অন্ধকার দিয়ে অন্ধকার তাড়ানো! by মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া

সাম্প্রতিক সময়ে এমএলএম ব্যবসাকেন্দ্রিক সমালোচনা আর বিশ্লেষণ সব শ্রেণীর মানুষের কাছে নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সিদ্ধান্ত ইদানীং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আবার নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বিপণনের ছাত্র হিসেবে গ্রাহকের অস্পষ্টতার দায়ভার আমাকেও কিছুটা নিতে হবে এবং এ দায়ভার থেকেই আমার এ বিষয়ে লেখার অবতারণা।


বিপণন বোদ্ধা মাত্রই জানেন, একটি পণ্যের তিনটি লেভেল বা স্তর থাকে। এক. কোর (Core) লেভেল, যেখানে গ্রাহকের মূল দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। পণ্যটি ক্রয়ের পেছনে আপনার কষ্টার্জিত উপার্জন খরচ করবেন কি না, তা মূলত কোনো পণ্যের কোর লেভেলের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। অভিজ্ঞ মার্কেটাররা বলেন, পণ্য ক্রয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোর লেভেল ৬০ শতাংশই বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। যেমন- আপনি একটি শার্ট কিনতে চান। প্রথমেই যে বিষয়টি আপনি বিবেচনা করবেন তা হলো, পণ্যটির সুতা, বুনন, কালার আর ফিনিশিং কেমন; মোট কথা পণ্যটির গুণগতমান। অতঃপর তা পড়তে আরামদায়ক কিংবা তা পরিধান করলে আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে কি না। দুই. অ্যাকচ্যুয়াল লেভেল, যেটা নির্দেশ করে পণ্যটির দাম। আপনার শত পছন্দ হলেও ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে না থাকলে আপনি ওই পণ্যটি কিনবেন না- এটাই স্বাভাবিক। তিন. অগমেন্টেড লেভেল, যেটা পণ্যের প্যাকেজিং, বিক্রেতার ব্যবহার, স্পেশাল কোনো ছাড়, দোকানের লোকেশন কিংবা ওই বিক্রেতার ওপর আপনার অতিরিক্ত কোনো ধরনের ফ্যাসিনেশান আছে কি না, এসব বিষয় পণ্য ক্রয়ে আপনাকে উৎসাহিত করতে পারে। পণ্যটি স্পর্শনীয় পণ্য হলে যেকোনো গ্রাহক সহজেই লেভেল বিবেচনাপূর্বক ক্রয় করতে পারে। এসব পণ্যে সতর্কতা অবলম্বন না করলেও প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। দেখা যায়, কোনো ক্ষেত্রে বিক্রেতা চেষ্টা করলেও গ্রাহককে প্রতারিত করতে পারে না। কারণ, পণ্যটি ক্রেতার কাছে অনেকাংশে ভিজ্যুয়াল। তবে আইডিয়া বা ধারণা পণ্যের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের পণ্যের লেভেল সম্পর্কে সচেতন না হলে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ, পণ্যটি অনেকাংশে ক্রেতার কাছে ভিজ্যুয়াল নয়। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে এমএলএম ব্যবসার মূল পণ্যটি হলো, আইডিয়া পণ্য। সে ক্ষেত্রে ক্রেতা পণ্য ক্রয়ে লাভবান হবে, না ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এক. বিক্রেতার সততা, দুই. ক্রেতার সচেতনতা। কিন্তু বর্তমানে এমএলএম ব্যবসার বিক্রেতা ও ক্রেতার ধরন দেখে এটা সহজেই অনুমেয়, উভয় ক্ষেত্রে 'স' শব্দটা বেশ সংকুচিত কিংবা অনেকাংশে বিলুপ্তপ্রায়। অভিজ্ঞরা বলেন, ব্যবসায় 'স' শব্দের অনুপস্থিতি মানে প্রতারণার উপস্থিতি। আর এই প্রতারণারই জয়জয়কার চলছে বর্তমান এমএলএম ব্যবসায়।
এমএলএম ব্যবসা মানে আপনার কাছে একটি ধারণা বিক্রয় করা। অস্পর্শনীয় ধারণা পণ্যকে ক্রেতার কাছে কাঙ্ক্ষিত কিংবা লোভনীয় করার জন্য এমএলএম বিক্রেতারা আশ্রয় নেয় স্পর্শনীয় কিছু পণ্যের। আপনি পণ্যটি ক্রয়ে যে মূল্য পরিশোধ করেন তাৎক্ষণিকভাবে এর তিন ভাগের এক অংশ বা কোনো ক্ষেত্রে এরও কম অংশের সমপরিমাণ মূল্যের পণ্য পান, বাকিটার রিটার্ন নির্ভর করে অনাগত ভবিষ্যতের ওপর। এই হাওয়ানির্ভর ভবিষ্যৎই লাখ লাখ গ্রাহককে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। বিষয়টি পাঠকদের বোধগম্য করার জন্য আবার পণ্যের লেভেল উদাহরণটির অবতারণা করছি। এমএলএম-আশ্রিত আইডিয়া পণ্যটির কোর লেভেল হলো কিছু কাগজপত্র, যেখানে কিছু শর্তাবলি সংযোজিত থাকে। সেখানে