এক নির্লোভ রাজনীতিকের কথা by আলমগীর সাত্তার

পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন মানুষ জন্মগ্রহণ করবে এবং করবে মৃত্যুবরণও। জন্ম ও মৃত্যুর এ মধ্যবর্তী সময়ে কে কেমন জীবনযাপন করেছে, কে কী কাজ করেছে, তার ওপর নির্ভর করবে লোকান্তরিত ব্যক্তিকে মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে না অশ্রদ্ধার সঙ্গে এবং কতকাল স্মরণ করবে? এই বিচারে আবিদুর রেজা খানকে মানুষ বহুকাল শ্রদ্ধার সঙ্গেই মনে রাখবে। তার জন্ম ১৯২৭ সালে শরীয়তপুর জেলার ভেদরগঞ্জ উপজেলায়।
তিনি মৃত্যুবরণ করেন ২০০৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, সুপ্রিম কোর্টের খ্যাতিমান আইনজীবী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং এলএলবি পাস করে তিনি আইন ব্যবসায় যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধু আবিদুর রেজা খানকে ঢাকা বারের আইনজীবীদের আওয়ামী লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার দায়িত্ব দেন। আবিদুর রেজা খান বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে প্রায় পাঁচ বছরের ছোট ছিলেন। কিন্তু চেহারা ও দৈহিক গড়নের দিক থেকে দু'জনেই ছিলেন প্রায় একই রকমের। এরিনমোর তামাক দিয়ে পাইপ টানতেন একই স্টাইলে। এসব কারণে বঙ্গবন্ধুকে যারা কেবল ছবিতে দেখেছেন, তারা আবিদুর রেজাকে দেখলে হঠাৎ করেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়তেন। এই বিভ্রান্তির কারণে বঙ্গবন্ধু একবার একটা মারাত্মক বিপদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে রাজনীতিবিদ এবং সর্বস্তরের মানুষের খুব ভিড় হতো। ওই রকম অবস্থায় একাত্তরের ৭ জানুয়ারি এক সম্ভাব্য আততায়ী যুবক নিরাপত্তার শিথিল ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে মানুষের ভিড়ে মিলেমিশে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। ড্রয়িংরুমে অন্যদের সঙ্গে আবিদুর রেজাও উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাসার ভেতরে। ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করে অপরিচিত যুবক আবিদুর রেজা সাহেবকে বঙ্গবন্ধু বলে মনে করে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। দেহ তল্লাশি করার পর তার জামার নিচে লুকানো একখানা বড় ছোরার সন্ধান পাওয়া গেল। পরদিন পত্রিকাগুলো বেশ গুরুত্ব দিয়ে ঘটনাটি প্রকাশ করেছিল।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গেও আবিদুর রেজার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কলকাতায় থাকাকালে সে পরিচয় আমি পেয়েছিলাম। পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর আবিদুর রেজা খান কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে যান। স্থায়ী বিষাদে ভর করল তাকে। তার আর আগের উদ্যম এবং উদ্দীপনা রইল না। পঁচাত্তরের বিষাদময় ঘটনার আগে এবং পরের আবিদুর রেজা সাহেব কেন একই ব্যক্তি নন। এমনটাই হওয়ার কথা। কারণ তিনি যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুরই ডুপ্লিকেট। পঁচাত্তরের পরবর্তী রাজনৈতিক অরাজকতার প্রেক্ষাপটে তিনি হয়ে পড়লেন বড়ই বেমানান। নির্লোভ নিষ্কলুষ এবং সাহসী চরিত্রের মানুষ আবিদুর রেজা খানের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার পবিত্র স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রার্থনা করছি, তার মতো মানুষ যেন এই বাংলায় অধিক সংখ্যায় জন্মগ্রহণ করে, তবেই না বাংলাদেশ বর্তমান তমসাচ্ছন্ন কাটিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হতে পারবে।

আলমগীর সাত্তার (বীরপ্রতীক) সাবেক বৈমানিক ও প্রাবন্ধিক

No comments

Powered by Blogger.