শিল্প বিনিয়োগের টুটি চেপে ধরা কার স্বার্থে? by মোহাম্মদ শাহ নওয়াজ

চাহিদার সাথে উৎপাদনের সামঞ্জস্য না থাকায় গ্যাস সংকটের কথা বলে বিগত তিন বছরের অধিক সময় ধরে শিল্প খাতে এবং দুই বছর ধরে আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে।

সারা দেশে উৎপাদন শুরু করতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত এমন শত শত শিল্প কারখানা গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারছে না। ব্যাংক ও ব্যক্তিখাতের হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে কয়েক বছর ধরে। উৎপাদন শুরু করতে না পারা এসব শিল্প প্রতিষ্ঠনের উদ্যোক্তারা সময়মত ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে এখন দেউলিয়া হবার উপক্রম। বিশ্ববাজারে ফার্নেস অয়েলের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকায় গ্যাসনির্ভর এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বিকল্প জ্বালানি ব্যবহার করেও উৎপাদন শুরু করতে পারছে না।

শিল্প ও পরিবহণ খাত ছাড়াও রাজধানী ঢাকা ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ দেশের প্রধান শহর ও গুরুত্বপূর্ণ বহু এলাকায় রান্না-বান্নার জ্বালানি হিসেবে জনগণ ব্যাপকভাবে এ গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই উৎপাদনের চাইতে চাহিদার পরিমাণ বেশি হওয়ায় গ্যাস অপ্রতুলতার কারণে বাণিজ্যিক, শিল্প ও আবাসিক ক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু নতুন সংযোগ প্রদানই বন্ধ করা হয়নি, বিদ্যমান গ্রাহকদেরও দিন-রাতে পালা করে নির্দিষ্ট সময় বন্ধ রেখে গ্যাস রেশনিং প্রথা চালু করা হয়।

নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ না থাকলে গ্যাসনির্ভর যে সব শিল্প কারখানা উৎপাদন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছার আগেই পর্যাপ্ত চাপ না থাকায় আর উৎপাদনেই যেতে পারে না অথবা রফতানি নির্ভর তৈরি পোশাক শিল্প মালিকসহ নানা শ্রেণীর উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখানো হলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। চাহিদার তুলনায় গ্যাস অপ্রতুলতার অজুহাতে বন্টন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নির্ধারণে প্রধান্য পায় বোরো মওসুমের আগে সার কারখানা আর গ্রীষ্ম মওসুমে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো। এ নিয়েও নানা ভোগান্তির অন্ত ছিল না।

বিগত চার দলীয় জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে গ্যাস, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে কিছুই করা হয়নি, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-কর্তারা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর মুখেও দেশবাসী দীর্ঘদিন ধরে এমন অভিযোগ শুনে আসছে। বলা হচ্ছিল, এ সরকার এ দু’খাতের উন্নয়নে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো কসুর করবে না। কার্যত, কিছু পদক্ষেপ যে নেয়া হয়েছে তা সত্যি, যদিও এসব পদক্ষেপের ধরন-ধারণ সম্পর্কে এবং অর্থনীতিতে এগুলোর দীর্ঘমেয়াদী ফলাফল ও প্রভাব সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে ঘোরতর দ্বিমত ও আপত্তি রয়েছে।

বাংলাদেশ শুধু গুটিকয় রফতানিপণ্য নির্ভর দেশ নয়, আমদানি-রফতানি আয়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক ভারসাম্যহীন অর্থনীতির একটি দেশ। অর্থাৎ রফতানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় তো অনেক বেশি। তাছাড়াও রফতানি ঝুড়িতে রফতানিযোগ্য পণ্য যেমন গুটিকয় হাতে গোনা তেমনি মান ও প্রতিযোগিতার ধারভারে সর্বক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানেও এখনো পৌঁছাতে পারেনি। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদরা বরাবরই বলে আসছেন, গুটিকয় রফতানিপণ্য নির্ভর বিশেষ করে আমদানি-রফতানি আয়ে ব্যাপক ভারসাম্যহীন অর্থনীতির যেকোনো দেশ তার অর্থনীতি নিয়ে বেশ ঝুঁকিতে থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের প্রধানতম রফতানি খাত হচ্ছে তৈরী পোশাক যেখান থেকে যোগান আসছে মোট রফতানি আয়ের ৭৬ শতাংশ। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দেশের অর্থনীতি ঠিকে আছে তৈরী পোশাকখাত ও প্রবাসী আয় থেকে। এমন ভঙ্গুর ও ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতিকে মধ্যমমানের ঠেকসই ও মোটামুটি সুস্থ অবস্থায় রাখতে মোক্ষম দাওয়াই হচ্ছে দেশীয় ও সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়িয়ে বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা ক্রমশঃ কমিয়ে আনা।  

