বৌদ্ধপল্লীতে হামলার রিপোর্ট-নিরাময়ে সম্মিলিত প্রয়াস চাই

কক্সবাজারের রামু উপজেলার বৌদ্ধপল্লী ও মন্দিরে হামলা এবং অগি্নসংযোগের ঘটনায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছে সরকারি তদন্ত কমিটি।


তবে এ ঘটনায় কে বা কারা পেছনে থেকে কলকাঠি নেড়েছে, দেশি-বিদেশি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এতে জড়িত ছিল কি-না, বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জমা দেওয়া সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। শুক্রবার বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এ সম্পর্কিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, তদন্ত প্রতিবেদনটিতে স্থানীয় প্রশাসনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাব এবং বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের প্রশাসনের সমন্বয়হীনতার কারণে হামলা ও অগি্নসংযোগের ঘটনা প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া যায়নি। সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমনকি ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও এ ঘৃণ্য কর্মে নিজেদের জড়িয়েছেন বা নিষ্ক্রিয় থেকে নির্বিঘ্নে অপরাধ সংঘটিত হতে দিয়েছেন। নির্বাচিত প্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, স্থানীয় সামাজিক গণ্যমান্য ব্যক্তি_ কেউই বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে রক্ষা করার জন্য তখন এগিয়ে আসেননি। বরং সবাই কোনো না কোনোভাবে ওই জঘন্য ঘটনায় অংশ নিয়েছেন, না হয় উদাসীন থেকে পরোক্ষে ইন্ধন জুগিয়েছেন। তাই রামুর ঘটনাকে দেশের আর দশটি সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার সঙ্গে মেলানো যায় না। বরং রামুর ঘটনার অভিমুখ আমাদের সমাজের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ক্ষতিকর বিভাজনরেখা অতিক্রমের ইঙ্গিত দেয়। এটা বাঙালি সংস্কৃতির অসাম্প্রদায়িক চেতনারও পরিপন্থী। সুতরাং রামুর বৌদ্ধপল্লীর ঘটনাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকার ও বিরোধী দলের পরস্পরের বিরুদ্ধে দোষ দিয়ে বা সবাই মিলে প্রশাসনের ঘাড়ে এর দায়ভার চাপিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে লাভ নেই। চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. নুরুল ইসলামকে প্রধান করে গঠিত চার সদস্যের তদন্ত কমিটি তাদের ৬৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন প্রস্তুত করার আগে সরেজমিন তদন্ত ও ১২২ ব্যক্তির বক্তব্য গ্রহণ করে। কারা কীভাবে ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হলো, প্রশাসনের ভূমিকা কী ছিল_ ইত্যাকার বিষয়গুলো চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঘটনার স্বরূপ উন্মোচনের একটা কষ্টসাধ্য চেষ্টা তদন্ত প্রতিবেদনে রয়েছে। আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক-প্রশাসনিক পর্যায়ে কীভাবে রক্ষণশীলতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে, তা উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে রামুর ঘটনা দৃষ্টি খুলে দেওয়ার কাজটি করতে পারে। তাই সরকার, বিরোধী দল, প্রশাসন এবং সামাজিক ব্যক্তিত্ব ও শক্তিগুলোকে সম্মিলিতভাবে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে সংঘটিত হামলা ও অগি্নসংযোগে সৃষ্ট ক্ষত নিরাময়ের জন্য প্রচেষ্টা নিতে হবে। আমাদের সমাজকে অধোগতি থেকে বের করে আনার জন্য সবাইকে সুদীর্ঘ সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। সরকারি তদন্ত কমিটি রিপোর্টটিতে দেশি-বিদেশি কোনো স্বার্থান্বেষী মহল এতে জড়িত কি-না তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে পারেনি। এখানেই রিপোর্টটির অপূর্ণতা। তবে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও অগি্নসংযোগের আগের দিন নাইক্ষ্যংছড়ির উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসায় গোপন বৈঠক, বৈঠকে যোগদানকারী অন্তত একজনকে উত্তেজনা ছড়ানোর দায়ে আটক করা ও স্বীকারোক্তি আদায় এবং ওই চেয়ারম্যানের জুলাই মাসে ১৫ দিনের জন্য দুবাই সফর ও তার সঙ্গে রোহিঙ্গা সংগঠনের ঘনিষ্ঠ সংযোগ থাকার বিষয়টি নিয়ে আরও তদন্তের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য করে তুলেছে। হয়তো এই যোগসূত্রের মধ্যেই লুকিয়ে আছে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের সংযোগ। আমরা সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্ট জনসমক্ষে প্রকাশ এবং এই ঘৃণ্য ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে ইন্ধনদাতাদেরও খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানাই। পাশাপাশি নতুন করে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ তৈরির কাজটি সবাইকে সম্মিলিতভাবেই করতে হবে। আসুন, আমরা সে লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে এগোই। তদন্ত রিপোর্ট আমাদের সে তাগিদই দেয়।
 

No comments

Powered by Blogger.