আলবদর ১৯৭১ by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) কর্নেল সাহেবের এ কথা শুনে আমরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে সাথীদের এখানে আসতে পত্র লিখলাম। কিন্তু কয়েকদিন পরই ফৌজিরা এই ক্যাম্প ছেড়ে অন্যত্র চলে গেল এবং আমাদের বার্মা গবর্নমেন্টের হাতে তুলে দিল। সবাইকে তখন জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হলো।


বার্মার অফিসাররা বললেন যে, তোমরা নিশ্চয়ই বিরাট ত্যাগ স্বীকার করে এখানে এসেছ। কিন্তু আমরা কি করব! পাকিস্তানী দূতাবাস তোমাদের গ্রহণ করছে না। এ কারণে দেশের আইন অনুযায়ী তোমাদের গ্রেফতার করছি। এটি ছিল ১৭ জানুয়ারির কথা। পরের দিন আমরা পানাহার বন্ধ করে দিলাম। আমরা বললাম যে, ‘আমরা কি চোর যে, আমাদের জেলে এভাবে রাখা হয়েছে?’ এ পরিস্থিতির উদ্ভব হলে দু’তিনজন বর্মী অফিসার এলেন, তারা খানা খাওয়ানোর জন্য জোরাজুরি করলেন। ইমিগ্রেশন বিভাগের চীফ অফিসারও এলেন। তিনি বহু বোঝালেন। কিন্তু আমরা খানা খেতে অস্বীকৃতি জানাতে থাকলাম। শেষ পর্যন্ত জেলার সবচে’ বড় অফিসার (আমাদের ডেপুটি কমিশনারের মতো) এলেন। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। তিনি পাকিস্তান থেকে মেট্রিক পাস করেছিলেন। আমাদের অবস্থা শোনার পর বলতে লাগলেন, ‘আমি রেঙ্গুনে পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলব। আপনারা খানা খেয়ে নেন।’ তিনি ওয়াদা অনুযায়ী পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে বহুত তর্কবিতর্ক করলেন। ফলে দূতাবাস আমাদের দায়িত্ব নিয়ে নিল। ১৮ জানুয়ারি জেলে পাকিস্তান দূতাবাসের পক্ষ থেকে খাবার পাঠানো হলো। এরপর আমরা অন্যান্য সুযোগ সুবিধার জন্য দূতাবাসের কাছে লিখলাম। সে অনুযায়ী, আমরা সব পেয়ে গেলাম। কিন্তু বিভিন্ন নিয়ম পালন করতে গিয়ে আমরা পুরো এক সপ্তাহ জেলে কাটালাম। আমরা কয়েদি থাকা অবস্থায় এলাকার মুসলমানরা আমাদের মুক্তির জন্য একটি এ্যাকশন কমিটি গঠন করলেন। তারা বলতে লাগলেন যে, যদি এক লাখ টাকার জামানতও দিতে হয় আমরা দেব। এই সহানুভূতি সত্যিকার অর্থেই একটি প্রশংসনীয় দৃষ্টান্ত ছিল।
মুক্তির পর দূতাবাস আমাদের একটি হোটেলে রাখল। এই এক মাসে বর্মী মুসলমানরা আমাদের অনেক সেবাযতœ করেছে। আমার জুতা ছিল না। এখানে আইডি কার্ড দিয়েই জুতা নিতে হয়। এক বর্মী ভাই তার কার্ড দিয়ে আমার জন্য জুতা খরিদ করেন। যতদিন ছিলাম, প্রতিদিন অসংখ্য লোক দেখা করতে আসত। এক মাস পর আমাদের পুনরায় ক্যাম্পে নিয়ে আসা হলো, লোকেরা অন্তর খুলে আমাদের স্বাগত জানালেন। ক্যাম্পে আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কয়েকটি মুসলিম বালক আসত। দেখা সাক্ষাতের চেষ্টার পর একদিন মেট্রিকের ২ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের ২৪ ঘণ্টা আটক রাখা হয়েছিল। ১ এপ্রিল আমাদের আকিয়াব থেকে রেঙ্গুনে পাঠানো হলো। আমাদের যাত্রার ব্যাপারটি যদিও গোপন ছিল, তবুও বিদায়ী সালাম জানানোর জন্য হাজার হাজার আকিয়াবী মুসলমান এসে গেলেন। ক্লাস নাইনের একজন ছাত্র, যার নাম রশীদ ছিল, কেঁদে কেঁদে আমাদের অবস্থাটা করুণ করে তুলল। এসব ভালবাসা দেখে আমরা সকল দুঃখ ভুলে গেলাম। রেঙ্গুন পৌঁছলে মুসলমানরা আমাদের সমগ্র শহর ঘুরে দেখালেন। আমরা সেখান থেকে ব্যাংকক এবং ব্যাংকক থেকে করাচী পৌঁছলাম।”
