পতনের এক বছর- গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া কোন পথে?

কয়েক মাসের সশস্ত্র বিদ্রোহের পর লিবিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফি ২০১১ সালের ২০ অক্টোবর ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন। গাদ্দাফিবিরোধীদের দাবি, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ক্রসফায়ারে। তবে মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে দেখা গেছে, দৃশ্যত গাদ্দাফিকে জীবিত আটকের পর হত্যা করা হয়।


লিবিয়ায় বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশটিতে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারবদ্ধ, এ কথা ঠিক। কিন্তু ৪২ বছরের শাসনে লিবিয়ায় যে ইসলামপন্থীরা কোণঠাসা অবস্থায় ছিল, তারা এখন অবাধে কার্যক্রম চালাচ্ছে। কিছুদিন আগে বেনগাজিতে সন্ত্রাসী হামলায় দেশটিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহত হয়েছেন। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়া এখন কোন পথে যাচ্ছে?
সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং স্থানীয় অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতি বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নজর নেই। সেই সুযোগে ইসলামপন্থী দাতব্য সংগঠনগুলো খাবার ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এসব সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সালাফি মুসলিমের মতো চরমপন্থী গোষ্ঠী। এরা মুসলিম-অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে সক্রিয় রয়েছে। মিসরের সাম্প্রতিক নির্বাচনে সালাফি মুসলিম বেশ ভালো ফল অর্জন করেছে। তৃণমূল পর্যায়ে তাদের প্রতি সমর্থনই এ সাফল্যের কারণ। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ইসলামপন্থীরা এভাবেই সংগঠিত হচ্ছে।
গাদ্দাফির আমলে লিবিয়াকে ইসলামি প্রভাবমুক্ত রাখতে সরকারি বাহিনী সব সময় তৎপর ছিল। তবে স্বৈরশাসকের পতনের পর বর্তমান লিবিয়ায় ইসলামপন্থীরা দ্রুত তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। তবে ইসলামপন্থীদের মধ্যেও রয়েছে বিভক্তি। লিবিয়ায় মুসলিম জনসাধারণ এমনিতে ধর্মপ্রাণ। সমাজে ধর্মের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন। কিন্তু ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো সম্পর্কে তাঁরা সন্দিহান। এসব দলের উত্থানে মানুষের স্বাধীনতা খর্ব হবে, এমনটাই আশঙ্কা তাদের। তাই ইসলামপন্থীরা এখন ধীরে এবং সতর্কভাবে অগ্রসর হওয়ার কৌশল বেছে নিয়েছে।
গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় এসব ঘটনা নিয়ে দেশের ভেতরে-বাইরে রয়েছে নানা বিতর্ক। গাদ্দাফির মৃত্যুর ইতিহাস কীভাবে লেখা হবে, সেটাও একটা প্রশ্ন। তবে বড় বিষয় হচ্ছে, ২০ অক্টোবরের সেই ঘটনা আজও লিবিয়ায় গাদ্দাফির সমর্থক ও সেই সময়ের লড়াইয়ে জয়ী মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের আগুনে ঘি ঢালছে।
গাদ্দাফি নিহত হওয়ার দিন লিবিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিব্রিল বলেছিলেন, তাঁর মৃত্যু ছিল একটা দুর্ঘটনা। তাঁকে জীবিত ধরে আনার ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ অভিপ্রায় ছিল বিদ্রোহীদের। তবে সেখানে ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটে। আর যখন গাদ্দাফিকে একটি ট্রাকে তোলা হচ্ছিল, তখনই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর কাছে একটি ছোট পিস্তল ছিল। কিন্তু তিনি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেননি।
এক বছর পর আজ সেই বক্তব্য সঠিক নয় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। গত বুধবার মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বস্তুত গাদ্দাফিকে আটক করার পর তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। এটা সত্যি হলে তা আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী সুস্পষ্টভাবেই যুদ্ধাপরাধ। মানবাধিকার সংগঠনটির একজন পরিচালক পিটার বৌকার্টে বলেছেন, গাদ্দাফি ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ যে দাবি করে আসছে, তাঁদের অনুসন্ধানে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
মানবাধিকার সংগঠনটির মতে, বিদ্রোহীরা গাদ্দাফিকে জীবিত ধরে এনে বিচারের মুখোমুখি করার পক্ষপাতী ছিল কি না, সেটাই প্রশ্ন। কারণ অধিকাংশের যুক্তি ছিল, গাদ্দাফি বিচার দশকের পর দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের পর দেশ গঠনের কাজে তাদের সক্ষমতার বিষয়টিকে জটিল করে তুলতে পারে। তাই গাদ্দাফির মৃত্যুর খবরেই সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। বিদ্রোহীদের জাতীয় অন্তর্বর্তী পরিষদের (এনটিসি) লড়াই চলাকালীন মুখপাত্র জালাল আল-গালালের মতে, তাঁদের সামনের দিকে এগোনোর দরকার ছিল। আর গাদ্দাফির মৃত্যু বিষয়টিকে সহজ করে দিয়েছিল। টাইম, এনপিআর ডট ওআরজি।

No comments

Powered by Blogger.