তিন খুনীসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব, জিজ্ঞাসাবাদ- ডা. নিতাই হত্যাকা- ॥ বিএমএ ও স্বাচিপের প্রতিবাদ সমাবেশে ৫ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী পর্ষদের সদস্য এবং স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. নারায়ণচন্দ্র দত্ত নিতাইয়ের চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের ৩ পরিকল্পনাকারী ও ৩ খুনীসহ মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব।


সব মিলিয়ে ডা. নিতাই হত্যাকা-ে র‌্যাব ও পুলিশের হাতে সর্বমোট ১২ জন গ্রেফতার হলো। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদিকে ডা. নিতাই খুনের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বিএমএ ও স্বাচিপ কর্তৃক আয়োজিত প্রতিবাদ সভা থেকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ডা. নিতাইয়ের খুনীদের শনাক্ত করে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার, কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনসহ ৬ দফা দাবিসহ ৫ দিনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে আগামী ৬ সেপ্টেম্বর দেশের প্রতিটি হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টা কর্মবিরতির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। তবে হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের জরুরী বিভাগের চিকিৎসাসেবা ২৪ ঘণ্টাই সচল থাকবে।
গত ২২ আগস্ট রাজধানীর বনানী থানাধীন মহাখালী জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সরকারী শিক্ষক কোয়ার্টারের ওয়াই/২ নম্বর ডুপ্লেক্স বাড়িটির দ্বিতীয় তলার নিজ শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে খুন হন ডাঃ নারায়ণচন্দ্র দত্ত নিতাই (৪৭)। তিনি জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালের এসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর স্ত্রী ডা. লাকী দত্ত একই হাসপাতালের গাইনী বিভাগের চিকিৎসক। ডা. লাকী দত্ত ও চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনসহ স্বর্গীয় নিতাইয়ের পরিবার হত্যাকা-টি অদ্যাবধি পরিকল্পিত বলে দাবি করে আসছে।
তবে ডা. নিতাইয়ের পিতা তুরিদচন্দ্র দত্ত রাজধানীর বনানী থানায় দায়ের করা মামলায় চুরি, ৫ লাখ টাকার মালামাল লুণ্ঠন ও হত্যার অভিযোগ আনেন। মামলায় কাউকে এজাহারনামীয় আসামি করা হয়নি। ২৩ আগস্ট রাতেই মামলাটির তদন্তভার বনানী থানা পুলিশ থেকে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে ন্যস্ত হয়।
খুনীদের গ্রেফতারে মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ মাসুদ ওরফে পেদা (২৮), সাইদুল (৩৮), পিচ্চি কালাম (৩৫) ও ফয়সালকে (৩২) গ্রেফতার করে। র‌্যাব কামাল নামে একজনকে গ্রেফতার করে। সর্বশেষ গত ৩১ আগস্ট সিলেট থেকে মিন্টুকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। মিন্টুকে ৭ দিনের এবং পেদা, সাইদুল, পিচ্চি কালাম ও ফয়সালকে ৪ দিন করে রিমান্ডে নেয় ডিবি পুলিশ। ডিবির হাতে সর্বশেষ গ্রেফতারকৃত মিন্টুর দাবি, হত্যাকা-ের মূল পরিকল্পনার সঙ্গে ডা. নিতাইয়ের গাড়িচালক কামরুল হাসান অরুণ জড়িত। কারণ অরুণের তথ্যমতেই তারা ডা. নিতাইয়ের বাসায় চুরি করতে যায়। চুরির সময় বাধাপ্রাপ্ত হয়ে তারা ডা. নিতাইকে ছুরিকাঘাতে খুন করে।
র‌্যাব সদর দফতরে রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাব-১ ও র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে গত শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ডা. নারায়ণের ব্যক্তিগত গাড়িচালক এবং হত্যাকা-ের অন্যতম পরিকল্পনাকারী কামরুল হাসান ওরফে অরুণকে (২৭) টঙ্গী থেকে গ্রেফতার করে। অরুণ ইতোপূর্বে ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৫ বছর সাজা ভোগ করেছে। তার পিতার নাম হারুন মাতব্বার (মৃত)। বাড়ি মাদারীপুর সদর জেলার নয়াচর গ্রামে। সে মহাখালী সাততলা বস্তিতে বসবাস করত।
