হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি-দুর্নীতির পরিণতি by হায়দার আলী

ঢাকার রমনা থানার হাজতখানায় প্রায় মুখোমুখি দুটি কক্ষ। একটিতে আছেন হলমার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ আর মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তানভীরেরই ভায়রা তুষার আহমেদ। সামনের কক্ষেই আছেন তানভীরের স্ত্রী ও হলমার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম।


প্রায় মুখোমুখি দুই কক্ষে থাকলেও এই আপনজনদের এখন আর মুখ দেখাদেখিরও উপায় নেই। ওদিকে পল্টন থানার হাজতখানার একটি কক্ষে আছেন সোনালী ব্যাংকের সদ্য বরখাস্ত হওয়া উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এ কে এম আজিজুর রহমান।
এই চারজন দেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের বৃহত্তম দুর্নীতি 'হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারি'র চার হোতা। নজিরবিহীন জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা থেকেই প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। সেই টাকা দিয়ে এত দিন দিব্যি তাঁরা দাপটের সঙ্গে বিলাসবহুল জীবনযাপন গেছেন। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁদের আশ্রয় হয়েছে থানাহাজতের অন্ধকার কক্ষে। সেখানে কেমন কাটছে তাঁদের দিনকাল, সে চিত্রই ফুটে উঠেছে সরেজমিন অনুসন্ধানে। থানাহাজতে বাহারি খাবার নেই, জোটে শুধু হালুয়া-রুটি আর ডাল-ভাত; মশার কামড়, টয়লেটের দুর্গন্ধ, ভাপসা গরম। আরামদায়ক বিছানার পরিবর্তে ঘুমাতে হচ্ছে শুধু মেঝেতে। সেই চিত্র দেখে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একেই বলে 'দুর্নীতির করুণ পরিণতি।'
ভোগবিলাস থেকে করুণ হাল : গতকাল শুক্রবার সকাল সোয়া ৮টায় রমনা থানায় গিয়ে দেখা যায়, ডিউটি অফিসারের পাশেই হাজতখানা। একটি কলহের ঘটনায় হাজতে আটক মশিউর রহমানের স্ত্রী এসেছেন খাবার নিয়ে। কিন্তু হাজতখানার গ্রিলের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রহরী পুলিশ কনস্টেবল নিয়াজউদ্দিন তাঁকে খাবার সরবরাহে বাধা দেন। প্রহরী 'বোতলের পানি ছাড়া অন্য কিছু দেওয়ার নিয়ম নেই। থানা থেকেই হাজতিকে হালুয়া-রুটি দেওয়া হয়। অগত্যা ওই হাজতির স্ত্রী শুধু পানির বোতল রেখে খাবার নিয়ে ফিরে যান।'
এক প্রশ্নের জবাবে প্রহরী কনস্টেবল নিয়াজ এ প্রতিবেদককে বলেন, 'হাজতে দুদকের রিমান্ডের আসামি হলমার্ক গ্রুপের তানভীর, তাঁর স্ত্রী জেসমিন ও ভায়রা তুষার আছেন। তাঁদেরকেও বাইরের খাবার দেওয়া হয় না। সবাইকে থানা থেকে যে খাবার দেওয়া হয়, সেই খাবারই খাচ্ছেন তাঁরা।'
থানার ডিউটি অফিসার এসআই আকলিমার সামনে রয়েছে সিসি ক্যামেরা। তাতে মনিটরিং হচ্ছে হাজতখানার দৃশ্যও। কম্পিউটারের স্ক্রিনে কয়েকটি জায়গার ছবি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মধ্যে তানভীর-তুষার এবং জেসমিনের কক্ষ দুটিও আছে। কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যায়, তানভীরের গায়ে জামা নেই, পরনে লুঙ্গি। হাজতের মেঝের একপাশে বসে আছেন তানভীর ও তুষার। তুষারের গায়ে টি-শার্ট ও পরনে লুঙ্গি। দুজন মুখোমুখি বসে বিষণ্ন মুখে কথা