বুয়েট পরিস্থিতি ঘোলাটে-* দিনভর শিক্ষার্থীদের আন্দোলন * নতুন আলটিমেটাম আজ ১১টা পর্যন্ত * ছাত্রলীগের হামলার চেষ্টা

শিক্ষার্থীদের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে বুয়েটের উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগ করেননি। এ কারণে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গতকাল রবিবার সারা দিন ক্যাম্পাসে অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন এবং উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা দাহ করেছেন।


তাঁদের পদত্যাগের জন্য আজ সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত নতুন করে সময় দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ সময়ের মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য তাঁদের কার্যালয়ে এসে পদত্যাগের ঘোষণা না দিলে আরো কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁরা। এর আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা প্রশাসনিক ভবনেই অবস্থান করবেন। পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য শিক্ষার্থীরা গত শনিবার উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে রবিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছিলেন।
এদিকে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের কক্ষে ভাঙচুর ও অনুপ্রবেশের অভিযোগে গতকাল রাত সাড়ে ১১টার দিকে বুয়েটের নিরাপত্তা কর্মকর্তা আবদুল কুদ্দুস খান বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় দুটি মামলা দায়ের করেছেন। এর মধ্যে উপাচার্যের কক্ষে ভাঙচুর ও অনুপ্রবেশের অভিযোগে শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ ড. আতাউর রহমান ও ড. ইশতিয়াক আহমেদকে প্রধান আসামি করে ১৫০ জন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নামে একটি মামলা এবং উপ-উপাচার্যের কক্ষে ভাঙচুর ও অনুপ্রবেশের অভিযোগে ড. মাকসুদ হেলালীকে প্রধান আসামি করে ৪৫ জন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর নামে অন্য মামলাটি দায়ের করা হয়। দুই মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৪ জনই শিক্ষক।
মামলা দায়েরের পর পরই রাত পৌনে ১২টার দিকে ক্যাম্পাসে ব্যাপক পুলিশ ও দাঙ্গা পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, ক্যাম্পাসে যাতে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্যই পুলিশের এই অবস্থান। বুয়েট ক্যাম্পাসের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের আইজিপি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারকে দেওয়া হাইকোর্টের নির্দেশনার কাগজ নিয়ে রাতে শাহবাগ থানার ওসি ক্যাম্পাসে টহল দেন এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে বিরত থাকতে চাপ দেন বলে জানা গেছে। এ ঘটনায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ রাতে মরিসাস থেকে ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের জানান, ক্লাস বন্ধ রেখে বুয়েট শিক্ষকদের আন্দোলনের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল ১১টার দিকে ক্যাম্পাসে মানববন্ধন এবং দুজনের কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। উপাচার্যের কার্যালয়ে সাধারণ শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা বর্তমান উপাচার্যের সময়কালকে 'কালো অধ্যায়' হিসেবে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে ছাত্রলীগ ও কিছু বহিরাগত মিলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা চালায়। তবে শিক্ষকদের হস্তক্ষেপে সংঘর্ষ এড়ানো সম্ভব হয়। বুয়েটে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি না থাকলেও চলমান আন্দোলনের বিরোধিতায় ছাত্রলীগ কর্মীদের সক্রিয় থাকতে দেখা যায়। তবে গতকালই প্রথম তারা সংগঠিতভাবে প্রকাশ্য অবস্থান নেয়।
মানববন্ধন ও কুশপুত্তলিকা দাহ
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা গতকাল সকাল সোয়া ১১টার দিকে বুয়েটের পুরকৌশল ভবনের সামনে জড়ো হয়ে মানববন্ধন করেন। এ সময় উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলাম ও উপ-উপাচার্য ড. এম হাবিবুর রহমানের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়। সকাল সাড়ে ১১টার দিকে তাঁরা মিছিল বের করে প্রশাসনিক ভবনের সামনে গেলে পুলিশ মিছিলটি থামিয়ে দেয়। পুলিশ আদালতের নির্দেশনা দেখিয়ে বলে, মিছিল করা যাবে না। তা হলে আদালত অবমাননা হবে। এ সময় শিক্ষার্থীরা পাল্টা যুক্তি দেখালে পুলিশ সরে যায়। পরে মিছিলটি ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে আবারও প্রশাসনিক ভবনের সামনে যায়। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা সেখানেই অবস্থান করছিলেন। পদত্যাগের বিষয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের সিদ্ধান্ত জানতে তাঁদের কার্যালয়ে যান শিক্ষকরা। তবে এ সময় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য কার্যালয়ে ছিলেন না। তাঁদের না পেয়ে শিক্ষকরা সেখানেই অবস্থান নেন।