অরুণের তথ্যমতে, খুনের মূল পরিকল্পনাকারী রিলায়েন্স মেডিক্যাল এ্যান্ড সার্ভিসেস সেন্টারের ম্যানেজার সাইদুর রহমানকে (৩৬) গ্রেফতার করা হয়। তার পিতার নাম ওয়ালিয়ার রহমান। বাড়ি মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানাধীন জাঙ্গালিয়া গ্রামে। এরপর শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে রাজধানীর মহাখালীর ৫৩ নম্বর টিভি গেট এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় ডা. নারায়ণচন্দ্রের কম্পাউন্ডার তারিকুল ইসলামকে (২৪)। তার পিতার নাম সুলতান হোসেন হাওলাদার। বাড়ি বরিশাল জেলার গৌরনদী থানাধীন মাহিলারা গ্রামে। সে ডা. নারায়ণ হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত। তারিকুল রাজধানীর তেজগাঁও থানার জুয়েল হত্যা মামলায় ৫ বছর সাজা ভোগকারী। এরপর রাত সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর কাওরানবাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় বকুল মিয়াকে (২৬)। তার পিতার নাম প-িত মিয়া (মৃত)। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী থানাধীন চর জাকালিয়া গ্রামে। সে তেজগাঁও গার্ডেন রোডের শশীমা গলির একটি বাড়িতে বসবাস করত। সে ডা. নিতাই হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত। সেও রাজধানীর তেজগাঁও থানার জুয়েল হত্যা মামলায় ৫ বছর সাজা ভোগকারী। এরপর শনিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে কাওরানবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয় রফিকুল ইসলামকে (২৪)। তার পিতার নাম আব্দুল লতিফ মিয়া। বাড়ি ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার কালিসীমা গ্রামে। সে রাজধানীর তেজগাঁও থানাধীন ৫৫ নম্বর কাজী নজরুল ইসলাম এ্যাভিনিউ, ফার্মগেট এলাকায় বসবাস করত। সর্বশেষ রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে মাওয়া ফেরিঘাট এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় সাঈদকে (২৭)। তার পিতার নাম আক্কাস আলী। বাড়ি বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানাধীন ভুতেরদিয়া গ্রামে।
র‌্যাব জানায়, হত্যার পরিকল্পনাকারী রিলায়েন্স মেডিক্যাল সার্ভিসের ম্যানেজার সাইদুর রহমান প্রায় ১০ মাস আগে কামরুল হাসান অরুণকে ডা. নারায়ণচন্দ্র দত্ত নিতাইয়ের চালক হিসেবে কৌশলে নিয়োগ দেয়। ম্যানেজার সাইদুর, কম্পাউন্ডার তারিক ও চালক অরুণ ডা. নিতাইয়ের সমস্ত বিষয় জানত। ২ মাস আগে ম্যানেজার সাইদুর ও কম্পাউন্ডার তারিক ড্রাইভার অরুণকে ডা. নারায়ণের বাসায় পেশাদার খুনী বা ডাকাত পাঠানোর জন্য লোক ঠিক করতে প্রস্তাব দেয়। চালক অরুণই ডাকাতদের জানায়, ডা. নিতাইয়ের বাসায় ১০৮ ভরি ওজনের স্বর্ণালঙ্কার ও ২০ লাখ টাকা আছে। এগুলো ডাকাতির পর ভাগবাটোয়ারা করা হবে।
এরপর চালক অরুণ কারাগারে থাকাকালীন দীর্ঘ সময়ের পরিচিত সন্ত্রাসী রফিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। রফিক মহাখালী বাসস্ট্যান্ডে চালক অরুণকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠক করে। বৈঠকে পেশাদার খুনী রফিক তার অন্যান্য পেশাদার খুনী ও ডাকাত দলের সদস্য বকুল, মিন্টু, হোসেন, সাঈদ ও কামালকে সঙ্গে নিয়ে ডাকাতি করার প্রস্তুতি নেয়।
গত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ডা. নিতাইয়ের বাড়িটি রফিক, মিন্টু, বকুল ও সাঈদ, চালক অরুণকে সঙ্গে নিয়ে রেকি করে। এরপর পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক রোজা শুরুর ৪ দিন আগে চালক অরুণের সহযোগিতায় রফিক, কামাল, সাঈদ, মিন্টু ও বকুলসহ ডাক্তারের বাড়িতে ডাকাতির উদ্দেশ্যে প্রবেশ করে। রান্নাঘরের দরজায় শাবল দিয়ে ধাক্কা দিলে শব্দ হয়। এতে লোকজন ও নাইটগার্ড টের পেয়ে যাওয়ায় তাদের সঙ্গে থাকা ২টি চাকু, ২টি চাপাতি, ২টি শাবল ড্রাইভার অরুণের তত্ত্বাবধানে বাড়ির বাউন্ডারির ভেতরে কলাগাছের আড়ালে রেখে পালিয়ে যায়।