বলছেন। পাশেই অন্য হাজতিরা মেঝেতে শুয়ে আছেন। আর মহিলা হাজতখানায় দেখা যায়, তানভীরের স্ত্রী জেসমিন মেঝেতে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন। গায়ে একটি চাদর। থানার একজন মহিলা পুলিশ কনস্টেবল নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হাজতে আসার পর অনেকক্ষণ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেননি জেসমিন। রাতে কোনো খাবার খাননি। তবে স্বামীর খোঁজ নিয়েছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের এক উপ-পরিদর্শক বলেন, ঘুমানোর সময় হাজতিদের বালিশ দেওয়া হয় না, পানির বোতল মাথার নিচে দিয়ে ঘুমায়। তানভীর-তুষারকে থানা থেকে সরবরাহ করা হয়েছে একটি কম্বল, যে কম্বলটি চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারী থেকে শুরু সবাই ব্যবহার করে। তাঁদের জন্য গোসল-টয়লেটের আলাদা ব্যবস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে থানার একজন কনস্টেবল হাসতে হাসতে বলেন, 'ভাইরে, কারো গোসলের জন্য আলাদা কোনো ব্যবস্থা নেই, যেখানে তাঁরা খান, তার পাশেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেন। সেখানেই গোসল করেন। ট্যাপের নিচে মাথা দিয়ে গোসল করতে হয়।' একপর্যায়ে তিনি আফসোসের সুরে বলেন, 'পরের টাকা মেরে অনেক সুখ করছে, এইবার হাজতখানায় থেকে দেখুক- দুর্নীতির পরিণতি কারে কয়।'
রমনা থানার অফিসার ইনচার্জ শাহ আলম বলেন, হলমার্কের কর্মকর্তাদের সকালে খাবার দেওয়া হচ্ছে পুলিশের নির্ধারিত মেস থেকে আনা হালুয়া আর রুটি। রাতে ভাত, তরকারি, ডাল। এর বাইরে অন্য কোনো খাবার দেওয়া হয় না। এমনকি আত্মীয়স্বজনরা খাবার নিয়ে এলেও সেগুলো সরবরাহ করা হয় না। তবে দুপুরের খাবারের ব্যাপারে পুলিশ কর্মকর্তা পরিষ্কার করে কিছু বললেন না।
তানভীর-জেসমিনের বিলাসী জীবন : জানা যায়, মাত্র এক দশক আগে ঢাকার আগারগাঁও তালতলা বাজারে ছোট্ট একটি মুদি দোকান ছিল তানভীর মাহমুদের। সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো যাঁকে, সেই তানভীর মাত্র এক দশকের ব্যবধানে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে যান। মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় গড়ে তোলেন আলীশান বাড়ি। কারুকার্যখচিত ঘরবাড়ি, বিদেশি ফিটিংস, ঝাড়বাতি। বাড়ির পাশেই গাড়ির গ্যারেজ, কমপক্ষে ১২টি গাড়ি গ্যারেজে, অদল-বদল করে ব্যবহার করেন। পাজেরো, প্রাডো, ল্যান্ড ক্রুজারের মতো দামি গাড়ির সমাহার। যখন যেটি পছন্দ হতো, সেই গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যেতেন। তানভীরের চলাফেরা ছিল রাজকীয় স্টাইলে। রাজপথে তাঁর গাড়ির আগে-পিছে থাকত আট থেকে ১০টি গাড়ি। সামনে ও পেছনের গাড়িতে থাকত তাঁর নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। এরা সবাই তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে কখনো একটি-দুটি গরু কিনতেন না, কিনতেন ট্রাক ভরে।
