঋণী।
আমার ছবিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ও বর্ণবৈচিত্র্যের ব্যাপারটা রিকশাচিত্র থেকেই এসেছে।' এক সাক্ষাৎকারে রিকশাচিত্র নিয়ে নিজের অভিব্যক্তি এভাবেই প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের আর্টিস্ট নাজলী লায়লা মনসুর। এখন তো চিত্রকলার আলাদা একটি মাত্রা হিসেবে জায়গা নিয়েছে রিকশাচিত্র। যদিও অনেকে মনে করতে পারেন, রিকশার পেছনে যেকোনো চিত্র আঁকলেই সেটা রিকশাচিত্র। মূল বিষয়টি কিন্তু তা নয়। রিকশাচিত্রের নিজস্ব যে ধরন, সেটা হচ্ছে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে যেকোনো বিষয়ের উপস্থাপন। আর রংটা হতে হবে উজ্জ্বল। শিল্পকলার গুণীরা এ ধরনের চিত্রকলাকে ফোক আর্ট, পপ আর্ট কিংবা ক্রাফট- যেকোনো দিক থেকেই দেখেন। তাঁদের মতে, যেকোনো বস্তুরই 'ফর্ম' আর 'ডেকোরেশন' নামে দুটি দিক থাকে। রিকশাচিত্রের রয়েছে কেবল 'ডেকোরেশন'। এর কোনো ব্যবহারিক দিক নেই। রিকশাচিত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এর টান বা আঁচড়গুলো খুবই সাবলীল, প্রাণবন্ত, স্পষ্ট এবং ছোট ছোট অথচ নিখুঁত। আর আমরা সবাই কমবেশি জানি যে এই বিশেষ চিত্রকলার জন্য রিকশাচিত্রকরদের নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। একেবারে নিজেরা প্রকৃতি থেকে যা শেখেন এবং যা কল্পনা করেন, মনের মাধুরী আর রঙের মিশেল ঘটিয়ে সেটিই ফুটিয়ে তোলেন তুলির আঁচড়ে। বাংলাদেশে রিকশাচিত্রের প্রচলন শুরু হয় পঞ্চাশের দশক থেকে। কেবল রিকশার পেছনেই নয়, রিকশার যেখানেই আঁকার মতো জায়গা পাওয়া যায়, সেখানেই রয়েছে চিত্র। জ্যামিতিক নকশার পাশাপাশি থাকে ফুল, পাখি, জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, সিনেমার কোনো দৃশ্য। আবার কখনো চিত্রকরের ধর্মীয় বিশ্বাসও ফুটে ওঠে রিকশাচিত্রে। থাকে মসজিদ, দেব-দেবীর ছবি। প্রাকৃতিক পরিবেশের ছবিও দেখা যায় কখনো কখনো। অনেক সময় 'আমারে মাইরেন না', 'খাইছি তোরে', 'এ পথ যদি না শেষ হয়' ধরনের মজার কথাবার্তা থাকে। থাকে সামাজিক সচেতনতামূলক পরামর্শও।
রিকশাচিত্র যাঁরা আঁকেন তাঁরা 'পেইন্টার' নামেই পরিচিত। সাধারণত এনামেল পেইন্ট দিয়েই তাঁরা আঁকেন। রাজধানীর বকশীবাজার, বেড়িবাঁধ, মোহাম্মদপুর, ঝিগাতলা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তানসহ বেশ কয়েক জায়গায় রয়েছেন এমন পেইন্টার। তাঁরা নতুন রিকশা যেমন পেইন্ট করেন, তেমনি পুরনো রিকশাও ঘষেমেজে পেইন্ট করে দেন। তবে দিন দিন কমে যাচ্ছে এসব পেইন্টারের কদর। হাতে আঁকা এসব রিকশাচিত্র এখন দেখা যায় না বললেই চলে। বিভিন্ন জায়গা থেকে ছবি এনে কম্পিউটারে কাটছাঁট করে সাজিয়ে ছাপ দেওয়া হয় টিনের ধাতব প্লেটে। তারপর সেগুলো লাগানো হয় রিকশার পেছনে- ঠিক সেখানে, যেখানে একসময় শোভা পেত উজ্জ্বল রিকশাচিত্র। ভারতের হায়দরাবাদী পথচিত্র, যা একসময় রিকশাচিত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেল, সেই ঐতিহ্যবাহী রিকশাচিত্র কি হারিয়ে যাবে? এমনিতেই রিকশাচিত্রীরা ভালো নেই। কমে গেছে কাজ। তবে রিকশায় না থাকলে কী হবে, এখন রিকশাচিত্রের জায়গা হয়েছে বিভিন্ন ফ্যাশন অনুষঙ্গে। জুতা, পোশাক, গামছা, দেয়ালচিত্র, কুশন, ঘর সাজানোর উপকরণ, ঘরোয়া আসবাব, শৌখিন শোপিসে তো আছেই, রিকশাচিত্র ঠাঁই নিয়েছে কাঠের চুড়ি, ব্যাগ, ঝুড়ি আর ফতুয়ায়ও। উচ্চবিত্তদের কাছে রিকশাচিত্রের মর্যাদা যেখানে নেই বললেই চলে, সেখানে রিকশাচিত্রের এমন বিস্তার- এটা কিন্তু রিকশাচিত্রেরই সফলতা। চিত্রশিল্পী হিসেবে রিকশা 'পেইন্টার'দের এখানেই সার্থকতা।

No comments

Powered by Blogger.