ঋতু বৈচিত্র্যে শরতের সুর নিসর্গে ছন্দের দোলা আকাশে মেঘের ভেলা- শরতশুভ্রতায় অপরূপ সাজে প্রকৃতি by সমুদ্র হক ও তাহমিন হক ববী

এবারের শরত আগমনের শুরুতে যেভাবে বৃষ্টি ঝরছিল তাতে শান্ত এই ঋতুর দুয়ার প্রায় বন্ধই হয় হয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে বিদায়ী বর্ষা সহসা সেই দুয়ার খুলে দেবে কি না এ নিয়েও ছিল দ্বন্দ্ব। শেষ পর্যন্ত শরৎ তার অধিকার আদায় করেই ছেড়েছে। বাঙালীর ঋতুচক্রে নির্মল প্রশান্ত ও কোমল স্বভাবের শরতের প্রাণ জুড়ানো রূপটির পেখম মেলেছে।


তারপরও যেন অনেকটাই প্রচ্ছন্ন। ঋতু বৈচিত্র্যে শরৎ এতটাই শান্ত যে কাছের বন্ধু বর্ষাকে তার আঙ্গিনায় কিছুটা সময় থাকতে দেয়। সুযোগ পেয়ে বর্ষাও হয় অনেকটাই স্বার্থপর। অন্য ঋতুর মধ্যে অনধিকার প্রবেশ করে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে। এবারের শরতেও তা দেখা যাচ্ছে। যেতে চাইছে না। শরতের সঙ্গীতেও বৃষ্টি আছে, তবে তা ধ্রুপদী তালে মিষ্টি মধুর সুরে। এবারের শরতের শুরুতে সেই মিষ্টি মধুর সুর তাড়িয়ে দেয় বর্ষা। মুষল ধারায় ঝরতে থাকে। বর্ষা-শরতের দ্বন্দ্বের এই বারিধারা যে কতদিন থাকে তা প্রকৃতি বিশারদ আবহাওয়া বিভাগও বলতে পারছে না। এর মধ্যে সুযোগ পেলেই আকাশের ছাই রঙ্গা মেঘ সরিয়ে দিয়ে সাদা মেঘের ভেলায় বসে শরত জানান দেয় তার অধিকার বলয়ের মধ্যেই আছে। তখন আকাশে ভাসে বেখেয়ালি রূপালি মেঘ। আচমকা ঝলমলে রোদেলা আকাশ ধরণীকে সজীব করে তোলে। এই সজীবতা কখনও ক্ষণস্থায়ী, কখনও টেনে নিয়ে যায় রাতের ভরা চাঁদের মায়াবী আলোয়। ওই সময়টা নদী তীরের বালুচরে কাশবনের মাথায় শুভ্র ফুলের গুচ্ছে অনুপম হিল্লোল তুলে এনে দেয় আরেক নিসর্গ। এমন শুভ্র কাশবন শহরের কাছে কোন জলাশয়ের কাছেও দেখা যাচ্ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনী নিয়ে সত্যজিত রায় পথের পাঁচালি ছবিতে কাশবনে দুর্গা ও অপুর অনাবিল আনন্দে ছুটোছুটিতে কিশোর প্রণয়ের যে চিরন্তন অধ্যায় সেলুলয়েডের ফিতায় আবদ্ধ করেছেন তা প্রকৃতি প্রেমীদের কাছে শরতেরই নিসর্গ, যা মানব-মানবীর হৃদয়ের গভীরের মধুময়তায় গেঁথে থাকে। এমন নিবির রোমান্টিকতার পরশ শরৎ ছাড়া আর কোন্ ঋতুতে আছে! শরতের গভীর রাত শিশির সিক্ত হয়ে ধ্রুপদী রাগিনীর আবহে মানব হৃদয়ে যে নাড়া দেয় তা কি অন্য ঋতুতে মেলে। শরতের রাতে নদীর শান্ত ঢেউয়ে চাঁদের ও নক্ষত্রের প্রতিচ্ছবির নিসর্গ আর কখনও মেলে না। যারা মধ্যবয়সী ও প্রবীণ এমন রাতে নষ্টালজিক হয়ে যেতে পারেন। মনে পড়তে পারে যৌবনে শোনা কে এল সায়গলের মধুর কণ্ঠের গান ‘ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজে চাঁদ নাচে তারা নাচে পাহাড়িয়া বুঝি ওই নূপুরে বন্দী আছে...।’ প্রকৃতি শরৎকে কতই না মাধুর্য এনে দিয়েছে। নদী তীরের কোন পথিক কেতকীর (কেয়া) সুবাস পেয়ে বিমোহিত হন এই শরতেই। বিশেষ করে যমুনার তীরে কেতকী মিলবেই। শরতেই বনফুলের সৌরভে মেতে ওঠে গ্রামের পথে প্রান্তরের ঝাউবন। নাম না জানা কত বনফুল ফোটে এই সময়টায়। আর শেফালী বা শিউলি তো শরৎকে আগলেই রাখে। শিউলি না ফুটলে শরৎ অপূর্ণই থেকে যায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরৎকে ঘিরে কত কবিতা কত গান লিখে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও সুবাসিত করে রেখেছেন। ‘আজি নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরির খেলা’, ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’, ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা’, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা’, ‘শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎস্নাতে’ ‘শরৎ প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে’, ‘হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’ ... এমনই কত সুর কত কথা কাব্যে সাহিত্যে চিরন্তন করে রেখে গেছেন কবিগুরু শরতের জন্য।
মেঘে মেঘে মিতালী আকাশ হয়েছে বর্ণালী তাই প্রকৃতি সেজেছে অপরূপ সাজে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা।
জানা কথা যে, শরৎকালে দিগন্ত জুড়ে কাশফুল ফোটে। বর্ষা ঋতুর অবসানে অপূর্ব শোভা মেলে আবির্ভূত হয় শরৎকাল। ভোরবেলায় ঘাসের ডগায় জমে শিশির। বনে-উপবনে ফুটে ওঠে কত বিচিত্র সুন্দর ফুল- শিউলি, গোলাপ, বকুল, মল্লিকা, কামিনী, মাধবী! বিলে-ঝিলে হাওয়ায় দুলতে থাকে শাপলা। শাপলা বাংলাদেশের জাতীয় ফুল একথা সকলেই জানে, শাপলার কথা নতুন করে বলারও কিছু নেই। সারা বাংলাদেশের সমস্ত জলাশয়েই (শুধু নদী বাদে) জলজ ফুল শাপলাকে ফুটে থাকতে দেখা যায়। গ্রামবাংলার চিরায়ত দৃশ্য। আর খাল বিল ডোবায় শোভা পাচ্ছে বেগুনি রঙের কচুরিপানা ফুল। প্রকৃতি যে শরতে নিজেকে সাজিয়ে তোলে তা প্রকৃতির দিকে তাকালেই নজর কাড়ে। কাশফুল আর নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো সাদা মেঘের প্রতিবিম্ব, নদীর পানিতে যেন একাকার হয়ে যায়। এমন ঋতুতে নেচে ওঠে হৃদয়, রচিত হয় কবিতা, ভেসে আসে গান। আবার শরৎ মানে শুভ্রতা। আকাশলীনা তাই এবারেও সেজেছে শরতের কাশফুল আর শারদীয় শুভ্রতায়। এই যে আকাশ, কাশফুলে দোল, ভ্রমর-কুসুম-ফসল মাঠপসরা নিয়ে বসল সে যে শরতেরই রূপের হাট। প্রকৃতিতে এখন চলছে ঋতু রানী শরতের রূপের রঙ্গমেলা। রূপসী বাংলার রূপ সাগরে শরতের রূপ অপূর্ব। অনুপম রূপ সৌন্দর্যম-িত শরৎ ঋতু শারদ লক্ষ্মী নামে পরিচিত। লঘুভার মেঘের অলস-মন্থর নিরুদ্দেশ যাত্রা, আলোছায়ার লুকোচুরি, শিউলি ফুলের মন-উদাস করা গন্ধ, প্রভাতের তৃণ-পল্লবে নব-শিশিরের আল্পনা, তাতে প্রভাত-সূর্যের রশ্মিপাত ও শুভ্র জ্যোসনা পুলকিত রাত্রি- এই অনুপম রূপ নিয়ে বাংলার বুকে ঘটে শারদ লক্ষ্মীর আনন্দময় আবির্ভাব।
শরৎকালের মধ্যেই যেন বাংলাদেশের হৃদয়ের স্পর্শ পাওয়া যায়। সাদা সাদা মেঘগুলো যেন নীলাকাশে পেঁজা তুলোর ন্যায় ঘুরে বেড়ায়। মাঠে মাঠে সবুজের মেলা। মোটকথা এত সবুজ, এত নীল আর এত সাদার একত্র সমাবেশ অন্য কোন ঋতুতে দেখা যায় না।

No comments

Powered by Blogger.