কিন্তু দেশীয় কিংবা বিদেশী বিনিয়োগে, যেভাবেই হোক না কেন, শিল্পায়নে গ্যাস, বিদ্যুতের বিকল্প তো কিছু নেই। আমাদের কৃষিখাতে তো দীর্ঘদিন ধরে কর্মসংস্থান ক্রমাগত কমছে। সেক্ষেত্রে কর্মসংস্থান, উৎপাদন আর রফতানি  বৃদ্ধির জন্য শিল্পখাত ছাড়া আমাদের হাতে আর কি যুৎসই বিকল্প আছে? সহজ ও সরল উত্তর হচ্ছে কার্যকর ও আশাজাগানিয়া কোনো বিকল্পই নেই। তাহলে গ্যাস সংযোগ বন্ধ রেখে এভাবে শিল্পখাতে অভ্যন্তরীণ ও দেশীয় বিনিয়োগের টুটি চেপে ধরার পেছনের কারণ কি? গত কয়েক বছরের সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) বাস্তব পরিস্থিতি হলো যেখানে ২০০৫ ও ২০০৬ সালে এফডিআই ছিল যথাক্রমে ৮৪৫.৩ মিলিয়ন ও ৯৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সেক্ষেত্রে ২০০৯ ও ২০১০ সালে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৭০০ মিলিয়ন ও ৯০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের কোটায়। মার্কিন ডলারের তুলনায় টাকার বড় ধরনের মূল্যমান হ্রাস ও দেশীয় অর্থনীতির পরিধি ও ক্ষেত্রের বিস্তৃতির পরও এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে ৩/৪ বছর পরও এ হতশ্রীদশার কারণ কি?

সরকার এক আদেশবলে ২০০৯ সালের ২১ জুলাই থেকে শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতে এবং ২০১০ সালের ১৩ জুলাই থেকে আবাসিক খাতে গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুর গত বছর খানেক ধরে বলে আসছিলেন, গ্যাসের উৎপাদন দৈনিক ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট নিশ্চিত করা গেলে গ্যাসের নতুন সংযোগ দেয়া শুরু করা হবে। সাঙ্গুসহ পুরানো গ্যাসক্ষেত্র থেকে বর্ধিত গ্যাস উৎপাদন ও খাগড়াছড়ির সিমুতাং, ফেনীর সুন্দলপুরসহ নতুন বেশ কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে বেশ ভালো পরিমাণ গ্যাস জাতীয় গ্রিডে ইতিমধ্যে যুক্ত হলেও নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদানের কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। বরং জ্বালানি উপদেষ্টা ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান দৃশ্যত বিপরীত মেরুতে অবস্থান নিয়ে খেলা দেখছেন, প্রতিনিয়ত নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান নিয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে প্রাণ ওষ্ঠাগত শিল্পদ্যোক্তাদের ধৈর্য পরীক্ষা করছেন।

এক্ষেত্রে একজন উদ্যোক্তার নতুন গ্যাস সংযোগ পেতে রক্ত-ঘাম ঝরানো হয়রানি ও সরকারের মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের দরবারে বছরের পর বছর ধরে করুণ আকুতি প্রকাশের প্রকৃত চিত্র যদি দৈনন্দিন ক্রমানুসারে লিপিবদ্ধ করা যেত তাহলে বিশ্বের যেকোনো অঞ্চলের সবচেয়ে হয়রানি-প্রবণ আমলা ও স্বৈরশাসকও লজ্জা পেতেন। এই উদ্যোক্তার ঘনিষ্ঠজন সূত্রে জানা যায়, নিজস্ব তহবিল ও বেসরকারি একটি ব্যাংকের ঋণ নিয়ে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বিনিয়োগে এই উদ্যোক্তা একটি কম্পোজিট টেক্সটাইল কারখানা স্থাপন করেন ২০০৮ সালের শেষের দিকে। অবকাঠামো উন্নয়ন ও আমেরিকা, চায়না থেকে মেশিনারিজ আমদানি করে, প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ শেষে অত্যাধুনিক এ ফ্যাক্টরিটি উৎপাদনে যাবার উপযোগী করে গড়ে তোলেন।

২০০৯ সালের প্রথম দিক থেকে নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য দেন-দরবার শুরু করেন তিনি। কারখানায় গ্যাস সংযোগের মূল্যবান নতুন সব যন্ত্রপাতি আমদানি, পাইপলাইন নির্মাণ এবং তৎকালীন বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লি. (বর্তমানে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি লি.) এর চাওয়া অর্ধকোটি টাকার মতো ডিমান্ড নোটের টাকা পরিশোধসহ সব প্রাক-শর্তাধি পূরণ করে নতুন গ্যাস সংযোগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ এবং যেদিন বাখরাবাদ গ্যাস কর্তপক্ষ সে কারখানায় গ্যাস সংযোগ দেয়ার ওয়াদা দিয়েছিলেন সেদিনই তাদের ভাষায় নেমে আসে ‘গজব’।

