বিতর্কিত স্টিং অপারেশনের শিকার নাফিস!

বাংলাদেশি তরুণ কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসকে গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই যে ধরনের অভিযানে গ্রেপ্তার করেছে এর নাম স্টিং অপারেশন।
এটি মূলত একটি কৌশল, যার মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে, অপরাধ করতে সহযোগিতা দিয়ে অপকর্মের ঠিক আগ মুহূর্তে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরে ফেলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশে এ ধরনের অভিযান প্রচলিত থাকলেও এর নৈতিক ও আইনি দিক নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ ধরনের অভিযানের সমালোচনা হচ্ছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। সুইডেন, নেদারল্যান্ডসের মতো কয়েকটি দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্টিং অপারেশন নিষিদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের সুশীল সমাজের অনেক সংগঠনই স্টিং অপারেশনের সমালোচনা করে আসছে। এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নসহ সুশীল সমাজের কয়েকটি সংগঠনের আবেদন গত আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত খারিজ করে দেন। তবে আদালতের বিচারক করম্যাক কার্নি তাঁর ৩৬ পৃষ্ঠার রায়ের একটি অংশে বলেছেন, তিনি জাতীয় নিরাপত্তাকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ঊর্ধ্বে স্থান দিতে বাধ্য হয়েছেন।

ফ্রান্স টোয়েন্টিফোরডটকমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমন অনেক মামলা আছে, যেখানে বিচারকরা স্বীকার করেছেন, এফবিআইয়ের কৌশল প্রশ্নবিদ্ধ। সত্তরের দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত এফবিআইয়ের বহুল আলোচিত স্টিং অপারেশনগুলোর অন্যতম ছিল `আবদুল স্ক্যাম` বা সংক্ষেপে `আবস্ক্যাম`। চুরি হওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারে এ অপারেশন শুরু হলে তা শেষ পর্যন্ত দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে পরিণত হয়েছিল। ওই তদন্ত অভিযানের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের একজন সিনেটর, প্রতিনিধি পরিষদের ( হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ) পাঁচ সদস্য, নিউ জার্সি স্টেট সিনেটের এক সদস্য, ফিলাডেলফিয়া সিটি কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য এবং অভিবাসন বিভাগের একজন পরিদর্শক দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।

ওই অভিযানের শুরুতে ১৯৭৮ সালে এফবিআইয়ের কর্মীরা `আবদুল এন্টারপ্রাইজ লি.` নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলে। এফবিআই-কর্মীদেরই একজন করিম আবদুল রহমান নামে আরব শেখ সেজে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও টেপের মাধ্যমে যোগাযোগ এবং অর্থের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের ওই ফাঁদে পা দিয়ে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন অনেকেই।
গত বুধবার নাফিস গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিউ ইয়র্ক পুলিশ বলেছে, তিনি আসলে এফবিআইয়ের পাতা ফাঁদে পা দেন। তাঁর ওপর নজর রাখা হচ্ছিল গত জুলাই মাস থেকেই। হামলা চালানোর পরিকল্পনায় ব্যবহৃত ভ্যানটি চালিয়ে আসার সময় যে ব্যক্তিটি তাঁর পাশে ছিলেন, তিনি আসলে এফবিআইয়ের একজন কর্মকর্তা। নাফিস ওই কর্মকর্তাকে চিনতে পারেননি।

এফবিআইয়ের কৌঁসুলিরাও বলেছেন, নাফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন এমনই একজন পরে এফবিআইয়ের সোর্সের ভূমিকা নিয়ে তথ্য সরবরাহ করেন।

এরপর থেকেই তাঁকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয় এবং ছদ্ম পরিচয়ে এফবিআইয়ের একজন এজেন্ট বোমা বিক্রির নাম করে তাঁর কাছে একেকটি ৫০ পাউন্ড ওজনের ২০টি ব্যাগ বিক্রি করে, যেগুলোতে আসলে কোনো বিস্ফোরক ছিল না, ছিল বোমার মতো দেখতে কিছু বস্তু মাত্র। সেগুলোর সাহায্যে নিউ ইয়র্ক শহরের ফেডারেল রিজার্ভ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়।