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, আকিয়াব বা আরাকানের যেসব মুসলমানের কথা বলা হচ্ছে এরা রোহিঙ্গা। চট্টগ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে মিল আছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির। এরা পাকিস্তানীদের ভক্ত, যে কারণে তারা আলবদরদের সাদরে গ্রহণ করেছিল। এর এক দশক পর রোহিঙ্গাদের মধ্যে উগ্র জঙ্গীবাদ ছড়িযে পড়ে। খুব সম্ভব আলবদরদের গ্রুপগুলো তাদের উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদে প্রভাবিত করেছিল। বিএনপি-জামায়াত আমলে তাদের প্রশ্রয়ে এই রোহিঙ্গা বা আরকানী মৌলবাদীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘাঁটি বানিয়ে উগ্র মৌলবাদী বা জামায়াতীদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকে। শাহরিয়ার কবিরের বিভিন্ন লেখায় ও তাঁর নির্মিত একটি তথ্যচিত্রে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে। আরও লক্ষণীয় যে, মনসুরের মতো আলবদরকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল একজন মুক্তিযোদ্ধা। ফিদাউল ইসলাম ছিল ঢাকার আলবদর। পাকিস্তান বাহিনী যেদিন আত্মসমর্পণ করল সেদিন এক মেজর তাদের এই খবরটা দিল। এ খবর শুনে তো সবাই মহা উত্তেজিত। তারা শহীদ হবে তবুও আত্মসমর্পণ করবে না। মেজর তখন বললেন, তাদের ওপর হুকুম এসেছে সারেন্ডার করার। ‘আমরা সারেন্ডার করব। তবে আপনাদের এদেশে থেকেই কাজ করতে হবে। সুতরাং সেই লক্ষ্য সামনে রেখে আল্লাহর ওয়াস্তে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখবেন।’
এরপর তো কথা চলে না। কুখ্যাত আলবদর মুস্তাফা শওকত ইমরানের সঙ্গে ফিদাউল পালাল। তার ভাষায়Ñ “এ কথা শোনার পর আমরা সবাই ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় অফিস ১৫ পুরানা পল্টনে যাবার জন্য তৈরি হলাম। এরই মধ্যে একটি খোলা জিপ ড্রাইভ করে মুস্তাফা শওকত ইমরান এখানে এসে পৌঁছলেন। তিনি আমাদেরকে বললেন যে, আপনারা সবাই আমার সঙ্গে চলুন। আমি তো প্রথম থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। ততক্ষণাৎ জিপে উঠে গেলাম। ইমরান ভাই নিজেই জিপ ড্রাইভ করছিলেন। তার এক হাতে নিরাপত্তার জন্য গুলি ভর্তি রিভলবার আরেক হাতে স্টিয়ারিং ছিল। আমরা সামান্য দূরে যেতেই জিপ দুর্ঘটনায় পতিত হলো। তাতে মুস্তাফা শওকত ইমরান ভাইয়ের মাথায় চোট লেগে রক্ত পড়তে লাগল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি খুব সতর্কতার সাথে জিপ চালাতে লাগলেন। তার রক্তের ছিটা রাস্তার ওপর পড়ছিল। আর তিনি আমাদেরকে হেফাজতের সঙ্গে মোহাম্মদপুর আলবদর ক্যাম্পে পৌঁছে দিলেন। কিছুক্ষণ ক্যাম্পে অপেক্ষা করার পর আমি ধানম-িতে আমার ভাইয়ের বাসায় চলে এলাম। তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। আমার পকেটে কানাকড়িও ছিল না। এর কারণ হলো, আলবদর বেতন দিত না। [ এ বক্তব্য ঠিক নয়] আমি আমার অবস্থা রহমান ভাইয়ের কাছে প্রকাশ করতে চাচ্ছিলাম না। অবস্থা অনুমান করে তিনি সাথে যাবার জন্য