শেওড়াপাড়া এলাকায় তাঁদের কয়েকজন প্রতিবেশী জানায়, দুই বছর আগে ভাড়া বাড়ি ছেড়ে নিজেদের বিলাসবহুল বাড়িতে ওঠেন তানভীর-জেসমিন দম্পতি। মাসে মাসে তাঁরা নতুন মডেলের গাড়ি কিনতেন। তাঁদের চলাফেরা ছিল রাজকীয়। তাঁরা বাড়িতে ঢোকার আগে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীরা বাঁশি ফুঁকে সতর্ক করতেন অন্যদের। কোনো অনুষ্ঠান হলে হাজারো মানুষকে দাওয়াত করে খাওয়াতেন। দেশের প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও এসব অনুষ্ঠানে আসতেন।
'কপালে ছিল বলেই হাজতে আছি' : আর্থিক সুবিধা নিয়ে হলমার্ক গ্রুপকে ভুয়া কাগজপত্রে অর্থ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন সোনালী ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান (বরখাস্তকৃত)। হলমার্ক-সোনালী ব্যাংক কেলেঙ্কারির সময় তিনি ছিলেন সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন (বর্তমান রূপসী বাংলা) শাখার ব্যবস্থাপক। দুদকের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন তিনি থানাহাজতে আটক আছেন। গতকাল শুক্রবার সোয়া ৯টায় পল্টন থানায় গিয়ে দেখা যায়, হাজতখানার একটি কক্ষের পূর্বপাশের দেয়াল ঘেঁষে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন আজিজ। একটি কাপড়ের ব্যাগকে বালিশ বানিয়ে মাথার নিচে দিয়েছেন।
থানাহাজতে কেমন কাটছে সময়- প্রশ্ন করলে আজিজুর রহমান করুণ কণ্ঠে বলেন, 'রুমে পাখা নাই, বিছানা নাই। কেমন কাটছে তা আর কী বলব! কপালে লেখা ছিল বলেই আজ হাজতখানায় থাকতে হচ্ছে।' এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কেউ কোনো মারধর করেনি, বেশি খারাপ ব্যবহার করে না। আর থানায় সবার কাছ থেকেই সহযোগিতা পাচ্ছি।'
হলমার্কের ঋণ পাইয়ে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে আজিজ বলেন, পত্রপত্রিকায় সব কিছু উল্টাপাল্টা শুধু লেখে। আসল কথা কেউ লেখে না। আসল কথা কী- জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি কোনো সুবিধা নিইনি। আমাকে জড়ানো হয়েছে।' তাহলে দুদকের কাছে দুর্নীতির কথা স্বীকার করেছেন কেন- প্রশ্ন করলে আজিজ বলেন, চাপে পড়ে অনেক কিছু স্বীকার করতে হয়।
তবে পরে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া মাত্রই তিনি বলেন, 'ভাই, এসব লিখে কী হবে? আপনি উল্টাপাল্টা লিখলে আপনাকেও দুদকের কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করবে। দয়া করে আপনি কিছু লিখবেন না।'
হাজতখানার সামনে থেকে বের হতেই দেখা যায়, এক যুবক টিফিন বক্স নিয়ে দাঁড়িয়ে। নাম জানান মোহতাসিম হোসেন চৌধুরী। কার কাছে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আজিজুর রহমানের জন্য খাবার দিতে এসেছি। তিনি আমার মামা হন।'
কিছুক্ষণ পর এলেন আজিজের ছোট বোনের স্বামী জাকির হোসেন, হাতে একটি ব্যাগে গামছা আর লুঙ্গি নিয়ে। তিনি বলেন, তাঁর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক নেই। এখন যেহেতু তিনি বিপদে পড়েছেন, তাই একটু দেখতে এসেছি'- বলেই তিনি দ্রুত পল্টন থানা থেকে চলে যান।
পল্টন থানার ডিউটি অফিসার বাবুল হোসেন বলেন, 'এই ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে একই কক্ষে চোর-ডাকাত-চাঁদাবাজরাও থাকেন। সবার জন্য এক ব্যবস্থা। কারো জন্য আলাদা কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই।' সূত্র : এপি, এএফপি, সিবিএস নিউজ।

No comments

Powered by Blogger.