হামাস কি ইসরায়েলের চোখ খুলে দিতে পেরেছে? by গাজীউল হাসান খান

কথায় বলে, ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। নতুবা আট দিনব্যাপী ক্ষুদ্র গাজার ওপর শক্তিশালী ইসরায়েল সর্বাত্মক সামরিক হামলা চালিয়েও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবিরতির জন্য হন্যে হয়ে উঠবে কেন? ১৩ নভেম্বর থেকে এক সপ্তাহের কিছুটা বেশি সময়ের মধ্যে গাজার ওপর ইহুদিবাদী ইসরায়েল আকাশপথে প্রায় দেড় হাজার বার আক্রমণ চালিয়েছে।
হত্যা করেছে হামাসের আল-কাসাম সামরিক ব্রিগেডের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারসহ প্রায় ১৫০ জন নিরস্ত্র-নিরপরাধ নারী-পুরুষ ও শিশুকে। শক্তিশালী বোমার আঘাতে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে গাজার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অসামরিক স্থাপনা ও বসতি। তারা গাজার অন্যতম নেতা এবং বিশেষ করে গাজার প্রশাসনিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার সরকারি দপ্তরটিও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইহুদিবাদী নেতা ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মূল উদ্দেশ্য ছিল এবারের আক্রমণের মুখে গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি জঙ্গি সংগঠন হামাসকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু তাদের সে ইচ্ছা মোটেও পূরণ হয়নি। ড্রোন ও বিমান হামলার মুখে গাজাভিত্তিক হামাস ও ইসলামী জেহাদ বাহিনী পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় প্রথমে গাজার দক্ষিণে ইসরাইয়েল আশকেলন শহর এবং পরে রাজধানী তেলআবিব ও জেরুজালেমের ওপর। ক্ষুদ্র ভূমধ্যসাগরীয় ফিলিস্তিনি শহর গাজা থেকে হামাস ও ইসলামী জেহাদ বাহিনীর কৌশলগত ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল ইসরায়েলের গর্বিত ও আধিপত্যবাদী ইহুদি নাগরিকরা। শেষ পর্যন্ত হামাস যখন প্রথমবারের মতো উন্নত ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র 'ফজর-৫' দিয়ে ইসরাইয়েলের রাজধানী তেলআবিব ও জেরুজালেমের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানা শুরু করেছিল, তখনই প্রমাদ গুনলেন ইহুদিবাদী ও দক্ষিণপন্থী ইসরাইয়েলি রাজনৈতিক মোর্চার প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। নতুন বছরের শুরুতে অনুষ্ঠিত হবে ইসরায়েলের সাধারণ নির্বাচন। তার আগে গাজাভিত্তিক অপ্রতিরোধ্য হামাস বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, ফিলিস্তিনের মাটি, বিশেষ করে গাজা ভূখণ্ড থেকে হামাসকে উৎখাত করতে পারলে পুরো আরব ভূখণ্ডেই (ফিলিস্তিন) তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। আরো বাড়বে ইহুদি জনসমর্থন এবং ইহুদিবাদী ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁর আর কোনো বিকল্প নেতা খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিধি হলো বাম! সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সমর্থন থাকা সত্ত্বেও নেতানিয়াহুর ষড়যন্ত্র কার্যকর করা গেল না।
গতবার, অর্থাৎ ২০১১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনকালে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে ফিলিস্তিনি জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছিলেন বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও নিউ ইয়র্ক থেকে দেশে ফিরলে ফিলিস্তিনিরা ফুলেল সংবর্ধনা দিয়েছিল প্রেসিডেন্ট আব্বাসকে। কিন্তু ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইহুদিবাদী নেতানিয়াহুর অব্যাহত বসতি নির্মাণ ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার প্রশ্নে তাঁর বিরোধিতা, প্রেসিডেন্ট আব্বাসের অবস্থানকে আবার অতি দ্রুত নড়বড়ে করে দিয়েছিল। আব্বাস পরে জাতিসংঘে একটি পর্যবেক্ষক সদস্য রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভের প্রস্তাব দিলেও ইহুদিরাষ্ট্র ইসরায়েলের অন্যতম প্রধান মিত্রশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁকে নিরুৎসাহি করেন। ওবামার সামনে তখন দ্বিতীয় দফার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত প্রভাবশালী ইহুদি লবি ও নাগরিকদের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কায় প্রেসিডেন্ট ওবামা সে বিষয়টি নিয়ে অগ্রসর হতে নিষেধ করেছিলেন বৃদ্ধ ফিলিস্তিনি নেতা আব্বাসকে। সে সুযোগে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে, বিশেষ করে গাজায় শত্রু নিধনে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন নেতানিয়াহু। ড্রোন হামলায় বেছে বেছে হত্যা করা শুরু করেছিলেন হামাস নেতা ও তাদের সামরিক ফ্রন্টের কমান্ডারদের। তার জবাবে অবরুদ্ধ গাজার হামাস সামরিক ফ্রন্ট তাদের পার্শ্ববর্তী ইসরাইয়েলি ভূখণ্ডে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা শুরু করেছিল। এর আগে গাজা সফর করেছিলেন মিসরের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মুসরি ও কুয়েতের আমির হামাদ বিন থানি। তাঁরা গাজার অতীতের ধ্বংসযজ্ঞ সরিয়ে সেখানে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করার জন্য সাহায্যের আশ্বাস ব্যক্ত করেছিলেন। এবারের সর্বশেষ আক্রমণের আগে, অর্থাৎ ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে গাজায় সংঘটিত ইসরাইয়েলর তিন সপ্তাহব্যাপী অসম ও আসঞ্জস্যপূর্ণ সশস্ত্র আক্রমণের কারণে প্রায় এক হাজার ৪০০ গাজাবাসী নিহত ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল বসতিসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অসামরিক স্থাপনা। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন ইসরায়েলকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত করলেও ইহুদিবাদী লবির ষড়যন্ত্র ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যায় সহযোগিতার কারণে ফিলিস্তিনিরা কোনো বিচার পায়নি। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবাগিশ প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাঁর অন্যান্য ইসরাইয়েল-বান্ধব পূর্বসূরির চেয়ে কম কলঙ্কিত হননি। ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য ওবামা বারবার তাঁর ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়েছেন ইহুদি চক্রের চাপের মুখে। একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব সিদ্ধান্তকে ওবামা পাশ কাটিয়ে গেছেন নানা অজুহাতে এবং পশ্চিম তীরে ও পূর্ব জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর অন্যায়ভাবে বসতি নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সম্প্রতি আবার দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হয়েছেন বারাক ওবামা। নির্বাচনের পরপরই তিনি দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও 'ফিসক্যাল ক্লিফ' নিয়ে ঘর সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে অর্থাৎ প্রতিনিধি পরিষদে তাঁর দল ডেমোক্র্যাটস্দের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তাঁকে রক্ষণশীল রিপাবলিকানদের সঙ্গে কর নির্ধারণ, সেবামূলক বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ কাটছাঁট এবং আগামী বাজেটের বিভিন্ন পর্যায়ে সমন্বয় সাধনের জন্য হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে ফিলিস্তিনের আরব ভূখণ্ডে আধিপত্যবাদী ইসরায়েলের বর্তমান ইহুদিবাদী ও দক্ষিণপন্থী নেতাদের বিভিন্ন আগ্রাসী কর্মকাণ্ডের দিকে নজর দেওয়া তেমনভাবে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সে সুযোগে নির্বাচনকে সামনে রেখে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও ফ্যাসিবাদী কায়দায় নেতানিয়াহু ও তাঁর আগ্রাসী পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিবারম্যান গাজার ওপর চরম আঘাত হানার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। হামাস মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুডের অনুসারী হলেও লেবাননের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল্লাহ এবং সর্বোপরি ইরানের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক সমঝোতা রয়েছে। তারা শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত না হলেও ইরানের সঙ্গে ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে হামাসের একটি শীর্ষ পর্যায়ের সমর্থন ও সংহতির প্রশ্ন রয়েছে, যে সম্পর্ক পশ্চিম তীরের প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন আল-ফাতাহর ততটা গভীর নয়। ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে জন্মলগ্নে ফাতাহ যতটা জঙ্গি কৌশল গ্রহণ করেছিল ক্রমে সেখান থেকে সরে এসে তারা কূটনীতির আশ্রয় গ্রহণ করে। সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্ন সুদূরপরাহত হয়ে পড়ছে বলে মনে হলে গাজাভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন হামাসের গুরুত্ব বেড়ে যায় মুক্তিকামী ফিলিস্তিনিদের কাছে। ফিলিস্তিনিরা ইহুদিবাদী ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গোপন আঁতাতের কারণে এখন তাদের মুক্তির প্রশ্নে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছে। ফলে এখন তাদের অনেকেই স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে যে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ ছাড়া তাদের মুক্তি আর সম্ভব নয়। সাধারণ ধর্মপ্রাণ ফিলিস্তিনিদের কেউ কেউ এখন পবিত্র কোরআনে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের সম্পর্ক নিয়ে যা বলা হয়েছে তার উদ্ধৃতি দিয়ে থাকে। সেগুলো বিশ্বের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একটি অংশ এবং বিশেষ করে ইহুদিবাদীরা জেনে গেলেও তাদের কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো গঠনশীল পরিবর্তন আসছে না। খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়ের একটি প্রগতিশীল অংশ ভূমির পরিবর্তে শান্তি প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। কিন্তু ইহুদিবাদী দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের কাছে তার কোনো গুরুত্বই নেই। এ ধরনের ইহুদিবাদীর সংখ্যা শুধু ইসরায়েল রাষ্ট্রেই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ইহুদিদের মধ্যেও যথেষ্ট রয়েছে। তাদের মধ্যেই আবার পাওয়া যায় ইহুদিবাদী বিত্তশালীদের অনেককে। তারা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে থাকে। তাদের পাশ কাটিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক রাজনীতিক তাঁদের অর্থ, সমর্থন ও সহযোগিতারই রাজনীতি বা নির্বাচন করে থাকেন।
গত ২৩ নভেম্বর আমি নিউ ইয়র্ক থেকে নায়াগ্রা দিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে কানাডা প্রবেশ করি টরন্টো নগরী সফরের উদ্দেশ্যে। নায়াগ্রা জলপ্রপাতের কাছে একটি নিউজ স্ট্যান্ড থেকে ডেইলি টরন্টো স্টারের একটি কপি কিনে যে খবরটি আমার সবার আগে চোখে পড়ে ছিল, তা হলো : Hamas left stronger than ever. অর্থাৎ 'হামাস আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক শক্তিশালী।' তাতে টরন্টো স্টারের ওয়াশিংটন ব্যুরো থেকে মিচ পটার হামাস নেতা খালেদ মেশালের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি অতীত ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়ে গাজা ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত আট দিনের সংঘর্ষ ও যুদ্ধবিরতির প্রতিবেদনটি লিখেছেন। তিনি বলেছেন, ১৫ বছর আগে ইসরায়েলের শাসন ক্ষমতায় প্রথমবারের মতো অধিষ্ঠিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন হামাসের তৎকালীন রাজনৈতিক প্রধান খালেদ মেশালকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার উদ্দেশ্যে জর্দানে মোশাদের গুপ্তচরদের পাঠিয়েছিলেন। তারা ইনজেকশনের মাধ্যমে খালেদের দেহে অত্যন্ত শক্তিশালী ঘাতক বিষ প্রয়োগ করতে সক্ষম হলেও আশ্চর্যজনকভাবে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গিয়েছিল। তারা কানাডার জাল পাসপোর্ট নিয়ে জর্দানে ঢুকেছিল বলে কানাডা ও ইসরায়েলের মধ্যে তখন এক বিরাট কূটনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল, যা সমগ্র বিশ্বে অত্যন্ত বিস্ময় ও আতঙ্কের জন্ম দেয়। খালেদ মেশালের দেহে বিষ প্রয়োগের কারণে তার প্রতিষেধক পাঠানোর ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলকে বাধ্য করা হয়েছিল। নেতানিয়াহু সরকারের পাঠানো প্রতিষেধকের (antidote) কারণে খালেদের জীবন রক্ষা হয়েছিল। এখানে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ১৫ বছর আগে বিষ প্রয়োগ করে যে খালেদকে নেতানিয়াহু হত্যা করতে চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ীই মিসরে হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পন্ন হয়। তাতে পর দিন গাজাব্যাপী মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষ উৎসব পালন করেছিল। নেতানিয়াহু চিরদিনের মতো যে হামাস নিয়ন্ত্রিত বাহিনীকে পরিষ্কার করে ফেলতে চেয়েছিলেন, তা এখন হিতে বিপরীত হয়েছে বলে তথ্যাভিজ্ঞ মহল মনে করে। হামাস মহাশক্তিশালী ইসরায়েলবিরোধী প্রতিরোধমূলক হামলায় টিকে থাকার জন্য এখন শুধু গাজাতে নয়, সমগ্র ফিলিস্তিন ও আরব বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সমগ্র বিশ্ব এখন হিজবুল্লাহ জঙ্গি বাহিনীর মতো হামাসকেও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করেছে। যে হামাসের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু থেকে শুরু করে ইসরায়েলের কোনো রাজনীতিকই কথা বলতে পর্যন্ত রাজি ছিলেন না, সে হামাস নেতারাই এখন ফিলিস্তিনব্যাপী যেকোনো নির্বাচনে বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। সুতরাং ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে ভবিষ্যতে হামাস নেতাদের সঙ্গেই কথা বলতে হবে। শক্তি প্রয়োগ কিংবা বোমাবর্ষণ করে গাজাকে নিশ্চিহ্ন করা আর সম্ভব হবে না। তাতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলও অক্ষত থাকবে না। গত আশুরার দিন বৈরুতে ভাষণদানকালে হিজবুল্লাহ নেতা শেখ হাসান নাসরাল্লাহ হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, ইসরায়েল যদি লেবাননে হামলা চালায় তা হলে হিজবুল্লাহ তেলআবিব ও জেরুজালেমেও পাল্টা আক্রমণ চালাবে। উল্লেখ্য, হিজবুল্লাহ বাহিনী ২০০৬ সালে ৩৪ দিনব্যাপী ইসরায়েলের হামলার মুখে যুদ্ধ করে টিকে ছিল। একই ঘটনা ঘটবে ইসরায়েল যদি পরমাণু প্রশ্নে মিথ্যা অজুহাতে ইরান আক্রমণ করতে যায়। ইরান আক্রান্ত হলে ইসরায়েল যে তার সমুচিত জবাব পাবে, এখন আর তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মিচ পটার লিখেছেন, গাজা আক্রান্ত হওয়ার ১০ দিন আগেও বিচ্ছিন্ন ও পরিত্যাজ্য হামাস ছিল রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত। হামাসের অস্তিত্ব হয়ে পড়েছিল বিপন্ন। কিন্তু ইসরায়েলের হামলার মুখে হামাসের প্রতিরোধ নেতানিয়াহুকে বাধ্য করেছে সীমান্ত থেকে তাঁর স্থল বাহিনীকে ফিরিয়ে নিতে। বর্তমান যুদ্ধবিরতি একটি নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয়ে যাবে। তাই গাজা থেকে অবিলম্বে ইসরায়েলি অবরোধ উঠিয়ে নিতে হবে। বন্ধ করতে হবে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি নির্মাণ। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখার লক্ষ্যে ইসরায়েলি অপকৌশল ত্যাগ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিভিন্ন চাপের মুখে রেখে আর বেশি দিন ঝুলিয়ে রাখা যাবে না ফিলিস্তিনের মুক্তির বিষয়টি। শান্তিপূর্ণভাবে ফিলিস্তিনসহ মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমাধান না হলে এ অঞ্চলে জঙ্গিবাদ একটি মুক্তির অন্যতম পথ বা আদর্শে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাতে ইসরায়েলের অস্তিত্বের ওপর যেমন বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে, তেমনি বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও তার শুধু ভাবমূর্তি নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বন্ধুদের হারিয়ে ফেলতে পারে।
টরন্টো থেকে
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.