এ ধরনের স্টিং অপারেশনের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান কী- গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তবে কূটনৈতিক ও অন্যান্য সূত্র জানিয়েছে, স্টিং অপারেশন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এটি অপরাধী ধরার কার্যকর কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হয়। এর মাধ্যমে মূলত অপরাধীর সঙ্গে প্রতারণা করা হয়।

জানা যায়, সাধারণত স্টিং অপারেশনে আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা বা তাঁদের সোর্সরা অপরাধী বা সম্ভাব্য অপরাধীর সহযোগী ভূমিকা গ্রহণ এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযোগিতা করেন। এর মাধ্যমে মূলত সম্ভাব্য অপরাধীর বিরুদ্ধে ফাঁদ পেতে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা হয়।  বাংলাদেশি তরুণ নাফিসের ক্ষেত্রে এমনটিই ঘটেছে।

স্টিং অপারেশনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তারা কখনো মাদক বা অস্ত্রের ক্রেতা সেজে মাদক ও অস্ত্র বিক্রেতাকে ফাঁদে ফেলেন। নৈতিকতা ইস্যুতে আলোচনা-সমালোচনা যা-ই থাকুক না কেন, অনেক দেশেই এটি বৈধ প্রক্রিয়া। তবে অপরাধ সংঘটনে কাউকে উদ্বুদ্ধ করার বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়া দেশে দেশে ভিন্ন।

`স্টিং` শব্দটি মূলত জনপ্রিয়তা পেয়েছে ১৯৭৩ সালের রবার্ট রেডফোর্ড ও পল নিউম্যানের `দ্য স্টিং` সিনেমা থেকে। ১৯৯৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রয়োগকারী তিনটি সংস্থা যৌথভাবে স্টিং অপারেশন চালিয়ে চুরি হওয়া চাঁদের প্রস্তর খণ্ড মিয়ামির একটি ভল্ট থেকে উদ্ধার করে। ওই স্টিং অপারেশনটির নাম ছিল `অপারেশন লুনার একলিপস`।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওমর ফারুক শুক্রবার জানান, স্টিং অপারেশন নৈতিক দিক দিয়ে সঠিক নয়। মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাগুলো সুপ্ত অবস্থায় থাকে। নৈতিক দিক দিয়ে না চাইলেও ফাঁদে পড়ে অনেক সময় মানুষ কৌতূহলবশত অপরাধ সংঘটনের পরিকল্পনা করে আনন্দ অনুভব করেন। স্টিং অপারেশনের ফাঁদে পড়া ব্যক্তিরা একেকটি ধাপ পার হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছান, তাঁদের আর পিছু ফেরার পথ থাকে না।

তিনি আরো বলেন, এফবিআই মূলত দৈহিক ফরেনসিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কাজ করে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের তদন্ত সংস্থাগুলো তদন্তের পাশাপাশি মানসিক দিকটিও দেখে। সংঘটিত অপরাধ মানসিক দিক দিয়ে অপরাধীর জন্য কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ, তাও বিবেচনা করা হয়। এফবিআই এটি করে না।

যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর প্রবলেম ওরিয়েন্টেড পুলিশিং (সিপিওপি) থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত স্টিং অপারেশন সম্পর্কিত গাইডে বলা হয়েছে, এ ধরনের অপারেশনের কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে না। দোষী সাব্যস্ত করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়ার আগ পর্যন্ত এ অভিযান চলতে থাকে। আর এ ধরনের তদন্ত অভিযানে গ্রেপ্তার ও দোষী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তির সংখ্যাও অনেক। সিপিওপির তথ্য মতে, একটি স্টিং অপারেশনে ৭০০ জনকে পর্যন্ত গ্রেপ্তার করার নজির আছে।

No comments

Powered by Blogger.