বললেন। আর আমরা উভয়ে রওনা হয়ে গেলাম। রাস্তায় মুক্তিবাহিনীর একটি গাড়ি নজরে এল। আমি জড়তা কাটিয়ে হাতের ইশারায় গাড়িটা থামিয়ে দেখলাম এবং তাতে উঠে নারায়ণগঞ্জ পৌঁছলাম। অনুরূপভাবে মুক্তিবাহিনীর নৌকায় চড়ে চাঁদপুর গেলাম। আমাদের ধারণা ছিল, আমরা ওখানে নিরাপদে থাকব। কিন্তু কিছু পরেই ভারতীয় ফৌজ আমাদের গ্রেফতার করল। আমরা বললাম যে, আমরা ছাত্র। নিজেদের গ্রামে যাচ্ছি। কিছু দূর অতিক্রম করে আমি যখন বাজারে পৌঁছলাম, তখন সেখানে দেখলাম যে, একজন আলবদর মুজাহিদকে বাঁশের সাথে বেঁধে শহীদ করা হয়েছে। এই সাথীর শরীরে ব্লেড দিয়ে খুঁচিয়ে লবণ ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর তার ঝুলে পড়া মাথার কাছে মার্কার দিয়ে লেখা ছিল ‘গাদ্দারের পরিণতি’। আফসোস যে, গাদ্দাররা একজন দেশপ্রেমিক বীরকে শহীদ করার পর দেশপ্রেমিকের আসল রূপটি নিজেদের করে নিয়েছে। আমি দুই দিনে পাঁচ মাইল পায়ে হাঁটার পর আমার দুধ-ভাইয়ের গ্রামে গিয়ে পৌঁছলাম। তিনি বললেন যে, ‘আমাদের আত্মীয় এক ভাই মুক্তিবাহিনী। সে তোমাকে খোঁজ করছিল।’ এদিকে আব্বাজানের বার্তা পৌঁছেছিল যে, ‘তোমাকে গ্রেফতার করার ওয়ারেন্ট জারি হয়ে গেছে।’ এ খবর শুনে আমি দিনাজপুর গেলাম। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে নেপালের রাজধানী কাঠমন্ডু চলে গেলাম। এই সফর আমি একজন মজুর হিসেবে রাস্তায় পাথর ভেঙ্গে ভেঙ্গে, গৃহ নির্মাণে সিমেন্ট বহন করে করে সম্পন্ন করেছি। অথচ আমি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ছাত্র ছিলাম। ওখানে পৌঁছেও একই অবস্থা ছিল। নেপালে ৬ মাস থাকার পর ভারতের বর্ডার অতিক্রম করে লাহোরে চলে গেলাম। সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ সকল দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দিল।
এখানেও লক্ষণীয় যে, মুক্তিবাহিনীর শৈথিল্যের কারণে, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে থেকেই ফেদাউল পালাতে পেরেছিল। আবু নসর ফারুকিও ঢাকার কুখ্যাত আলবদর। অস্ত্র সমর্পণের কথা শোনার পর ছাত্রসংঘের নেতারা আলবদরদের নির্দেশ দিলেন পালাতে। ফারুকি এ কথা শুনে দ্বিরুক্তি না করে শহরের ভেতরে চলে গেলো। এক রাজাকার তাকে বাধা দিলে সে বলল, ‘আপনারা কী করছেন? পাকবাহিনী অস্ত্র সমর্পণ করেছে, পালান।’ রাজাকার কয়জন বলল, ‘হ্যাঁ, তোমাকে তো মুক্তিবাহিনীর লোক মনে হচ্ছে। তুমি গুজব রটাচ্ছো। তোমাকে মজা দেখাচ্ছি, এ কথা বলে এক রাজাকার তার বুকে রাইফেলের নল ঠেকালো। এমন সময় সৈন্য নিয়ে এক পাকিস্তানী জিপ ওই পথে যাচ্ছিল। তাদের দেখে সিপাহীদের একজন বলল, ‘আমাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, তোমরা পালাও।’
এ কথা শুনে রাজাকাররা ফারুকিকে ছেড়ে পালাল। ফারুকি বুঝতে পারছিল না সে কী করবেন। সে ঠিক করল কোতোয়ালি থানায় যাবে। তার ভাষায়, “মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র পুলিশে ভর্তি হয়ে ডিউটিরত ছিল। ওখানে পৌঁছার পর বুঝতে পারলাম যে, তারা গাট্টি বোচকা বাঁধার অপেক্ষায় আছে। জিজ্ঞাসা করলে একজন বললেন, ‘ভাইয়া, আমরা ডিউটি পাল্টাচ্ছি। যদি পারেন কোন অফিসারকে বলে আমাদের ট্রান্সফার ঠেকিয়ে দেন। আমরা ঢাকার বাইরে যেতে চাই না।’ এ কথা শুনে আমার হাসি পেলÑ ভয়াবহ একটি বিপ্লবকে কিভাবে আলাভোলারা এখনও শুধু এই ট্রান্সফার বলে ভাবছে, সারেন্ডারের যিনি দায়িত্বশীল তিনি নিজের পুলিশ বাহিনীকেও সঠিক পরিস্থিতি অবগত করতে পারেননি।
