ভিন্নমত-কোনো প্রাইভেট ব্যাংকে এই ঘটনা ঘটলে কেমন হতো! by আবু আহমেদ

স্মরণকালের বৃহত্তম অর্থ লোপাটের ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক সোনালী ব্যাংক লিমিটেডে। এই নিয়ে সংবাদ মাধ্যম ও সিভিল সমাজ যতটা প্রতিবাদমুখর, লক্ষণীয় হলো সরকার ততটাই চুপ। ব্যাংকের অর্থ ডাকাতি হতে পারে দুই ধরনের।


এক. চোর-ডাকাত নামের কিছু লোক ব্যাংকের অফিস ভেঙে হাতুড়ি-বন্দুক দিয়ে সবার অগোচরে কয়েক কোটি টাকা নিয়ে যেতে পারে। এই ডাকাতি নিয়ে জনগণ তথা আমানতকারীরা মোটেই উদ্বিগ্ন নয়। এমন ডাকাতি বিশ্বের অন্য দেশেও ঘটে। দ্বিতীয় ধরনের ডাকাতি হলো কথিত আইনি প্রক্রিয়ায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কর্তৃক তাদের গ্রাহক নামের কিছু লোককে কথিত ব্যবসার নামে ঋণ মঞ্জুরির নামে বরাদ্দ দেওয়ার মাধ্যমে। এই ক্ষেত্রে দেখা যাবে গ্রাহকের না আছে ব্যবসা, না আছে ঋণের বিপরীতে বন্ধক রাখার মতো কোনো উপযুক্ত সম্পত্তি। কিন্তু তার পরও গ্রাহক শত শত কোটি টাকার ঋণ পেয়ে যায়। কেমন করে? যেভাবে হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংকের একই শাখা থেকে তিন হাজার কোটি টাকার ঋণ পেয়েছে। ঋণ পাওয়ার বা অর্থ তুলে নেওয়ার অনেক দিন পর বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্ঘাটন করল ওই ঋণ তো সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ঋণ দেওয়া হয়েছে সম্পূর্ণ ভুয়া ব্যবসার নামে। এটা কেমন করে হলো! পর্ষদ ও এমডি কি জানতেন না এই লোপাটের ব্যাপারে? সবই সবাই জানতেন। উচ্চ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ না জেনে এত বড় ঋণ শুধু ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ও ব্যাংকের অন্য ছোট কর্মচারীরা মঞ্জুরি দিয়েছেন, তা হতেই পারে না। এই যে স্মরণকালের বৃহত্তম ব্যাংক-ডাকাতি ঘটল ব্যাংকে কাগুজে নথিপত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে, এর জন্য দায়ী কে? সরকার যদি এত বড় পাবলিক আউট-ক্রাইর ক্ষেত্রেও চুপ করে থাকে, তাহলে পাবলিকের নিজের চুল নিজেরা ছেঁড়া ছাড়া উপায় নেই। নোট আর নথিপত্র উপস্থাপনের মাধ্যমে যে শত শত কোটি টাকার পাবলিক মানি লোপাট হতে পারে, সোনালী ব্যাংকের এই ঘটনা একটি উদাহরণ মাত্র। অন্য ব্যাংকেও এমন অনেক ঘটনা ঘটে চলেছে, তবে হয়তো অত বড় অঙ্কের নয়। ওসব নোট ও নথি পড়লে মনে হবে, ওই গ্রাহকের মতো ভালো গ্রাহক যেন আর নেই। তবে সেই সুন্দর উপস্থাপনের পেছনে যে স্বার্থটি কাজ করে সেটা হলো, ঋণ দেওয়ার নামে ব্যাংকের অর্থকে সমবেতভাবে লুট করা। প্রশ্ন হলো, ওই উপস্থাপিত নোটের ওপর কে সই করল? ওসব ঋণ প্রস্তাবনা কি পরিচালনা পর্ষদে উপস্থাপিত হয়েছিল? ব্যাংক ব্যবসায় আমানতকারী থেকে ঘুষ নেওয়া যায় না। কিন্তু ঋণ দেওয়ার নামে আমানতকারীর অর্থের ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ঘুষ নেওয়া যায় এবং কোনো ক্ষেত্রে ভাগও বসানো যায়। আর এই কাজটাই করে যাচ্ছে একশ্রেণীর ব্যাংকাররা। তারাও ব্যাংকার, তবে আমানতকারীর অর্থ লোপাটের জন্য ব্যাংকার। ব্যাংক ব্যবস্থা দেখাশোনা ও রেগুলেট করার জন্য রেগুলেটর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক আছে। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত চারটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে দ্বৈত রেগুলেশন বজায় আছে। অর্থ মন্ত্রণালয় চারটি ব্যাংককে দেখাশোনা করার জন্য একজন পূর্ণ সচিবের নেতৃত্বে পুরো একটি বিভাগ খুলে বসেছে। ২০০৭ সালে সোনালী, জনতা ও অগ্রণী ব্যাংককে পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকিং কম্পানির কাঠামোয় আনা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক নবগঠিত ব্যাংক কম্পানিগুলোকেও অপারেশনাল লাইসেন্সও প্রদান করে। কিন্তু সরকারের হাতে থেকে গেল বোর্ড সদস্যদের নিযুক্তি ও এমডির পদায়ন। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব ব্যাংকের ক্ষেত্রে কিছু পারে, কিছু পারে না। বোর্ড গঠনের ফলে অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে খারাপের দিকে গেছে। এমডি পদ দেখে বোর্ডও সুবিধামতো চলে ও বলে, এতে করে অসৎ এমডি নিজেই ডাকাতির নেতৃত্ব দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, এসব সরকারি ব্যাংকে অর্থ লোপাটের দায় সরকারের। জনগণ শত চিৎকার দিলেও কিছু হবে না, সরকার যদি বোর্ড গঠন ও এমডির পদায়নের ক্ষেত্রে সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠাকে মূল্য না দেয়। আজকে সোনালী ব্যাংকের এই অর্থ লোপাট যদি কোনো প্রাইভেট বাণিজ্যিক ব্যাংকে ঘটত তাহলে কী হতো? হতো একটাই, ব্যাংক বন্ধ হয়ে যেত। ব্যাংকের শাখাগুলোতে তালা ঝুলত। আমানতকারীরা লাইন ধরত তাদের অর্থ তুলে আনার জন্য। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিত। এমডি ইতিমধ্যেই জেলে যেতেন। ওই নামের ব্যাংক আর কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত না। প্রাইভেট ব্যাংকে সাগর চুরি হওয়ার আগেই বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসে। কু-ঋণ বাড়তে থাকলে পর্ষদ ভেঙে দিয়ে তথায় প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার অনেক উদাহরণ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কি সোনালী ব্যাংকের ক্ষেত্রে আরো কঠোর ভূমিকা নিতে পারছে না? জনগণ দেখতে চায় এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ। সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দিয়ে তথায় আপাতত প্রশাসক নিয়োগ দিলে ক্ষতি কী?
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.