চূড়ান্ত মুহূর্তে বাখরাবাদ কর্তৃপক্ষ সরকারের উপরের নির্দেশের বরাত দিয়ে সাফ জানিয়ে দেয়, না নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে না। এই উদ্যোক্তার মাথায় পড়ে বজ্রাঘাত। এত কোটি টাকার বিনিয়োগ কি তাহলে পানিতে গেল? নিজস্ব তহবিল না হয় আটকে গেল কিন্তু কোটি কোটি টাকার বিশাল পরিমাণের ব্যাংক ঋণের কি দশা হবে? আসল ও সুদের কিস্তি পরিশোধ কিভাবে সম্ভব হবে?

সে থেকে নতুন গ্যাস সংযোগ পেতে তার শুরু হলো অবিরাম দৌড়ঝাপ। সময়, অর্থ ব্যয় চরম হয়রানি, কর্তাব্যক্তিদের চোখ রাঙানি আর দুর্ব্যবহার মিলে শুরু হয় পায়ের জুতার তলা ক্ষয় আর মাথার ঘাম পায়ে গড়িয়ে পড়ার মতো এ অফিস থেকে সে অফিসে ধর্না দেয়ার কাজ। একদিকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চাপ অন্যদিকে মূল্যবান মেশিনারিজের লাইফ ক্ষয় হয়ে উৎপাদন অক্ষম হবার ঝুঁকিতে এ উদ্যোক্তার হতাশা ও অসহায়ত্ব চরমে ওঠে। সরকারের প্রভাবশালী একজন মন্ত্রী তার হতাশা ও অসহায়ত্ব দেখে সংশ্লিস্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের সরাসরি অনুরোধ থেকে নিজে ডিও লেটার দেয়ার মতো অকৃত্রিম সহযেগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এফবিসিসিআই, চট্টগ্রাম চেম্বার, বিকেএমইএসহ সব ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে সে ফ্যাক্টরিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেয়ার পক্ষে লিখিত অনুরোধপত্র ইস্যু করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সাড়ে তিন বছর পরও যেখান থেকে যাত্রা শুরু করা হয়েছিল সেখানেই রয়ে গেছে পরিস্থিতি। অত্যাধুনিক কারখানাটি প্রায় পরিত্যক্ত ঘোষিত হতে আর বেশি বাকি নেই। তার পক্ষে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরে দেয়া আবেদন-নিবেদনের ভলিউম একত্র করা হলে একটা বড় গবেষণা রিপোর্টের আকার ধারণ করবে।

চট্টগ্রামের নেতৃস্থানীয় বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপ নতুন গ্যাস সংযোগের অভাবে তাদের নতুন স্থাপিত কিংবা বিদ্যমান কারখানার সম্প্রসারিত অংশের উৎপাদন শুরু করতে পারছে না। গ্যাস সংযোগের অভাবে বড়, মাঝারী আর ক্ষুদ্র নতুন শিল্প কারখানা মিলে শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলেই শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ আটকে আছে। সারা দেশে এর পরিমাণ হিসাব করলে কয়েক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অবশ্য বিশ্বাস করার মতো খবর হচ্ছে যাদের ‘জ্যাক’ আর ক্ষমতা কেন্দ্রে প্রভাব-প্রতাপ আছে, আছে মোটা অংকের টাকা ঢেলে নিষেধাজ্ঞা থোড়াই কেয়ার করে গোপনে গ্যাস সংযোগ পাবার যোগ্যতা তাদের অনেকে ইতিমধ্যে গ্যাস সংযোগ পেয়ে গেছেন। 

আলাপকালে ভুক্তভোগী কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে নতুন সংযোগ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তটি একটা সময় বেঁধে দিয়ে কার্যকর করা দরকার ছিল। হঠাৎ করে নতুন সংযোগ বন্ধ করার কারণে গ্যাস সরবরাহ পাবার আশায় যারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তারা নতুন শিল্প স্থাপনে সময়ের বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতেন। ডিমান্ড নোট ইস্যু করে যে সব উদ্যোক্তাদের গ্যাস সংযোগ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে অথবা সরকারের সব শর্ত পূরণ করে, বন্ধের আদেশ জারির আগে থেকে প্রক্রিয়া শুরু করে চূড়ান্তভাবে পাবার পর্যায়ে অপেক্ষমাণ থেকে যারা গ্যাস পাবার নৈতিক অধিকার অর্জন করেছেন অন্ততঃ তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া যেতো।