এখান থেকে নিরাশ হয়ে টিকাটুলি জামে মসজিদে পৌঁছে গেলাম। সে মসজিদের ইমাম সাহেব তো আওয়ামী লীগের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু এটি তাবলীগ জামাতের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। সে সময় আমি ভেতরে প্রবেশ করছিলাম। তখন তাবলীগ জামাতের এক নেতা বলছিলেন, ‘ভাইয়েরা, দোস্তরা জিহাদের সময় এসে গেছে। এখন জিহাদের জন্য আমাদের তৈয়ার হতে হবে। বহুত ফায়দা হবে।’ অনুমান করা গেল, এই লোকেরাও এই পরিস্থিতি সম্পর্কে বেখবর। মাগরিবের সময় হয়েছিল। নামাজ এ মসজিদেই পড়লাম এবং মসজিদের ইমাম সাহেবের নিকট মনের দুঃখ ব্যথা প্রকাশ করলাম। রাতটা তার কাছেই কাটালাম। ধারণা ছিল, নিশ্চিন্তে কয়েকটা দিন এখানেই থাকতে পারব। কিন্তু ফজরের নামাজ শেষ করেছি এমন সময় একটি ছেলে আমার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে মুখ করে বলল, ‘ভাই, আমি তোমাকে চিনে ফেলেছি। সকল সাথী বায়তুল মোকাররম মসজিদে আছে।’
আমি ওদিকে রওনা হলাম।
এটা ছিল ১৭ ডিসেম্বরের ঘটনা। সমগ্র ঢাকা ফায়ারিংয়ের আওয়াজে কাঁপছিল। চারদিকে রক্তের বৃষ্টি আর গুলির আগুন ঝরছিল। মনে হচ্ছিল বারুদের গুদামে আগুন ধরেছে।
রাস্তায় উর্দুভাষী লোকদের লাশের পর লাশ দেখে কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠছিল। হত্যা ও লুটপাটে হিন্দুরা এগিয়ে ছিল। [দেশ তখন প্রায় হিন্দুশূন্য]
ভারতীয় ফৌজের সারি সারি গাড়ি ঢাকা ছাউনির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। রক্তের বন্যায় ঢাকা এই দৃশ্য দেখতে দেখতে যখন বায়তুল মোকাররম পৌঁছলাম তখন সকল সাথী সেখান থেকে চলে গেছে। বাধ্য হয়ে ওখান থেকে আমার ভাইয়ের কাছে গেলাম। ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেখানে আত্মগোপন করে রইলাম। ২৫ ডিসেম্বর পত্রিকায় আমার নাম ছাপানো হয়েছে দেখলাম। দৈনিক বাংলায় বিজ্ঞপ্তি ছিল যে, এই নামের ছাত্রটিকে ধরিয়ে দিন। এই বিজ্ঞপ্তি দেখার পর আখাউড়া জংশনের দিকে চলে গেলাম। এখান থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তারপর সিলেট শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে মুকুন্দাপুর পৌঁছলাম এবং সেখানে বাস করা শুরু করলাম।
আমার পরিকল্পনা ছিল কোন না কোনভাবে বাংলাদেশে থেকে যাব। এরই মধ্যে ঈদুল আযহা এসে গেল। বাড়িতে যাওয়ার জন্য মন তোলপাড় করতে লাগল। কিন্তু অবস্থার দাবি ছিল এই চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলি। আমি সেটাই করলাম। আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে গেলাম। ১৯৭২-এর এপ্রিলে যখন চট্টগ্রাম-আখাউড়া রেল লাইন পুনঃস্থাপিত হলো তখন চট্টগ্রাম চলে এলাম। এ সময় কর্ণফুলী পেপার মিলে স্থানীয়-অস্থানীয় প্রশ্নে বাংলাদেশে বড় ধরনের ঝগড়া হলো। শ্রমিকরা নিষ্ঠুরভাবে একে অপরের কল্লা কাটল, এটি ছিল বস্তুবাদী শ্রেণী-বৈষম্যের স্বাভাবিক পরিণতি। ওই মাসে আমি ওখানেই থাকলাম।