গ্রাহককে অবশ্যই কম্পানির অতীত পারফরম্যান্স (ওই পণ্যের ক্ষেত্রে) মূল্যায়ন নির্দেশক (Indicators) সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে। এখানে গ্রাহকের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এমএলএম ব্যবসার কোনো রিটার্ন সাইকেলের মেয়াদ এখনো শেষ হয়নি (উদাহরণস্বরূপ সবেচেয়ে আলোচিত একটি এমএলএম কম্পানির ট্রি-প্ল্যানটেশন) বিধায়, গ্রাহকরা পরিপূর্ণভাবে কম্পানির পণ্য লাইনের পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে পারছে না। অ্যাকচ্যুয়াল লেভেলের মূল বিষয় দাম। সেখানেও নির্ভর করছে ভবিষ্যৎ। কারণ, এমএলএম ভবিতব্য পণ্য বিক্রি করে বেশি। অগমেন্টেড লেভেলে এমএলএম ব্যবসায়ীরা বেশ এগিয়ে। ক্রেতাকে আকৃষ্ট করার জন্য তারা বাহারি লিফলেট, পোস্টার, এ-সম্পর্কিত বই, বিজ্ঞাপন, স্পন্সরশিপ, সেমিনার কিংবা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য ব্যবহার করছে মিডিয়া এবং এলিট শ্রেণীর কিছু ব্যক্তিবর্গকে; যেখানে ডিফেন্সের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সরকারি আমলা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পর্যন্ত আছেন। গ্রাহকরা এত দিন এমএলএম আইডিয়া পণ্যের কোর ও অ্যাকচ্যুয়াল লেভেল দৃশ্যমান না হওয়া সত্ত্বেও শুধু অগমেন্টেড লেভেলের তোড়ে পণ্য কিনে আসছে। এখন গ্রাহকরা কোনো অংশে প্রতারিত হলে এলিট শ্রেণীর জড়িত অংশকেও এ দায়ভার কিছুটা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোনো পণ্যের দুটি লেভেলই যেখানে অস্পষ্ট থাকে কিংবা আইন দ্বারা থাকে না পরিশোধ্য, সেখানে শুধু অগমেন্টেড লেভেলের জোড়ে পণ্য বিক্রি করা মানে ৬০ শতাংশ ক্রেতাদের লোকসান হওয়ার চেয়ে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে সবচেয়ে বেশি। লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারলেও প্রতারণা কাটিয়ে ওঠা অনেকাংশে দুষ্কর বটে। এ যেন কেবলই চোরাবালি সদৃশ; যতই বাঁচার প্রচেষ্টা ততই গহিনে পতন!
বর্তমানে এমএলএম ব্যবসায় গ্রাহকের বিশ্বাসের পতন প্রায় শূন্যের কোটায়। যাদের আস্থাভাজন গ্রাহক হিসেবে মিডিয়ার সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে তারা মূলত প্রথম সারির গ্রাহক। তারা জানে, সেটা প্রতারণা; কিন্তু অর্থের লোভে অন্ধ হয়ে আছে। মূলত তাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি কোনো ধরনের আস্থা আছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় না। আস্থার ঘাটতি হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গাঁথুনি বালির বাঁধের মতো ভেঙে যায়। এ অবস্থায় অনেকেই এমএলএম কম্পানিতে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ অনেকটা মহিলাদের পিলো পাসিং খেলার মতো ভাবছেন। শেষ ব্যক্তি ধরাশায়ী হওয়া নাগাদ পূর্ববর্তী খেলোয়াড়রা টিকে থাকবে। একজন করে সবাই ধরাশায়ী হবে। পিলো পাসিং খেলায় খোলোয়াড়ের সংখ্যা নগণ্য হওয়ায় বিষয়টি সহজে বোধগম্য; কিন্তু কোটি লোক যেখানে জড়িত, সেখানে রেফারিসদৃশ এমএলএম ব্যবসায়ীরাই কেবল ভালো বুঝবে এ খেলার শেষ পরিণাম কী। কারণ বাংলাদেশের ১৫ কোটি লোককে কখনো নেটওয়ার্কের আওতায় আনা সম্ভব হবে না। তাই শেষের লেভেলে সবাই ধরাশায়ী হবে, তা নিশ্চিত। এভাবে একজনের সর্বনাশ করে আরেকজনের বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন মোটেই নৈতিক পথ নয়। সাধারণ গ্রাহককে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা এবং এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন সরকারের দুটি বিষয়ের ওপর আশু দৃষ্টিপাত। এক. একটি পূর্ণাঙ্গ এমএলএম ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ আইন। দুই. গ্রাহক সচেতনতা ক্যাম্পেইন। তবে ইতিমধ্যে ডাইরেক্ট সেল আইন-২০১২ খসড়া চূড়ান্ত। এখন দেখার বিষয়, আইনের যুগোপযোগিতা এবং কার্যকর বাস্তবায়ন।

লেখক : প্রশিক্ষক, কলামলেখক ও সমাজকর্মী

No comments

Powered by Blogger.