গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ-সরকারি পর্যায়ে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত by আরিফুর রহমান

শেষ পর্যন্ত সরকার টু সরকার (জি টু জি) প্রক্রিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থার অর্থায়ন কিংবা পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি) মাধ্যমে নির্মাণের পরিকল্পনায় অগ্রগতি না হওয়ায় সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।


প্রায় তিন বছর ধরে নানা প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখার পর কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পটি জি টু জি প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্ত গত ৮ অক্টোবর নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশ্বের যেকোনো দেশ এই প্রকল্পে বিনিয়োগ করতে পারবে। একাধিক দেশও একসঙ্গে অর্থায়ন করতে পারবে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত চীনের আগ্রহের বিষয়টিই বেশি লক্ষণীয়।
এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্র জানায়, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবশালী নেতা লি চ্যাংচুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল আজ শনিবার ঢাকা সফরে আসছেন। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে প্রতিনিধি দলের আলোচনা হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য লি চ্যাংচুন দলের প্রচার বিভাগের দায়িত্বে রয়েছেন। পার্টিতে ক্ষমতাবানদের মধ্যে পঞ্চম শীর্ষ ব্যক্তি হিসেবে তাঁকে ধরা হয়।
ইআরডি সূত্র জানায়, গত মাসে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত চীন সফরে গিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চীন সরকারকে অনুরোধ জানান। এমন অনুরোধেই চীনের উচ্চ পর্যায়ের এই নেতা বাংলাদেশ সফরে আসছেন বলে জানা গেছে।
নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সফরকারী লি চ্যাংচুনের সঙ্গে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হবে। এ ছাড়াও বিনিয়োগের জন্য বিভিন্ন দেশকে প্রস্তাব দেওয়া হবে।
সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়নের বিষয়ে চীনের নামই এখন পর্যন্ত বেশি আলোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত এরই মধ্যে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এ প্রকল্পে বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তবে সরকারকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাবনা দেওয়া হয়নি।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নাসির আরিফ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে জানান, গত ১৮ সেপ্টেম্বর অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত কমিটির সভায় জি টু জি মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে যেকোনো দেশ এ প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখালে তাদের সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিতে হবে। এ ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ প্রকাশ করলে তাদের অবশ্যই সরকারের মাধ্যমে আসতে হবে। একাধিক দেশ একসঙ্গে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে কয়েক বছর ধরে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া মৌখিকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে কেউ সরকারকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেয়নি।
সরকারের এক নীতিনির্ধারক কালের কণ্ঠকে জানান, তিন বছর ধরে অনেক আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে প্রাথমিক একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়েছে। তবে এখনো অনেক কাজ বাকি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সঙ্গে বিনিয়োগ বোর্ড, বাংলাদেশ রেলওয়ে, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ বিভাগ, শিল্প মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মতো প্রায় ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ জড়িত। এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে দ্রুত সমন্বয় করতে হবে। তাতে একটু সময় লাগবে জানিয়ে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের মেয়াদে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রকল্পের মূল কাজ শুরুর আগে প্রাথমিক কিছু কাজ শেষ করতে হবে। পানির স্রোত ঠেকাতে এবং স্থিতিশীল রাখতে প্রকল্প এলাকায় একটি ব্রেকওয়াল নির্মাণ করতে হবে। এ ছাড়া পাঁচটি জেটি নির্মাণে এক হাজার মিটার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে মহেশখালীতে কনটেইনার চলাচলের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথম পর্যায়ে আগামী ২০১৫ সাল নাগাদ এসব কাজ শেষ করতে হবে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে অর্থায়ন করতে সর্বপ্রথম ২০১০ সালের আগস্টে চীনকে অনুরোধ জানায় সরকার। সে সময় চীনের ভাইস প্রেসিডেন্টের ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগের এই প্রস্তাব দেওয়া হয়। সরকারের প্রস্তাবে চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইতিবাচক সাড়া দেন। একই বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে গিয়ে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে দেশটির নীতিনির্ধারকদের অনুরোধ জানান। ওই সময় চীনের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকেও প্রধানমন্ত্রীকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া হয়েছিল।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, ইআরডির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে এ প্রকল্পে অর্থায়নে অনুরোধ জানানো হলেও কেউ ইতিবাচক সাড়া দেয়নি। তবে বিভিন্ন দেশের বেশ কিছু নির্মাণ প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পে অর্থায়নে প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক মনে না হওয়ায় সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। আবার পিপিপির মাধ্যমেও প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার।
গভীর সমুদ্রবন্দর সেল সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত চীনের দুটি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তারা আনুষ্ঠানিক কোনো প্রস্তাব দেয়নি।
এর আগে ২০০৯ সালে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ করে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে জাপানের পরামর্শক দিয়ে এই সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, গভীর সমুদ্রবন্দর তিন ধাপে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ ২০১৫ সালের মধ্যে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ ২০৩৫ সালে শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর পুরো নির্মাণকাজ শেষ করা হবে ২০৫৫ সালে। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ৬৫ হাজার কোটি টাকা। তবে এ ব্যয় বেড়ে এক লাখ কোটি টাকা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

No comments

Powered by Blogger.