ছাত্রলীগের হামলার চেষ্টা : দুপুর ১২টার দিকে ক্যাফেটরিয়ার সামনে থেকে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা একটি মিছিল বের করে। মিছিলটি প্রশাসনিক ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের কথাকাটাকাটি হয়। শিক্ষার্থীরা বলেছেন, লাগাতার আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকাল উপাচার্যের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী ও কিছু বহিরাগত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে। ছাত্রলীগের পক্ষে নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক রওনক জাহান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক তন্ময় আহমেদ, সদস্য দেবজিৎ সরকার মম, পলাশ, ইমরান, বন্ধন, দেবাশীষসহ অন্যরা।
বুয়েট ছাত্রলীগের প্রায় ৫০ কর্মীকে সাদা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে ক্যাফেটরিয়ার সামনে জড়ো হতে দেখা যায়। তাঁদের টি-শার্টে লেখা ছিল- 'সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দ ক্লাসকে আন্দোলনের বাইরে রাখুন।' এর কিছুক্ষণ পর তাঁরা 'বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ' লেখা একটি ব্যানার নিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল শুরু করেন। ব্যানারে লেখা ছিল, 'অবিলম্বে ক্লাস শুরুর দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ।'
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছে, দুপুরে ছাত্রলীগ যখন হামলার চেষ্টা চালায় তখন কয়েক শ সাধারণ শিক্ষার্থীরা রেজিস্ট্রার ভবনের দোতলায় অবস্থান করছিল। ছাত্রলীগের মারমুখী চেহারা দেখে দোতলায় ওঠার ফটক বন্ধ করে দেন শিক্ষার্থীরা। ফটক ভাঙার জন্য ছাত্রলীগ কর্মীরা ব্যাপক চেষ্টা চালায়। ব্যর্থ হয়ে নিচে নেমে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি ও তাদের 'শিবির ও হিজবুত তাহ্রীরের' কর্মী বলে উল্লেখ করে। ছাত্রলীগের এই কর্মকাণ্ডের সময় মাইকে শিক্ষক ড. হুমায়ুন কবীর শিক্ষার্থীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে তোমরা মারামারি করো না। মিডিয়া রয়েছে, তারাই সব দেখছে, সাধারণ শিক্ষার্থী যারা আছ তারা শান্ত থাকো।' এ পর্যায়ে ছাত্রলীগের কয়েকজন এসে ড. হুমায়ুন কবীরের হাত থেকে মাইক কেড়ে নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে পাঠিয়ে দেন। ওই সময় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে ছাত্রলীগ নেতারা তাঁদেরও হুমকি দেন। তাঁরা বলেন, এ খবর বা ছবি প্রকাশ হলে সাংবাদিকদের বুয়েটে ঢোকা বন্ধ করে দেওয়া হবে। পরে শিক্ষক সমিতির কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আতাউর রহমানের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন, সমাবেশে 'বাধা সৃষ্টিকারীদের' মধ্যে অল্প কয়েকজনই এখনো ছাত্র। অন্যরা বহিরাগত। এ বিষয়ে ড. হুমায়ুন কবির বলেন, 'কিছু বহিরাগত হামলা করে আমাদের আন্দোলন নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে। তবে আমরা ভীত নই।' তিনি বলেন, 'আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব এবং উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
কালো অধ্যায় : বুয়েট উপাচার্যের কার্যালয়ে এর আগে যতজন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ছবি ও মেয়াদকাল উল্লেখ রয়েছে। গতকাল কার্যালয়ে ঢুকে দেখা গেছে, আগের উপাচার্যদের রঙিন ছবির পাশে বর্তমান উপাচার্য ড. এস এম নজরুল ইসলামের কম্পিউটারে প্রিন্ট দেওয়া সাদাকালো ছবি টানানো হয়েছে। সেই ছবির ওপরে লেখা হয়েছে 'কালো অধ্যায়।' ছবির নিচে বর্তমান উপাচার্যের মেয়াদকাল উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, '৩১-০৮-২০১০ থেকে ০২-০৯-১২।' অর্থাৎ সরকার এই উপাচার্যকে এখন পর্যন্ত না সরালেও শিক্ষার্থীরা তাঁকে সরিয়ে দিয়ে নিজেরাই উপাচার্যের মেয়াদকালের তারিখ লিখে দিয়েছেন। উপাচার্যের কার্যালয়ে অবস্থানকারী কয়েকজন শিক্ষক বলেন, 'আমরা আন্দোলন করছি না। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে এবং তাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেটি দেখার জন্য আমরা বসে আছি। তবে এ সময় শিক্ষকদের গায়ে কালো রঙের টি-শার্ট পরা ছিল। তাঁদের টি-শার্টে লেখা ছিল 'বুয়েটকে বাঁচান। উপাচার্য, উপ-উপাচার্যকে অপসারণ করুন।'
পদত্যাগের কথা ভাবছেন কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে বুয়েট উপাচার্য এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, 'আমাকে কোনো সময় বেঁধে দেওয়া হয়নি। শিক্ষকরা গতকাল (শনিবার) আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন, আমি তাঁদের কথা শুনেছি। আমার কথাও তাঁদের জানিয়েছি।' তিনি বলেন, পদত্যাগের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।
নতুন কর্মসূচি : শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দেওয়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদত্যাগ না করায় সোমবার সকাল ১১টা পর্যন্ত নতুন সময় বেঁধে দিয়ে প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে বুয়েটের সপ্তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সুদীপ্ত সাহা এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, 'তাঁরা পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। আমরা বিকেল থেকে প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান নিয়েছি। সারা রাত এখানেই থাকব। সোমবার সকাল ১১টার মধ্যে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যকে পদত্যাগ করতে হবে। বুয়েট বাঁচাতে আমাদের আন্দোলন চলবেই।'

No comments

Powered by Blogger.