আমি ঠিক করলাম যে, হিন্দুস্তানে যাবার পরিবর্তে বার্মায় যাওয়া উচিত। কিন্তু ভাষা না জানা একটি বড় বাধা ছিল। এ ছাড়া এখানে কারও সাথে পরিচয়ও ছিল না। তা সত্ত্বেও আমি সফরের প্রস্তুতি শুরু করলাম। গায়েব থেকে সামান্য আশার আলো দেখা দিল। আমার এক বন্ধুর মা ছিলেন বার্মিস। তিনি আমার ইচ্ছার কথা জানতে পেরে খুব দরদের সঙ্গে গ্রহণ করলেন। একজন স্মাগলারের মাধ্যমে বার্মায় পাঠানোর কথা বললেন। তিনি আমাকে বার্মায় পৌঁছে দিলেন। এই সফরের ঘটনাবলীও ভীষণ হৃদয়বিদারক। বরং বার্মায় পৌঁছার পরও পেরেশানি শেষ হয়নি। কারেন্সি বদলানোতে বড় ধরনের সমস্যা ছিল। সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরতে থাকলাম, কেউ সাহায্য করেনি। পাকিস্তান ও বার্মার চৌকি টেকনাফে পৌঁছলাম। তো, সেখানে তখনও পাকিস্তানের চাঁদ- তারা পতাকা উড়ছিল। এটি দেখে মনে হয়েছিল সমগ্র জগত যেন কাপড়ের সেই টুকরার মধ্যে গুটিয়ে এসেছে। এখানে আসরের নামাজ পড়ার জন্য পানি মুখে নেয়ার সাথে সাথে ঠোঁট ফেটে গেল। মাগরিবের পর এক জেলের সঙ্গে দেখা হলো। যিনি বাংলা ভাষা জানতেন। তিনি রাতে খাবারের দাওয়াত দিলেন। রাতে তার ঘরেই আরাম করলাম।
বার্মায় তখনকার দিনে তিনটা গ্রুপ তৎপর ছিল। একটি স্বাধীনতার জন্য মুসলিম আন্দোলন, দ্বিতীয়টি স্বাধীনতার জন্য গণআন্দোলন; আর তৃতীয়টি ছিল ওই এলাকায় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম করার দাবিদাররা। আমার মংডু জেলায় পৌঁছার কথা ছিল। গাইডের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছিল যে, সেখানেই পৌঁছে দেবেন। কিন্তু সে আর সামনে যেতে অস্বীকার করল। রাস্তার মাঝখানে ছেড়ে দিয়ে সে কেটে পড়ল।
রাস্তায় প্রচ- পিপাসা লাগলে এক ব্যক্তির কাছ থেকে পানি চাইলাম। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন পার্টির’? আমি চিন্তা করলাম কী বলে হয়ত নতুন কোন বিপদে ফেঁসে যেতে পারি। বললাম, ‘এখন তো সবাই আওয়ামী লীগ।’ তখন তিনি পানি দিতে অস্বীকার করেন। সামনে গিয়ে আরও কিছু লোক পাওয়া গেল। তারাও পানি দেয়ার বেলায় প্রথমে পার্টির নাম জিজ্ঞাস করল। আমি জবাব দিলাম, মুসলিম পার্টির। এটা শুনে তারা খুব আদর-যতœ করল। পরে জানা গেল যে, ওই এলাকার লোকেরা বহুদিন ধরে কায়েদে আজম ও মুসলিম লীগের পূজারি।
আমি মাগরিব পর্যন্ত মংডু যাবার জন্য জাহাজের অপেক্ষা করলাম। কিন্তু তা আসেনি। বসতি অনেক দূরে ছিল। ঘুটঘুটে অন্ধকার আর পানির রহস্যজনক চমকানো মনে হচ্ছিল। চারদিকে আলিফ লায়লা পাহাড়গুলো দেখতে আজব ধরনের আকার-আকৃতির। একবার বাঘের গর্জনের আওয়াজ কানে এল। বড় বড় পাখি আজব ধরনের আওয়াজ করতে করতে আমার মাথার ওপর দিয়ে আসা যাওয়া করছিল। সাপের নড়াচড়া পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। তখন একটি লঞ্চ এল। আমি আওয়াজ দিলাম। লঞ্চওয়ালারা জিজ্ঞাসা করল : ‘কোথায় যাবে?’ উর্দুতে জবাব দিলাম মংডু যাব। তখন আমার কাপড় চোপড় খুব ফকির মার্কা ছিল। লুঙ্গি আর গেঞ্জি ছিল পরা। ভয় ছিল যদি নিয়ে যেতে অস্বীকার করে। কিন্তু তারা লঞ্চে ওঠালেন। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.