জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস-সমস্যার আবর্তে থেকে সম্ভাবনার পথে by মো. জিয়াউল হক শেখ

২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে পাসকৃত একটি আইনবলে ওই বছরের ২০ অক্টোবর থেকে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। যাত্রাকাল থেকেই অন্যান্য নতুন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার সমস্যা নিয়ে শুরু হয় এর পথচলা।


কারণ কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া, ত্রুটিযুক্ত একটি আইন দ্বারা শুধু পূর্বপ্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য বিগত সরকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত একটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে। রাতারাতি কলেজের শিক্ষকরা যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যান, তেমনি কলেজের শিক্ষার্থীরা হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। মাত্র ১১ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত এ প্রতিষ্ঠানটির একটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ব্যবস্থা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি হলের প্রায় সবক'টি হল অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে থাকা এবং আইনি জটিলতার কারণে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসনের কোনো সুযোগ এখন পর্যন্ত নেই। পর্যাপ্ত বই ও আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন গবেষণা উপযোগী কোনো কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি গড়ে তোলা এখনও সম্ভব হয়নি। এমনকি বিভাগীয় পর্যায়ে সেমিনার লাইব্রেরিগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সক্রিয় করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অধিকাংশ বিভাগে তা চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির একমাত্র ক্যান্টিনটি বর্তমানে সচল থাকলেও যদিও তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল, শিক্ষকদের জন্য আলাদা কোনো ক্যাফেটেরিয়া নেই। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থাও অপ্রতুল। এভাবে বহুমুখী সমস্যার আবর্তে থেকে পথচলা অব্যাহত রেখেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এত সব সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মধ্যেও নেওয়া হয়েছে অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মানসম্মত একটি নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে দলীয় বিবেচনায় নয়; বরং প্রকৃত মেধাবী, বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রগতিশীল উন্নত চিন্তার অধিকারীরা যেন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, সে জন্য শিক্ষাজীবনের ফলকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের বিধান রয়েছে। যদিও শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ ও পদোন্নতির যে নিয়ম-কানুন প্রবর্তিত হয়েছে, তা অল্প কিছু শিক্ষকের স্বার্থের কারণে বারবার পরিবর্তন করা হচ্ছে। এমনকি নিয়ম-কানুনগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিবিশেষে পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে শুধু দলীয় বিবেচনা নয়, কিছু শিক্ষকের স্বার্থ ও মতামতকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যাহোক, দু'একটি বিতর্ক বাদ দিলে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এ পদ্ধতি দেশে-বিদেশের নানা মহলের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইতিমধ্যে এ পদ্ধতিকে মডেল হিসেবে বিবেচনা করে তা অনুসরণ করার কথা ভাবছে। মেধাবী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে লক্ষাধিক শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে বিভিন্ন অনুষদ মিলে প্রতি বছর মাত্র চার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হচ্ছে। এ মেধাবী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই গ্রামের গরিব, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। প্রতিটি বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিকে যুগোপযোগী করে স্ব-স্ব বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় বই ক্রয় ও সংগ্রহ করে গবেষণাধর্মী পড়ালেখার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে ছাত্র আন্দোলনের মুখে 'বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পৌনঃপুনিক ব্যয় জোগানে সরকার কর্তৃক প্রদেয় অর্থ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে এবং পঞ্চম বছর থেকে উক্ত ব্যয়ের শতভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় ও উৎস থেকে বহন করা হবে'_ এ সংক্রান্ত ২৭/৪ ধারা বাতিল করা হয় এবং এ সংক্রান্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন (সংশোধিত)-২০১২ জাতীয় সংসদে পাস হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পূর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন সমস্যা সমাধানে ইতিমধ্যে গত ৩ সেপ্টেম্বর ২০১১ সরকারের পক্ষ থেকে ড. হাবিবুর রহমান হলকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বাণী ভবনের অর্ধেকটা আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের দখলে রয়েছে। কিন্তু সক্রিয় উদ্যোগের মাধ্যমে বাকি হলগুলো উদ্ধার করে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন চাহিদা পূরণ করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উদ্যোগের ঘাটতি আছে।
পরিবহনের ক্ষেত্রে যে ধরনের সুবিধা বিদ্যমান, তা যথেষ্ট নয়। অন্তত দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার পর্যন্ত প্রতি ঘণ্টায় শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের জন্য পরিবহন সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারলে সমস্যা কিছুটা লাঘব হতো। এ ছাড়া ভবিষ্যতে দীর্ঘ মেয়াদে এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এখন থেকেই নেওয়া প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের সংস্কৃতি ও ক্রীড়া চর্চার জন্য ব্যয় বরাদ্দের পাশাপাশি বিভাগ ও অনুষদগুলোর এ ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিত। শিক্ষকদের গবেষণা কর্মকে আরও উৎসাহিত করতে প্রয়োজনীয় আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিসহ সেমিনার পাঠাগারগুলোকে বই ও জার্নাল দিয়ে আরও সমৃদ্ধ করা প্রয়োজন। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ ও পদোন্নতির যে নিয়ম-কানুন প্রবর্তিত হয়েছে, তা অল্প কিছু শিক্ষকের স্বার্থের কারণে বারবার পরিবর্তন নয়, বরং সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এ সংক্রান্ত নিয়মনীতির সমন্বয় করে একটি আধুনিক, যুগোপযোগী ও টেকসহ নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।
৭ অক্টোবর, ২০১২ তারিখে শিক্ষক সমিতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশদ্বারে অবস্থিত বাংলাদেশ ব্যাংককে সরিয়ে নেওয়া, দ্রুত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের আবাসন সমস্যা সমাধানসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা, ঝিলমিল প্রকল্পে কিছু জায়গা বরাদ্দ দিয়ে সেখানে শিক্ষকদের আবাসনের জন্য দুটি টাওয়ার ভবন নির্মাণ এবং শিক্ষার্থীদের হলগুলো উদ্ধার ও প্রয়োজনীয় জমি বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করি, শিক্ষক সমিতি ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সক্রিয় উদ্যোগ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ আশ্বাস বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়াও জরুরি। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখনও কোনো হল নেই, তাই অন্তত বিভাগ ও অনুষদভিত্তিক সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার আয়োজন, বিভিন্ন ধরনের জার্নাল ও বইয়ের সংগ্রহ নিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ লাইব্রেরি পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল লেখা নিয়ে জার্নাল প্রকাশ, সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের নানা ধরনের অধিকার আদায়ের মাধ্যম হিসেবে জ.বি. ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এতে একদিকে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত পড়ালেখার পরিবেশ পেয়ে জ্ঞান সাধনায় ব্রতী হবে, সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ পাবে; অন্যদিকে এর মাধ্যমে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবাই একযোগে প্রতিবাদ করবে এবং নিজেরা সমাজ ও দেশের প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা নিয়ে বেড়ে উঠবে। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় বর্তমানে এ বিষয়গুলো ছাত্রছাত্রীদের কাছে কল্পনাপ্রসূত হিসেবে পরিণত। ফলে ছাত্রছাত্রীদের আকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতার মধ্যে এক বড় ধরনের অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হচ্ছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সীমিত সুযোগ ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব সমুজ্জ্বল করার মাধ্যমে তাদের প্রতি করা বৈষম্য ও বঞ্চনাকে ছাপিয়ে অর্জনকেই বড় করে তুলবে_ এটিই আমাদের প্রত্যাশা।

মো. জিয়াউল হক শেখ :শিক্ষক
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

No comments

Powered by Blogger.