মানুষের মুখ- শিল্পের জন্য ভালোবাসা by মাহবুবুর রহমান

শৈশব থেকেই আঁকাজোকার প্রতি তাঁর ছিল অন্য রকম আগ্রহ। তাই এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন রাজশাহী আর্ট কলেজে। সেখান থেকে পাস করে একই বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন ভারতের শান্তিনিকেতন থেকে।


বাঁধা-ধরা নিয়মের চাকরির সঙ্গে না জড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজেই হয়ে ওঠেন একজন পেশাদার চিত্রশিল্পী। এখন তাঁর সৃজনশীল চিত্রকর্মের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
বছরের নির্দিষ্ট সময়, বিশেষ করে দুর্গাপূজার সময় ঘনিয়ে এলে তিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না। ছুটে যান একেক বছর একেক জায়গায় মা দুর্গাসহ নানা দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করতে।
বলছি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া গ্রামের বিশ্বজিৎ পালের কথা। বাবা বিনয় কৃষ্ণ পাল আর মা বনলতা পাল ছিলেন পেশাদার মৃৎশিল্পী। পেশার স্বীকৃতি হিসেবে দুজনই পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। দুই ভাই ও তিন বোনের পরিবারে বিশ্বজিৎ চতুর্থ। বাবা পরলোকগমন করেছেন ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। এর আট মাস পর মারা যান বড় ভাই বিষ্ণুপদ পাল। তিনি ছিলেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনীর কলেজ রোডের ত্রিশূল পূজামণ্ডপে মূর্তি তৈরির সময় কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্বজিৎ পাল তাঁর চিত্রশিল্পী হয়ে ওঠার কাহিনি বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এই শিল্পের প্রতি ঝুঁকে পড়ার প্রধান কারণ মা-বাবা। একেবারে শৈশব থেকে শিল্পকর্ম দেখেই এর প্রতি অন্য রকম এক আগ্রহ জন্মে।
প্রাথমিক ও হাইস্কুলে পড়া অবস্থায় প্রায়ই নানা রকম আঁকাজোকা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। তা দেখে বাবা ও বড়দা (বড় ভাই) উৎসাহ দিতেন। দুর্গাপূজার সময় বাবা বিভিন্ন জায়গায় মূর্তি তৈরি করতে যেতেন। তাঁর সঙ্গে মূর্তি তৈরি দেখতে প্রায়ই বায়না ধরতেন। বাবা মানতে না পারলেও প্রায়ই সঙ্গে নিতেন মূর্তি তৈরি দেখাতে।
বাবার সঙ্গে মাঝেমধ্যে মূর্তি তৈরিতেও অংশ নিতেন বিশ্বজিৎ। মূর্তি তৈরির হাতেখড়ি তাঁর মূলত সেখান থেকেই। এসএসসি পাসের পর মা-বাবা ও বড়দার উৎসাহে বিএফএ কোর্সে ভর্তি হন রাজশাহী আর্ট কলেজে। সেখান থেকে পাস করার পর এমএফএ ডিগ্রি নেন শান্তিনিকেতন থেকে ২০০৩ সালে। পাস করার পর চাকরি খোঁজার পাশাপাশি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে টেরাকোটা (পোড়ামাটির কাজ), ভাস্কর্য তৈরিসহ বিভিন্ন চিত্রকর্মের কাজ করেন।
বাবা ও বড়দা মারা যাওয়ার পর পুরো সংসারের দায়িত্ব নিতে হয় নিজেকে। তখন মনে একটাই চিন্তা কাজ করত; যেভাবেই হোক চিত্রকর্মের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় অর্থ উপার্জন করতে হবে। এ জন্য অনেক সময় ১০ টাকার কাজ দুই টাকা নিয়েও করতে হয়েছে। নানাজনের কাছ থেকে ঠকতে ঠকতে মনের মধ্যে নেমে আসে চরম হতাশা।
এমন সময় রাজশাহীর এক বড় ভাই কারুশিল্পী তিতাসের মাধ্যমে পরিচয় হয় শিল্পী গৌতম চক্রবর্তীর সঙ্গে। তিনি তাঁর গ্যালারির জন্য একটি টেরাকোটার কাজ দেন। ওই কাজের পর রংপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিবেশ নিয়ে একটি ম্যুরাল তৈরি করেন গৌতম চক্রবর্তীর সহকারী হিসেবে।
এর পর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি শিল্পী বিশ্বজিৎ পালকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে টেরাকোটার কাজ ও ভাস্কর্য তৈরি করেন তিনি। যার মধ্যে চট্টগ্রামের ঘোষালডাঙ্গা ও বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে শ্মশান কালীমন্দিরে টেরাকোটার কাজ এবং রাজবাড়ীতে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ উল্লেখযোগ্য। এ সবকিছুতে পেশাদারি থাকলেও দুর্গাপূজার জন্য মূর্তি তৈরি করেন শিশুকাল থেকে মনের গভীরে জন্ম নেওয়া অন্য রকম অনুভূতি থেকে।
২০০৮ সালে বিয়ে করে সংসারজীবন শুরু করেন বিশ্বজিৎ। বর্তমানে মা বনলতা পাল, স্ত্রী আলপনা পাল ও একমাত্র মেয়ে অবন্তী পালকে নিয়েই তাঁর পরিবার। তাঁরা গ্রামের বাড়িতেই থাকেন। বিশ্বজিৎ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়ান শিল্পকর্ম নিয়ে। এবার চৌমুহনীতে মূর্তি তৈরির যে কাজটি তিনি করছেন, সেটি হচ্ছে ইংরেজি চলচ্চিত্র অ্যাভাটার-এর আদলে। এর মাধ্যমে দর্শনার্থীদের পরিবেশ, বন ও বন্য প্রাণী রক্ষার বিষয়ে বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, যা যেকোনো দর্শনার্থীকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিশ্বজিৎ পাল।
মাহবুবুর রহমান

No comments

Powered by Blogger.