রোজার শুরুর পর ডা. নিতাইয়ের স্ত্রী ডা. লাকি দত্ত বাউন্ডারির ভেতরের জঙ্গল পরিষ্কার করতে চালক অরুণকে দায়িত্ব দেয়। অরুণ অস্ত্রশস্ত্র রাখার বিষয়টি যাতে ধরা না পড়ে এজন্য টালবাহানা করে ঈদের পর জঙ্গল পরিষ্কার করবে বলে জানায়।
ঘটনার রাতে বকুল, মিন্টু, সাঈদ, কামাল ও হোসেন কাওরানবাজার এলাকায় মিলিত হয়। রাত আড়াইটার দিকে মহাখালী সাততলা বস্তির ভেতরের প্রাচীর টপকে দ্বিতীয় তলার পেছনের জানালার গ্রিল বাঁকিয়ে মিন্টু, কামাল, বকুল, সাঈদ ও হোসেন বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। বেডরুমের দরজা খুলতেই ডা. নারায়ণ ডাকাতদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। এ সময় ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে সাঈদ ও মিন্টু ডা. নিতাইকে বিছানায় ফেলে দেয়। এরপর বকুল ও হোসেন পা চেপে ধরে এবং মিন্টু ছুরিকাঘাত করতে থাকে। চিৎকারে নিচে থাকা ডা. নিতাইয়ের মা মঞ্জু রানী দত্ত দু’তলায় উঠে দরজা ধাক্কাতে থাকলে ডাকাতরা পালিয়ে যায়। পালানোর সময় বস্তির ছেলেরা কামালকে আটক করে। এরপর কামাল কৌশলে পালাতে সক্ষম হয়।
পরবর্তীতে গত ২৬ আগস্ট কামাল হোসেনকে (৩০) রাজধানীর রাজাবাজার থেকে গ্রেফতার করা হয়। কামালের পিতার নাম শামছুল আলম। বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে।
র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার এম সোহায়েল সাংবাদিকদের জানান, গ্রেফতারকৃত রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া ও সাঈদ ডা. নিতাই হত্যাকা-ে সরাসরি জড়িত। আর মূল পরিকল্পনাকারী চালক অরুণ, ডা. নিতাইয়ের রিলায়েন্স ক্লিনিকের ম্যানেজার সাইদুর রহমান ও তারিকুল ইসলাম। হত্যাকা-ের পেছনে আরও কেউ জড়িত আছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আসামিদের দ্রুততার সঙ্গে মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হচ্ছে বলেও তিনি জানান।
এদিকে ডা. নিতাই হত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে। বিএমএ সভাপতি ডা. মাহমুদ হাসানের সভাপতিত্বে সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন বিএমএ মহাসচিব ডা. মোঃ শারফুদ্দিন আহমেদ। সভায় বক্তব্য রাখেন স্বাচিপ মহাসচিব ডা. এম ইকবাল আর্সনাল, বিএমএ সহ-সভাপতি ডা. এমএ রউফ সরদার, ডা. কামরুল হাসান খান, ডা. এম নজরুল ইসলামসহ অনেক সিনিয়র চিকিৎসক।
প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে ডা. নিতাইয়ের হত্যাকারীদের শনাক্ত, মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর, সরকারী বেসরকারী চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, চিকিৎসকদের ওপর হামলা বন্ধকরণ, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অনুমতি ব্যতীত চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে কোন চিকিৎসকে গ্রেফতার না করা, দেশের প্রতিটি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অবস্থিত অবৈধ স্থাপনা, বস্তি উচ্ছেদ, সীমানা প্রাচীর নির্মাণ ও হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজের ভেতরে স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনসহ ৬ দফা দাবি জানানো হয়।
এছাড়া আজ ৩ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা থেকে শোক র‌্যালি বের হবে। ৫ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন কর্মসূচী পালন, ৬ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত দেশের প্রতিটি সরকারী-বেসরকারী হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৩ ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন, ৭ সেপ্টেম্বর কালোব্যাজ ধারণ, ঢাকাস্থ সকল মেডিক্যাল কলেজ, ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে প্রতিবাদ সমাবেশ ও ৮ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। সমাবেশ শেষে পরবর্তী কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.