তারা বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসের শতভাগ মালিকানা জনগণের। এটা ভর্তুকি দিয়ে আমদানি করা জ্বালানি নয়। কোনো ব্যক্তি কিংবা গুটিকয় ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভট ধারনা থেকে নয়, ন্যায়বিচার ও ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে এ সম্পদের বন্টন হওয়া উচিত। কিন্তু জনগণের প্রতি জবাবদিহি করার কোনো প্রয়োজন বোধ করেন না-এ সরকারের  এমন কতিপয় ব্যক্তির লোভ আর ক্ষোভানলে পড়ে ন্যায্য হক বঞ্চিত শত শত শিল্প উদ্যোক্তা অর্থনৈতিকভাবে নিঃশেষ হতে বসেছেন।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে কোনো পূর্ণমন্ত্রী নেই। এ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন। অনেকে বলেন, তিনি সে মন্ত্রণালয়ে বসে আছেন নামকাওয়াস্তে। মূলত একজন ঠুটো জগন্নাথ। প্রধানমন্ত্রীকে উপদেশ দিতে, এ মন্ত্রণালয় চালাতে সহযোগিতা দিতে মওজুদ আছেন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের সদরে-অন্দরে একসময়কার আলোচিত আমলা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

ক্ষমতাকেন্দ্রের ঘনিষ্ঠ লোকজনের পাকা খবর হচ্ছে এ উপদেষ্টাই মূলত গ্যাস, জ্বালানি আর বিদ্যুৎ খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। এখাতের যত সুনাম-দুর্ণাম তার পুরোটার ক্রেডিট আর কাউকে শেয়ার দেয়ার কোনো সুযোগই তিনি রাখেননি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা আর ইচ্ছায় তিনি দেশের এ সময়কার সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ এ খাত হাতের তালুতে নিয়ে যা ইচ্ছা খেলছেন। ওয়াকেবহাল মহলের ধারণা, এ সরকারের আমলে যে সবখাতে ও মন্ত্রণালয়ে দেদারসে দুর্নীতির মচ্ছব চলছে তাতে বিদুৎ ও জ্বালানি খাতের ধারে কাছেও অন্য খাত ঘেষতে পারবে না। তাহলে বিগত জোট সরকারের আমলে দুর্নীতি ও অনিয়মের বেড়াজালে থমকে যাওয়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ব্যাপারে এ সরকার উচ্চকণ্ঠে কথা বলার সব নৈতিক অধিবারই কি হারাননি ?

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্বস্ত সূত্রের খবর হচ্ছে, বিগত তিন বছর ধরে সংযোগ বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও গোপনে ও নানা কৌশলে নতুন সংযোগ থেমে নেই। নতুন সংযোগ বন্ধ রাখা অবস্থায় আবাসিক খাতে দৈনিক গ্যাসের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি ঘনফুট। বন্ধ রাখার আগে আবাসিক খাতে দৈনিক গ্যাসের মোট ব্যবহার ছিল ২১.৫ কোটি ঘনফুট আর চলতি বছরের আগস্টে এসে তা দাঁড়িয়েছে দৈনিক ২৭ কোটি ঘনফুট। এ হিসাব পেট্রোবাংলার। সরকার এটা জানে। তাহলে নতুন সংযোগ বন্ধ থাকা অবস্থায় গ্যাসের এ ব্যবহার বাড়লো কিভাবে? খবর হচ্ছে, সরকারের কর্তাব্যক্তি থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট আমলা, কর্মচারী আর সরকারি দলের এক শ্রেণীর নেতারা এ নতুন গ্যাস সংযোগ প্রদান নিয়ে ‘স্ব স্ব ভাগ্য সুপ্রসন্নের ধনতরীর’ সন্ধান পেয়ে গেছেন। আর এ কারণেই বৈধ ও ন্যায়ানুগ পথে জনগণের গ্যাস পাবার সব দরজা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে।

পর্যাপ্ত গ্যাস উৎপাদনের পরও এভাবে যদি গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হয় অভ্যন্তরীণ ও দেশীয় বিনিয়োগ বাড়বে কিভাবে? কিভাবে হবে কর্মসংস্থান? নির্বাচন তো বেশি দেরি নেই। শেষ সময়ে হলেও জনগণের সহানুভূতি ও সমর্থনের দিকে কি একটুও নজর দেয়ার দরকার নেই? আর কারো সেদিকে খেয়াল থাকুক বা না থাকুক, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী কি জনগণের ভোগান্তি লাঘব ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল করে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার দিকে নজর দিতে পারেন না? এ প্রশ্ন সম্ভবত সব ভুক্তভোগীর আর সাধারণভাবে আমজনতার। 

মোহাম্মদ শাহনওয়াজ: সাংবাদিক।

ইমেইল: shahnowaz2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.