অবরুদ্ধ সদরঘাট পোস্তগোলা সড়ক-বাকল্যান্ড বাঁধ দখল করে ব্যবসায়ীদের চাঁদাবাজি by আপেল মাহমুদ

সচল যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবসা কেন্দ্র জমে ওঠার পূর্বশর্ত। এ জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় রাস্তাঘাট উন্মুক্ত রাখতে ব্যবসায়ীরা আন্দোলন পর্যন্ত করে থাকেন। কিন্তু পুরান ঢাকার শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতি হাঁটছে উল্টো পথে। তারা দীর্ঘদিন ধরে বাকল্যান্ড বাঁধ দখল করে রীতিমতো চাঁদাবাজি চালিয়ে আসছে।


এতে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে সদরঘাট-পোস্তগোলা সড়ক যোগাযোগ।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের অভিযোগ, বাকল্যান্ড বাঁধের ওপর দিয়ে গড়ে ওঠা সদরঘাট-শ্যামবাজার-উল্টিগঞ্জ-পোস্তগোলা সড়কটি দখল করে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রেখেছে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতি। তাদের এই দখলের কারণে সদরঘাট থেকে পোস্তগোলা মহাশ্মশান ঘাট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ কিলোমিটার সড়ক দীর্ঘদিন ধরে অচল হয়ে আছে। সড়কটি কয়েক বছর আগে ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছিল। কিন্তু বণিক সমিতির কতিপয় প্রভাবশালী নেতার চাঁদাবাজির কারণে সড়কটি এক দিনের জন্যও উন্মুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মোহাম্মদ হানিফ ডিসিসির মেয়র থাকাকালে শ্যামবাজার আড়তের পাশে বাকল্যান্ড বাঁধ বণিক সমিতির কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার নামে অস্থায়ী ভিত্তিতে টোল দোকান হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। টোল ভাড়ার চুক্তিপত্রে উল্লেখ ছিল, সকালের নির্ধারিত সময়েই শুধু সেখানে আড়তদারি করা যাবে। কিন্তু প্রথম থেকেই আড়তদাররা ওই চুক্তিপত্রের শর্ত মানেননি। তাঁরা সারা দিনই সড়কটি অবরুদ্ধ করে রাখেন। এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে ডিসিসি ওই চুক্তি বাতিল করে দেয়। কিন্তু তাতে কোনোই লাভ হয়নি। আড়তদাররা বরাবরের মতোই সড়ক দখল করে সেখানে ব্যবসা অব্যাহত রেখেছেন।
একই সঙ্গে এসব অবৈধ আড়ত থেকে প্রতিদিন বুড়িগঙ্গা নদীতে শত শত টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। এতে পানিদূষণের পাশাপাশি নদীটি ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আড়তগুলো উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। তারা নদীদূষণ ও ভরাট বন্ধ এবং বাকল্যান্ড বাঁধের সড়কটি উন্মুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ জন্য ২ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ে এক সভার আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নেন।
এদিকে সড়ক দখল করে আড়তদারির ব্যাপারে ব্যবসায়ীরা পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন। বণিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজি মো. সেলিম বলেন, 'সড়কে আড়তদারি নতুন নয়। ১৯৬২ সাল থেকে এখানে কৃষিপণ্যের আড়ত চলে আসছে।'
অভিযোগ উঠেছে, মেয়র হানিফ শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির নামে বাকল্যান্ড বাঁধ নিয়মবহির্ভূতভাবে ভাড়া দেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সেই ভাড়ার চুক্তি বাতিল করা হয়। এর সত্যতা স্বীকার করে সমিতির দপ্তর সম্পাদক হরিদাস বণিক বলেন, তাঁরা বাকল্যান্ড বাঁধ দখল করেননি। আড়তের ফড়িয়ারা বাঁধ দখল করে ব্যবসা করছেন।
এ প্রসঙ্গে একাধিক ফড়িয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আড়ত মালিক ও শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতিকে প্রতিদিন চাঁদা দিয়েই তাঁরা ব্যবসা করছেন। সুবল চন্দ্র দাস নামের এক ফড়িয়া বলেন, নির্দিষ্ট হারে চাঁদা না দিয়ে কেউ এখানে বসতে পারেন না। চাঁদা ছাড়া কেউ পসরা সাজিয়ে বসলে সমিতির লোকজন তাঁদের মালপত্র বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। ফরাশগঞ্জ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হযরত আলী মুন্সী বলেন, সমিতির নেতা আর আড়ত মালিকরা যুগ যুগ ধরে বাকল্যান্ড বাঁধ অবৈধভাবে দখল করে সেখান থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করছেন। এর ফলে বাঁধের সড়কটি সব সময় অবরুদ্ধ থাকে। সেখানে যানবাহন দূরের কথা, পথচারীরা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাস্তবে বাকল্যান্ড বাঁধ সড়কের কোনো অস্তিত্বই রাখা হয়নি। সদরঘাট টার্মিনালের পূর্ব পাশ থেকে ফরাশগঞ্জ পর্যন্ত বাঁধের দুই পাশে শত শত অবৈধ দোকানপাট ও আড়ত গড়ে উঠেছে।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে জানা যায়, দুই হাজার ফুট দীর্ঘ এবং ৩০ থেকে ৩৫ ফুট প্রশস্ত বাকল্যান্ড বাঁধে প্রায় ২৫০টি অবৈধ দোকান রয়েছে। যাদের কাছ থেকে আড়ত ও দোকান মালিকরা দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করে থাকেন। এই চাঁদাবাজিতে কমপক্ষে ৮০ জন আড়ত কিংবা দোকান মালিক জড়িত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আড়ত হলো- লাকী ট্রেডার্স, নাজির মুন্সির আড়ত, তারা মিয়ার আড়ত, বদিউজ্জামানের আড়ত, ঢাকা সান আড়ত, মতিলাল কৃষি বাণিজ্যালয়, হাজি চান মিয়ার আড়ত, হাজি আবদুল করিমের আড়ত, নিউ লক্ষ্মী ভাণ্ডার, রেহান উদ্দিন বাণিজ্যালয়, রেহান বাণিজ্যালয়, আল্লাহর দান আড়ত, নূরজাহান হাফিজ আড়ত। তারা আড়তের সামনে বাঁধের ওপর দোকান বসিয়ে প্রতিজনের কাছ থেকে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। গড়ে ৭০০ টাকা হলে ২৫০ দোকান থেকে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হচ্ছে পৌনে দুই লাখ টাকা, যা মাসে দাঁড়ায় সাড়ে ৪৫ লাখ টাকা। এই চাঁদার ভাগ ডিসিসি ও বিআইডাব্লিউটিএর কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা পেয়ে থাকেন বলে জানা গেছে।
সূত্রে জানা যায়, সড়কটি সচলে মন্ত্রণালয় থেকে পাঁচ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো হলো- অবৈধ দোকানপাট ও আড়ত উচ্ছেদ, ভাঙা রাস্তা সংস্কার, মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে আড়ত মালিক ও অবৈধ দোকানের বিরুদ্ধে জেল-জরিমানা, ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন এবং সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় করা।

No comments

Powered by Blogger.